সানকারা হত্যার বিচার, আফ্রিকায় নতুন বার্তা
আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান, রক্তপাত, গুম নতুন কিছু নয়। কিন্তু নতুন হলো এসবের বিচার হওয়া। গত ৬ এপ্রিল বুরকিনা ফাসোর একটি সামরিক আদালত ছয় মাসের বিচারের পর বিপ্লবী নেতা থমাস সানকারাকে হত্যার দায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ব্লেইস কম্পাওরেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে কম্পাওরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। জনগণই পরবর্তী সরকারকে বাধ্য করে সানকারা হত্যার বিচার করার জন্য। এটা আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে এক নতুন নজির।
বুরকিনা ফাসো পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ। আয়তন ২ লাখ ৭৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মতো। জনসংখ্যা ২ কোটির সামান্য বেশি। মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের অর্ধেক। বুঝতেই পারছেন হতদরিদ্র দেশ। কিন্তু স্বর্ণ, লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেটের বিশাল খনি সে দেশে। আছে স্রোতস্বিনী তিন নদী। আফ্রিকার চতুর্থ বৃহৎ স্বর্ণ রপ্তানিকারক দেশ। টন টন স্বর্ণ রপ্তানি করে ভাড়ে ভবানী।
আফ্রিকার বেশির ভাগ অঞ্চলই একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ফরাসিরা তাদের নিয়ন্ত্রিত দেশকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছিল। বিভাজনে সবার উপরে ছিল সেনেগাল আর তলানিতে আপার ভোল্টা। যা পরে বুরকিনা ফাসো হয়। যেসব দেশে সম্পদ বেশি ছিল সেসব দেশের প্রতি তাদের মনোযোগ ছিল বেশি। বুরকিনা ফাসো ছিল অন্য অঞ্চলের শ্রমিক সরবরাহকারী অঞ্চল। মানে শোষিতের মাঝেও শোষিত।
১৯৫৮ সালের ১১ ডিসেম্বর ফরাসি শাসন থেকে মুক্ত হয় দেশটি। মরিস ইয়েমেগো সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট হন। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে তিনি হয়ে যান স্বৈরাচারী। নিষিদ্ধ করে দেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
বিপ্লবী নেতা থমাস সানকারা
১৯৬৬ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঙ্গৌলে লামিজানার নেতৃত্বে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানে অপসারিত হন ইয়েমেগো। ঠিক সে বছরেই ১৭ বছর বয়সী কিশোর থমাস সানকারা কাদিওগো সামরিক একাডেমিতে তরুণ ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন। একাডেমিতে কয়েকজন বেসামরিক ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন এডাম টুরে। তিনি ইতিহাস ভুগোল পড়াতেন। উজ্জ্বল ও উৎসাহী ক্যাডেটদের ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে সবক দিতেন। সানকারাকে তার চোখে পড়ে। তিনি তাকে সাম্রাজ্যবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজম, সোভিয়েত এবং চীনা বিপ্লব, আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলন বিষয়ে বলতেন। কিশোর সানকারা বুঝতে পারেন উপনিবেশবাদের একটা কঠিন শৃঙ্খলে আটকে পড়েছে তার দেশে। এতো খনিজ সম্পদ উৎপাদন করেও তাই তারা হতদরিদ্র। এই শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। সেখানেই তার গান ও গিটার বাজানো শেখা। এরপর মাদাগাস্কারে এক বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন।
১৯৮০ সালে কর্নেল সায়ে জেবরো আরেক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন। সানকারা তথ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রিত্ব পেয়ে তিনি বিপ্লবী কিছু পদক্ষেপ নেন। গাড়িতে না এসে প্রতিদিন বাইকে অফিসে আসতেন। সংবাদপত্রের উপর সকল প্রকার সেন্সর তুলে দেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা শুরু করেন। অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় তা ছাপানোর অনুমতি দেন। সরকারি বেসরকারি উভয় সংবাদপত্রে সরকারি দুর্নীতির খবর আসতে শুরু করে। ৮২ সালের ১২ এপ্রিল সরকারের শ্রম-বিরোধী নীতির বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেন সানকারা। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ধিক্কার তাদের যারা জনগণকে ফাঁকি দেয়!’
