রমজান, আত্মশুদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। শারীরিক ও মানসিক সংযমের মাস। কিন্তু রমজান এলেই বাজারে সব জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে কিছু পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। অথচ রমজান মাস পুণ্যার্জনের মাস। এ কারণে এই মাসে মানুষের ভালো কাজ করা উচিত আরো বেশি। কিন্তু এ দেশে ঘটে তার উল্টো।
পুণ্য অর্জনের চেয়ে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, মানুষকে নানা উপায়ে জিম্মি করার উৎসব শুরু হয়! ত্যাগের নয়, ভোগের উৎসবে মেতে উঠি আমরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো উন্নত বিশ্ব নয়, আবার তারা পুরোপুরি সভ্য দেশও নয়। কিন্তু ওইসব দেশে রমজান মাস এলে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীসহ রাষ্ট্র বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ আশা করাও বাদ দিয়ে দিয়েছে। কারণ তাদের কথা, পদক্ষেপ কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে বৈধতা দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এতে সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই। শুধু সয়ে যাওয়া ছাড়া।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বেশ কয়েকটি কারণ আমরা জানি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উৎপাদিত পণ্য ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরগুলোতে আসে। পণ্যবাহী ট্রাক, পিক-আপ লরি, নৌকাসহ যত বাহনে এগুলো বহন করা হয় প্রতিটি বাহনে চাঁদাবাজি হয়। নির্বিঘ্নে কোনো পরিবহন ঢাকায় ঢুকতে পারে না। এটি চলে পুরো পথে বহুবার, বহু জায়গায়। পথে পথে এসব পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিতে দিতে এসব পণ্য যখন বাজারে ক্রেতার কাছে যায় তখন তার দাম দশ থেকে বিশগুণ পর্যন্ত বাড়ে।
আমার মনে পড়ছে ক‘বছর আগে পুলিশের এক আইজি বলেছিলেন, প্রয়োজনে সড়কপথে চেকিং আমরা বন্ধ করে দেব। বলার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। এদিকে দায়িত্বশীলরা বলেন, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ, কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে কয়েকগুণ। কাজেই পণ্যের দাম বাড়ায় জনগণের ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না, পড়বে না। তার মানে আবারও উৎসাহিত করা হলো। যারা এগুলো করছে তারা লাইসেন্স পেয়ে গেলো কাজটি নির্বিঘ্নে করার। বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানী করা হয় সেগুলোর চাঁদাবাজি তো আকাশসম। এর সঙ্গে বড় বড় সিন্ডিকেট জড়িত। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রকৃতঅর্থে কোনো মেকানিজম নেই। জনগণকে বোঝানোর জন্য বলা হয় দেশের বাইরে এসব পণ্যের দাম দেশের চেয়ে বেশি!
আমার মতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি। বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তা নিয়ন্ত্রণ করার মেকানিজম গরিব দেশগুলোর সরকারের থাকে না, থাকার কথাও নয়। এটি ওপর দিয়ে মলম লাগানোর মতো। দ্রব্যমূল্যের ঊধর্বগতি, অতএব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দাও। তো দেশের অন্যদের কী হবে? এগুলো ভাবার যেন কেউ নেই। অন্যদিকে এভাবেই বেড়ে চলেছে সামাজিক বৈষম্য।
আগেকার দিনে যখন প্রথম শ্রেণির একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতন ৪৫০ টাকা ছিল, তারা খেয়েপরে কিন্তু মোটামুটি ভালোই ছিলেন। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া ছিল না। আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের বেতন ছিল ৭৫০ টাকা। তখনও তারা ভালোই ছিলেন। কারণ জিনিসপত্র কেনা যেত। এরপর সময়ের পরিবর্তনে বেতন কতগুণ বৃদ্ধি করা হলো কিন্তু মানুষের হা-হুতাশ কমছে না। ওদিকে বাজারে আগুন বাড়ছেই।
সরকার টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করে ন্যায্যমূলে পণ্য দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি খুব একটা বদলাচ্ছে না। টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েও মানুষ খালি হাতে ফেরত আসে। এতো জনসংখ্যার দেশে সবার হাত ভরে দেওয়া তো সম্ভব নয়। এর চেয়ে বরং অনেক সহজ অত্যাধিক মুনাফার আশায় যে ব্যবসায়ীরা মজুদ করছে তাদের ধরা। ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার করা। দরকার গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো। মজুদদারি ও পাইকারিতেও কঠোর তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে এসব? অসহায়দের কথা কে শুনবে?
চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারমূল্য লাগামহীন পর্যায়ে নেওয়া মারাত্মক অনৈতিক কর্মকাণ্ড। পবিত্র এই মাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পুরো বিষয়টিকে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু সেই আশা কি এ দেশের মানুষ কখনো করতে পেরেছে?
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
/তারা/