করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য এবং প্রাসঙ্গিক কথা
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে কোটি মানুষ মারা যাবে- শুরুর দিকে অনেক বিশেষজ্ঞ এমন আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন। তবে সেই আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে।
সম্প্রতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য প্রকাশের পর সৃষ্ট বির্তকের মধ্যেই এলো আরো একটি সাফল্যের স্বীকৃতি। জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিকেই এশিয়ায় করোনাভাইরাস সামলে ওঠার ক্ষেত্রে বিশ্বের যে দেশগুলো সবচেয়ে ভালো করেছে, তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থান সবার উপরে।
করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা, টিকাদান এবং এই মহামারি মোকাবিলায় সামাজিক তৎপরতার ওপর ভিত্তি করে এই সূচক প্রকাশ করা হয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালে বৈশ্বিক মহামারি করোনা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত বলে তখন মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এছাড়া ওই বছরের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনপিএফ) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. আশা তোরকেলসন করোনা নিয়ন্ত্রণে সুইডেন-ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো সক্ষমতা দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
যারা পৃথিবীকে একটি সুইচ টিপে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, অর্থসম্পদ ও জ্ঞান-গরিমায় যাদের অবস্থান আকাশচুম্বী, এই ভাইরাসের মারণ থাবায় তারা লন্ডভন্ড হলেও, জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পিত নেতৃত্ব, সীমিত সম্পদ নিয়েও এই মহামারির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাপনা ফলপ্রসু হয়েছে। এক কথায় এই মহামারি সফলভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই বাংলাদেশে কোভিড টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় টিকাদান র্যাংকিংয়েও বাংলাদেশ ছিল প্রথম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের এই উদ্যোগ ও কর্মসূচি প্রশংসিত হয়। এর পাশাপাশি মারণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধে যে পন্থাগুলো ব্যবহৃত হয়- যেমন রোগী শনাক্ত পদ্ধতি, সংক্রমিতদের যথাযথ চিকিৎসা, মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করা; এগুলো যখনই সামনে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাপারগুলোকে খুব ভালোভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। তাছাড়া মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ কর্মসূচিও প্রশংসার দাবিদার।
তাই নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলার যে মডেল তৈরি হয়েছে, সেটা অভূতপূর্ব। মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শুরু থেকেই তিনি যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তেমনি একইসঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতেও তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। সংকট মোকাবিলায় দ্রুত বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাঁর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
তবে যত সহজে লিখে ফেলছি বাংলাদেশের এ সাফল্য, বাস্তবতা এর চেয়েও কঠিন ছিল। করোনা মোকাবিলায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন সময় লকডাউন দিতে হয়েছে। আবার অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য যথাসময়ে ধাপে ধাপে তা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে করোনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত মাত্র ১.৪৯ শতাংশ; যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। মূলত, স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা, টিকাদানে জোর দেওয়া, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ফলে প্রথম, দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ তৃতীয় ঢেউ সামলে করোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
এ কারণেই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। রপ্তানির পালে হাওয়া লেগেছে মূলত গার্মেন্টস খাতের উপর ভর করে। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যখন গার্মেন্টেস খুলে দেওয়া হলো, তখন সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল দেশজুড়ে। বলা হয়েছিল, গার্মেন্টসে করোনার চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে কত দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী ছিল, তা বর্তমান বাস্তবতায় জাজ্বল্যমান। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতি-প্রবাহ সঞ্চালনের সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা সঠিক ও যথার্থ ছিল সেটা আজ প্রমাণিত। কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান ক্ষেত্র এই সেক্টর। আর এর ফলে লকডাউনে সবকিছুই স্তব্ধ, নিথর হলেও তখনও বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ছিল অটুট, অক্ষুণ্ণ। তাই দেশে কোনো খাদ্যাভাব হয়নি। একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি।
অন্যদিকে, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে- ‘করোনা মহামারিতে সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে; তখন পৃথিবীর পাঁচটি অগ্রসরমান অর্থনীতির একটি বাংলাদেশ। এই করোনাকালেই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে। মানে নিজস্ব চাহিদা পূরণ করেও অন্যান্য দেশকে আর্থিক ঋণ সহায়তা প্রদানের সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা এমনভাবে বজায় থাকলে আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। তাছাড়া, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ বাড়ছে বাংলাদেশকে’।
তাছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশকে করোনা মহামারি ছাড়াও কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও মুখোমুখি হতে হয়েছে। করোনার ভয়াল থাবা যখন গোটা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে ঠিক তখন দেশের বিভিন্ন জেলা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়। আঘাত হানে ঘূর্নিঝড় আম্পান। বন্যা, করোনা ও আম্পানের কারণে অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ অবস্থা সরকার হয়তো সামাল দিতে পারবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশকে সে অবস্থায় উপনীত হতে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই টিকার বিষয়ে শতভাগ জোর দিয়ে এসেছেন। শুরুর দিকে টিকাদান কর্মসূচিতে একটু সমস্যা হলেও সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সংকট কাটিয়ে উঠে চমৎকারভাবে টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং সে অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে টিকা কর্মসূচি উৎসবে পরিণত হয়েছে- এ কথা বলা যায়। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি রয়েছে। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি, টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি। তাছাড়া করোনার টিকাদান কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে। এখানে আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ্য যে, বিশ্বের অনেক দেশে টিকার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামলেও সরকারের ব্যাপক প্রচারণার কারণে আমাদের দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে টিকা নিয়েছে। আর এ কারণেই অল্প সময়ের ভেতরে টিকাদানে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় অর্জন করে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমরা এক্ষেত্রে ভালো করেছি।
একথা অনস্বীকার্য যে- করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছে শক্তিশালী স্বাস্থ্য অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা। কারণ, স্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলায় বিশ্ববাসীর মতো আমরাও কতটা অসহায় এবং অপ্রস্তুত বর্তমান কোভিড-১৯ সংকট এটাই প্রমাণ করেছে। মূলত, সরকার প্রধানের দূরদৃষ্টি এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারার সক্ষমতার কারণে দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও মহামারির ভয়াবহতা থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে বাংলাদেশ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসার সঙ্কটে যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য জোর প্রস্তুতি নেওয়া এখন থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ, আমরা যদি আমাদের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে চাই, তা হলেও প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন এবং ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা/তারা