ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

ইউক্রেন যুদ্ধ কি দীর্ঘমেয়াদী হবে?

ড. কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ৪ জুন ২০২২  
ইউক্রেন যুদ্ধ কি দীর্ঘমেয়াদী হবে?

ইউক্রেন যুদ্ধের শততম দিন পূরণ হয়েছে শুক্রবার। সঙ্গত কারণে নানা রকমের হিসাব-নিকাশ চলছে। কী পেলো রাশিয়া? ইউক্রেনেরই বা কী প্রাপ্তি ঘটলো? এই ক’দিনের বিচারে কার বিজয় হয়েছে, কতটুকুই-বা সেই বিজয়- এ রকম নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে একটা বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হবে, সহসা শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু সেই দীর্ঘমেয়াদ কত দিনের? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই? 

এ কারণে বিশ্ব যে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ও আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ধরন এবং এর বিস্তার ও বিভিন্নজনের অংশগ্রহণের নিরীখে এই যুদ্ধকে হয়তো ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলা যাচ্ছে না; তেমনটা বলাও হচ্ছে না। কারণ বিশ্ববাসীর রয়েছে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনামূলক পর্যালোচনায় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে ওই দুটো যুদ্ধের কোনো মিল নেই। কিন্তু মিল না থাকলেও সত্যিই যদি যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবতায় গড়ায় তাহলে এই যুদ্ধের পরিণতিতে যে সংকট সৃষ্ট হবে সেটা আগের দুই বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়রাবহ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা এ রকম; এখন আর গত শতাব্দীর মতো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয় না। তার প্রয়োজনও নেই।

এক্ষণে একটু পরিষ্কার হওয়া জরুরি যে, পৃথিবীতে অসংখ্য যুদ্ধ হলেও আমরা কেন বিংশ শতাব্দীর দুটো যুদ্ধকেই কেবল ‘বিশ্বযুদ্ধ’ বলি। এর কারণ হলো, ওই দুটো যুদ্ধ কেবল কোনো দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, কোনো অঞ্চলের বৃত্তে আটকে ছিল না ওই যুদ্ধের দামামা। এমনকি একটা মহাদেশের মধ্যেও নয়। ওই দুটো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রায় সব দেশ-সব মহাদেশ। এ কারণে ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালে সংঘটিত যুদ্ধকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলা হয়। যুদ্ধের প্রকৃতি বিচারে ইউক্রেন যুদ্ধ কোনোভাবেই তেমনটি নয়। কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদী হলে আরও যতো ধরন ও রকমের সংকট দেখা দেবে তা হয়তো পূর্বাভিজ্ঞতার বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি-সর্বনাশ-দুর্যোগ-দূর্বিপাককেও বহুলাংশে ছাড়িয়ে যাবে। কেন এই আশঙ্কা, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া দরকার যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে। 

যুদ্ধের একশ দিন পেরিয়ে এসে স্পষ্ট হওয়া দরকার এই যুদ্ধ এখন ঠিক কোন্ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আমরা বিভিন্ন পক্ষের উল্লেখযোগ্য যে অভিমত জানতে পেরেছি তা জেনে নেওয়া জরুরি।

এক. ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেই স্বীকার করেছেন তার দেশের ২০ শতাংশ এখন রাশিয়ার দখলে রয়েছে।
দুই. রাশিয়া-ইউক্রেনের বাইরে এই যুদ্ধের অন্যতম কুশীলব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের গোয়েন্দা বিভাগের বরাতে গণমাধ্যমে উল্লিখিত হয়েছে, যুদ্ধে রাশিয়া এখন পূর্ব ডনবাসে কৌশলগত সাফল্য পেলেও এর জন্য রাশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
তিন. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেপথ্যে অন্যতম কারণ হলো, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ার প্রসঙ্গ। সেই ন্যাটোর প্রধান ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন ‘ওয়ার অব অ্যাট্রিশন’ বা দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর তিনি যে কথা বলেছেন সেটা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। তিনি বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
খোদ ন্যাটো প্রধান যদি এ কথা বলেন, তাহলে তো যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাঁর কথার সূত্র ধরে এটা স্পষ্ট করা জরুরি যে, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে প্রস্তুত হতে হবে-  এ কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্য হলো এই যুদ্ধের পরিণামে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের জন্য পুরো বিশ্বকে প্রস্তুত হতে হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের একটা বড়ো বাস্তবতা হলো, আমরা এই যুদ্ধের সব খবরাখবর পাই পশ্চিমা গণমাধ্যমের বদৌলতে। ফলে, যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র আদতে কতটুকু পাওয়া যায়, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ বটে। ফলে, যুদ্ধের খবরাখবরে রাশিয়ার প্রসঙ্গ-তাদের জয়-পরাজয় যতটুকু জানা যায়, তা যে রাশিয়ার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে তা নয়। তারপরও যতোটুকু পাওয়া যায়, কিংবা পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণেই যতোটুকু জানা যায়, তাতে কয়েকটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়।

