ঢাকা     শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

সিলেটে বন্যা ও ভবিষ্যৎ-ভাবনা

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২০ জুন ২০২২  
সিলেটে বন্যা ও ভবিষ্যৎ-ভাবনা

উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে বসে আছি! অনেক আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে গত কয়েকদিন থেকে যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনে কল করলে কিছুক্ষণ পর কল না হয়ে লাইন কেটে যায়। বোঝা যাচ্ছে ওপারে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। খবরে দেখলাম সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট-সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। একটা ছবি দেখলাম সিলেট স্টেশনে কোমর পানি উঠে গেছে। এমন দৃশ্য আমার কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য!

সিলেট পর্যন্ত কোনো ট্রেন যেতে পারছে না। মাইজগাঁও এসে ফিরে যাচ্ছে। এতো দ্রুত পানি বাড়ার রেকর্ড বোধহয় অতীতে নাই। সিলেটবাসী পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। যদিও ভাগ্য সহায় যে, এই লেখা যখন লিখছি তখন পানি নামতে শুরু করেছে। রেল যোগাযোগ পুনরায় সচল হয়েছে। 

বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বৃহত্তর সিলেটে অকাল বন্যা দেখা দিয়েছিল। এতে হাওড়ের প্রচুর শস্য বিনষ্ট হয়। অবশ্য সরকারের ত্বরিৎ পদক্ষেপের কারণে তাতে তেমন ক্ষতি হয়নি। একবছরে এটি তৃতীয় বন্যা। তাই এবারের বন্যা ভয়াবহতার পাশাপাশি পুনঃআবর্তন ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বন্যার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে মেঘালয় রাজ্যে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল থেকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা ১৯৯৫ সালের পর থেকে জুন মাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলে জানিয়েছে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি)। অর্থাৎ এর আগেও এমন বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু এমন ভয়াবহতা আমরা দেখিনি। হয়তো ভবিষ্যতে এর চেয়ে কম বৃষ্টিতেও আমাদের আরো ভয়াবহ বন্যা দেখতে হতে পারে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এখনই ভাবা উচিত।

আমাদের আদিভিটা সিলেটে। অবশ্য সিলেটে খুব একটা থাকা হয়নি। কর্মসূত্রে দেড় বছরের মতো সময় সিলেট শহরে ছিলাম। বর্ষা হলেই আমি সুরমা পাড়ে চলে যেতাম বানের জল দেখতে। সেটা আজ থেকে এক যুগ আগের গল্প। তখনই লক্ষ করতাম সুরমা নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কতটা কমে এসেছে। একটু ভারী বর্ষণ হলেই দুকূল টইটম্বুর হয়ে উঠত।

সিলেট অঞ্চলের সবগুলো নদীর পানির উৎস আসাম-মেঘালয়ের পাহাড়। এসব অঞ্চলের পানি নেমে আসার একমাত্র মুখ সিলেট। গত এপ্রিল মাস থেকে এসব অঞ্চলে থেমে থেমে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আসামের গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন হাফলং বানের তোড়ে ভেসে গেছে। ১৮০ জন যাত্রী নিয়ে একটা ট্রেন ভেসে যাওয়ার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল গত মাসে। গত পরশু আসামের করিমগঞ্জে বসবাসরত বরাকভ্যালিবিষয়ক গবেষক বিবেকানন্দ মোহন্তের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, বন্যায় রেল লাইন ডুবে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে শিলচর, আগরতলাসহ উত্তর-পূর্বের একাংশের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। শীলং-গৌহাটি সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। করিমগঞ্জ শহরের বেশিরভাগ অঞ্চলই পানির নিচে। এমন ভয়াবহ বন্যা তিনি পূর্বে দেখেননি। আরো শঙ্কার বিষয় পাহাড়ের পানি ঠিক মতো নামতে পারছে না। মনুষ্যসৃষ্ট অনেক প্রতিবন্ধকতায় পানি বাধা পাচ্ছে। ফলে বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ দিনদিন বাড়ছে।

বোঝাই যাচ্ছে বন্যার পানির উৎসস্থল যে আসাম-মেঘালয় সেখানকার অবস্থাও ভয়াবহ! তাই এই বন্যা ব্যবস্থাপনা একক কোনো দেশের পক্ষে আর সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে হয়তো বন্যার প্রতিকার সম্ভব নয়। জোর দিতে হবে ত্রাণ কার্যক্রমের উপর। তবে বন্যার পরপরই যেন বন্যার কথা আমরা ভুলে না যাই। একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা ও পরিকল্পনা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। প্রথম কাজ হবে সুরমা কুশিয়ারাসহ এ অঞ্চলের ছোট-বড়ো সব নদীর গভীরতা ফিরিয়ে আনা। যাতে নদী অধিক পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারে।

উন্নয়ন মানে পরিবেশের ক্ষতি। কিন্তু এই ক্ষতিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসাই গবেষকদের কাজ। অস্বীকার করার উপায় নেই সিলেট অঞ্চলের প্লাবনভূমিগুলোতে এখন জনবসতি গড়ে উঠেছে। জনগণের সুবিধার জন্য পানি নিষ্কাশনের পথে রাস্তা ও সেতু বানানো হয়েছে। হয়ত এর বিকল্প ছিল না। ফলে বন্যার ঝুঁকি এ অঞ্চলে থেকেই যাবে। তবে এই ঝুঁকি হ্রাসের উপায় বের করতে হবে গবেষণার মাধ্যমে। অন্যান্য অঞ্চলের বন্যার চেয়ে এই অঞ্চলের বন্যার তফাৎ হলো এর গতি। এতো দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আরো দ্রুত সাড়াদানের কৌশল ও পর্যাপ্ত আপদকালীন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

মে মাসের বন্যায় আমরা দেখেছি হাওড়ের অনেক অঞ্চলেই টেকসই বাধ নেই। হাওড়ে বাধ নির্মাণ ও অধিকহারে পানি ধরে রাখার কৌশল বের করতে হবে। চীন হোয়াংহো নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় এ কাজ করেছে। তারা নিম্নাঞ্চলগুলোতে বিশাল বিশাল ওয়াটার রিজার্ভ গড়ে তুলেছে। বর্ষায় এসব রিজার্ভারে পানি জমে। সারা বছর এখান থেকে পানি ব্যবহার করা হয়। এ রকম রিজার্ভার তৈরির পর্যাপ্ত স্থান আমাদের হাওড়গুলোতে আছে। 

পৃথিবীর এখন সবচেয়ে দামী পণ্য হচ্ছে সুপেয় পানি। অথচ এই পানিই এখন আমাদের কাছে অভিশাপ। তাই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্যার অভিশাপকে আশীর্বাদে রূপান্তর করতে হবে।

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়