একই বছর ৭ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থানে মেজর-ডক্টর জিন-ব্যাপটিস্ট ওউয়েড্রোগো ক্ষমতায় এসে সানকারাকে প্রধানমন্ত্রী করেন। কিন্তু চারমাসের মাথায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। তার প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলো সরকারকে বিব্রত করে তোলে। সানকারাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সিদ্ধান্ত তরুণ অফিসারদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। সেটাকে কাজে লাগিয়ে ৮৩-এর আগস্টে সানকারার বন্ধু ব্লেইস কমপাওরে আরেকটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। সে অভ্যুত্থানে সানকারা মুক্ত হন এবং বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হন।
মাত্র ৩৩ বছর বয়সের এক তরুণ ক্ষমতায় বসেই শুরু করেন দেশকে স্বনির্ভর করার সংগ্রাম। দেশের নাম আপার ভোল্টা থেকে বুরকিনা ফাসোতে পরিবর্তন করেন। যার অর্থ ‘সঠিকদের দেশ’। শুরু করেন ব্যাপক ভূমি সংস্কার ও স্বাক্ষরতা অভিযান। তার মাত্র ৪ বছরের শাসন আমলে ২০ লাখের বেশি শিশুকে মেনিনজাইটিস, হলুদ জ্বর এবং হামের টিকা দেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদন বাড়ে ৭৫ শতাংশ। সাহেলের ক্রমবর্ধমান মরুকরণ রোধে ১ কোটির বেশি গাছ লাগান। প্রতিটি গ্রামে একটি মেডিকেল ডিসপেনসারি তৈরির উদ্যোগ নেন। সাড়ে ৭ হাজার গ্রামের মধ্যে ৫ হাজার ৩৪৮টি গ্রামে ডিসপেনসারি স্থাপন করেন তিনি। শিশু মৃত্যুর হার ২০৮ থেকে ১৪৫-এ নামিয়ে আনেন। স্কুলের এনরোলমেন্ট 6 শতাংশ থেকে বেড়ে 22 শতাংশে নিয়ে যান। মহিলাদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ, জোরপূর্বক বিবাহ এবং বহুবিবাহকে বেআইনি ঘোষণা করেন। মহিলাদের বাইরে এসে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। সরকারি বড়ো বড়ো পদে মহিলাদের নিয়োগ দেন। শেষমেশ তিনি সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধু ব্লেইস কমপাওরে যে কিনা তাকে হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সেই হত্যা করে তাকে।
কিন্তু আফ্রিকার মানুষের মন থেকে সানকারাকে মুছে ফেলা যায়নি। ৩৫ বছর পরেও তার ব্যাপক সমাজতান্ত্রিক সংস্কার এবং বক্তৃতার জন্য পশ্চিম আফ্রিকাজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী এবং কিউবার বিপ্লবের অন্যতম আইকন উল্লেখ করে আজও তাকে কেউ কেউ ‘আফ্রিকান চে গুয়েভারা’ বলেন।
বুরকিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাডুগুতে সামরিক ট্রাইব্যুনাল এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অন্য আটজন সন্দেহভাজনকে তিন থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং অন্য তিন আসামিকে খালাস দিয়েছে। ব্লেইস কমপাওরে ছাড়াও অন্য দুই প্রধান আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন ৮৭ সালের অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা গিলবার্ট ডিয়েন্ডেরে এবং ২০১৫ সালের অভ্যুত্থানের নেতা এবং ৮৭ সালে কম্পাওরের রক্ষীদের প্রধান হায়াসিন্থে কাফান্ডো।
/তারা/