এক. যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান এখন পর্যন্ত মন্দ নয় মোটেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো তো বলছেই, যুদ্ধে রাশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
দুই. রাশিয়া এখন পর্যন্ত কোনো জায়গায় পিছু হটে নাই। আমেরিকার এতো হুমকি দেওয়ার পরও; এমনকি সম্প্রতি ইউক্রেনকে অর্থ সহযোগিতা ছাড়াও বড়ো রকমের অস্ত্র সহযোগিতার কথা বললেও এ ব্যাপারে রাশিয়া মামুলি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে- নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারের দিকে বিশেষ সতর্কতার নির্দেশ দিয়েছে।
তিন. ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুদ্ধ শুরুর আগে এবং যুদ্ধ শুরুর একেবারে প্রথম দিকে যে অবস্থানে ছিলেন সেই জায়গা থেকে সরে এলেও রাশিয়া এ ব্যাপারে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। জেলেনস্কি স্বীকারও করেছেন তার ন্যাটোতো যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা ঠিক হয়নি এবং ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না। এই উপলব্ধি কিন্তু মোটেই হঠকারী নয়। বরং পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে এমন সিদ্ধান্ত নিতে। কেননা, পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকার যে আশ্বাসে জেলেনস্কি শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তিনি ভালো করেই বুঝেছেন যে, আশ্বাস আর বাস্তবতা মোটেই একরকম নয়। এই অবস্থায় রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। যেমন জানা সম্ভব হয়নি, জেলেনস্কির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করতে চাওয়ার অভিপ্রায় প্রসঙ্গে রাশিয়ার চাওয়া বা ইচ্ছেটা কী।
চার. পশ্চিমা বিশ্ব জোর দিয়েই বলছে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হবে? এটা কী পশ্চিমা বিশ্বের নিজেদেরই কৌশলগত চাওয়া, নাকি যুদ্ধের বাস্তবতায় তেমনটি মনে হচ্ছে। এটা বড় ধোঁয়াশাযুক্ত একটা জায়গা। বাস্তবিকই যদি পশ্চিমা বিশ্বের মতানুযায়ী, যুদ্ধে রাশিয়া চড়া মূল্য দিয়ে থাকে, তাহলে কেন ভাবা হচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হবে। চড়া মূল্যের কারণে রাশিয়াকে তো নিজে থেকেই যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করার কথা, সেই প্রসঙ্গ কেনো আমলে নিচ্ছে না বা জোর দিয়ে বলছে না পশ্চিমা দুনিয়া।

বাস্তবতা হলো, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ফলে, যুদ্ধের ধ্বংস বা ক্ষতি সম্পর্কে রাজারা ওয়াকিবহাল বা অবগত থাকার পরও যুদ্ধে বন্ধে তারা কখনোই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে বিশ্বকে কী ধরনের সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছে তা হয়তো রাজাদের পক্ষে কল্পনা করা দুরুহ কিন্তু প্রজাদের তার মাশুল গুনতে হয় দুর্ভিক্ষাবস্থার সঙ্গে যুঝাযুঝি করে।

ইউক্রেনকে বলা হয়, ইউরোপের শস্য ভাণ্ডার। সেই ইউক্রেন যদি যুদ্ধে জড়িয়ে থাকে তাহলে ইউরোপ শস্য চাহিদা মেটাবে কোন্ উৎস থেকে তা নিয়ে কারও কোনো ভাবান্তর আছে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে হাঙ্গেরি বলেই দিয়েছে যুদ্ধে হচ্ছে ইউক্রেনে আর সংকট দেখা দিয়েছে হাঙ্গেরিতে, অর্থনীতিতেও বিপর্যয় দেখা দিয়ছে।
শুধু ইউরোপ নয়, ইউক্রেনের শস্য ভাণ্ডারের ওপর নির্ভরশীল শস্য আমদানীকারক অনেক দেশ। এমনকি বাংলাদেশও। আমাদের গমের চাহিদা পূরণে ইউক্রেনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমনকি আমেরিকা পর্যন্ত ইউক্রেনের শস্য ভাণ্ডারের সুবিধাভোগী, যদিও তাদের রয়েছে প্রচুর আবাদী-অনাবাদী জমি।

ইউক্রেন যেমন শস্য ভাণ্ডারে পৃথিবীতে অনন্য এক দেশ। রাশিয়াও তেমনি সারা পৃথিবীতে নানারকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আকর বিশেষ। বিশেষ করে তাদের জ্বালানী সুবিধার উপর ইউরোপের অনেক দেশই বড় রকমের নির্ভরশীল। এ কারণে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বিধা ও বিভক্তি রয়েছে। তারা ন্যাটোতে থাকার কারণে নীতিগতভাবে এই যুদ্ধকে সমর্থন করলেও ভেতর থেকে নয়। বাস্তবতাবোধ থেকে তারা এই যুদ্ধে সরব ভূমিকা পালন করছে না। ফ্রান্স-জার্মানির মতো দেশগুলো এই অবস্থানে রয়েছে।

যুদ্ধের একশ দিনের অভিজ্ঞতা এতোটা বিবর্ণ হওয়ার পরও যদি বাস্তবিকই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে বিশ্বকে ধাক্কা খেতে হবে। এই ধাক্কা সর্বাগ্রে পড়বে অর্থনীতিতে- মানুষের প্রতিদিনের চাহিদায়- জীবন যাপনের মৌলিক শর্তে।

পৃথিবীর দেশে দেশে যেভাবে খাদ্য জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তাতে আমদানীকারক দেশগুলোর ভাগ্যে যে শনির দশা অপেক্ষা করছে তার আশঙ্কা করা মোটেই অমূলক নয়। খাদ্য জাতীয়তাবাদের ধাক্কায় ভারত তার রপ্তানী সামর্থ্য সীমিত করেছে। প্রথমে তো বন্ধই ঘোষণা করেছিল। ইন্দোনেশিয়াও হাঁটছে ভারতের পথে। মালয়েশিয়া তো শুধু রপ্তানী সামর্থ্য স্থগিত করেনি, দেশবাসীর জন্যও সীমিত করে এনেছে, যাতে কেউ ইচ্ছামতো মজুদ করতে না পারে। সঙ্গত কারণেই মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করবে আরও অনেক দেশ এবং সেটাই তো খাদ্য জাতীয়তাবাদ- যেখানে অন্য দেশের মানুষের কী হলো সেটা নিয়ে ভাবনা নেই। পাশের দেশের এই গ্রহের মানুষের ভাগ্যে খাবার জুটছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবাভাবির অবকাশ ও ইচ্ছা কোনোটাই নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলো স্বাধীন হলেও সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা যে তারা যথার্থভাবে সদর্থক অর্থ সবক্ষেত্রে-সর্বত্র প্রয়োগ করতে পারেনি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে খাদ্য জাতীয়তাবাদ। যাদের জমি ঘাটতি রয়েছে, তারা যদি অন্য দেশে জমি কিনে হলেও কিংবা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, তাহলে সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা কেনো অন্যান্য দেশ অনুসরণ করলো না। জাতীয়তাবাদ যে কেবল জিগির ও আওয়াজ তোলার বিষয় না- খাদ্য জাতীয়তাবাদ বোধ করি নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

বাস্তবিকই যদি ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হয়, খাদ্য জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে দৃশ্যত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলেও এই যুদ্ধের পরিণতি যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, সেটা বুঝতে কী বিশ্ব মোড়লরা অপারগ? নাকি উলুখাগড়াদের জন্য তাদের হৃদয়ে দয়া-মায়া প্রেম-প্রীতি কিছুই নেই?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়