ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৯ ১৪৩১

বিশ্বে বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’ পদ্মা সেতু

ড. কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ২৫ জুন ২০২২   আপডেট: ১১:৩৮, ২৫ জুন ২০২২
বিশ্বে বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’ পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু কী বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’? কোনোপ্রকার দ্বিধা ছাড়াই মুহূর্তে-একবাক্যেই বলে দেয়া যায়- অবশ্যই। 

এ ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয় প্রকাশের অবকাশ নেই; থাকতে পারে না। যদি কেউ তেমনটা বলার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে তার বোঝাবুঝিতে, এ রকম মনোভাবের পেছনে ‘কিন্তু’ আছে। এ রকম চিন্তাভাবনার মানুষ একেবারেই নেই সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে তারা যে সংখ্যায় অল্প সেটা হলফ করে বলা যায়। 

কোনো কোনো সৃষ্টিকর্ম স্রষ্টার কাছ হয়ে ওঠে সিগনেচার-সম। এ কারণে ওই সৃষ্টিকে বলা তাঁর ‘সিগনেচার নেম। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যুৎসইভাবেই রয়েছে। যেমন জীবনানন্দ দাশের কথা বললেই মনের সামনে ভেসে ওঠে ‘বনলতা সেন’। কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে ‘বিদ্রোহী’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’।

আরো পড়ুন:

এ রকমভাবে কোনো কোনো স্থাপনাও হয়ে ওঠে একটা দেশের ‘সিগনেচার নেম’। যেমন ‘আইফেল টাওয়ার’র কথা উঠলেই ফ্রান্স দেশটির কথা মনে পড়ে যায়। ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। কাতার মানেই ‘বুর্জ খলিফা’ ‘বুর্জ খলিফা’ মানেই কাতার। বিদেশীদের কাছে ভারত মানেই ‘সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি ‘তাজমহল’র দেশ। আরও যদি পেছনে যাওয়া যায়, তাহলে মিশর মানেই ‘পিরামিড’র দেশ। নেবুচাঁদের ‘শূন্য উদ্যান’ মানেই ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া। এ সবই ‘সিগনেচার নেম’ হয়ে ওঠার যুৎসই উদাহরণ। 

একইভাবে ‘পদ্মাসেতু’ এখন থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’। কোন্ বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশ সাহসে-সংকল্পে-প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বের বিস্ময়। উপরে যেসব উদাহরণ নেওয়া হয়েছে তাদের মতোই এখন বাংলাদেশ আর পদ্মা সেতু একে অপরের এপিঠ-ওপিঠ। 

লক্ষ্যণীয়, অন্যান্য ‘সিগনেচার নেম’ এর সঙ্গে পদ্মা সেতুর গর্ব ও গৌরবের জায়গাটা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। পদ্মা সেতু কেবলমাত্র কোনো স্থাপনা নয়। বাংলাদেশের ক্রম উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মাইলফলকস্বরূপ। এই সেতু উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে আরও বেশি বেগবান করবে। সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রকে সুষম ও সাম্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। পুরো দেশটাকে একটা পাটাতনে আনার বিরল সুযোগ করে দিচ্ছে এই সেতু। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে।  

মহোত্তম এই অর্জনের পেছনে যার অবদান সর্বজনস্বীকৃত ও নন্দিত, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অকুতোভয়-সাহসী এক স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি জানেন অসম্ভবকে কীভাবে সম্ভব করতে হয়। অজেয়কে কীভাবে জয় করতে হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল ও নির্মাণগত দিক দিয়ে জটিল ও দুরুহ একটা সেতু নির্মাণে সাফল্য অর্জন করায় বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন বিশ্বের বিস্ময়! মোট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দ্বিতল এই সেতু। যার প্রস্থ ৭২ ফুট আর লেনসংখ্যা চার, পিলারের সংখ্যা ৪২ এবং দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি কাজ, এমনকি করোনার মহামারির সময়েও।

ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আজ স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের উদ্দেশে। শুরু হবে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বপ্ন দেখতে যেমন জানেন তেমনি সেই স্বপ্ন পুরো জাতির মধ্যে সঞ্চারিত করতেও পারেন। সেই স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। যা এখন বাস্তব। কদিন আগেও যা ছিল অধরা, অলীক কল্পনা। আকাশ পাতাল স্বপ্ন দেখা এক প্রগলভতা। 

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নবীন দেশ হলেও বাংলাদেশের ব্যতিক্রমীতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। যে বিজয়ের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘সাতকোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

সত্যিসত্যি একাত্তরে দাবায়ে রাখতে পারেনি বাঙালি জাতিকে। দাবায়ে রাখতে পারলো না দুই হাজার বাইশেও। ‘পদ্মা সেতু’ শব্দবন্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ বছর বয়সী বাংলাদেশের সাহস-সংকল্প-সমৃদ্ধির চিত্রটা হয়ে যায় স্পষ্ট ও অনন্য। বিশ্ব মানচিত্রে পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশ ও বাঙালির ‘সিগনেচার নেম’। সুকান্ত ভট্টচার্য যে বলেছিল, ‘ সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়;/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বাংলাদেশ সেটা  প্রমাণ করেছে। যা ছিল একদা কবির কল্পনা, তা এখন বাস্তব। রূপকথাকে হার মানানো আরেক রূপকথা। যা সংঘটিত হয়েছে আমাদের কালে, আমাদের দেশে, আমাদের চোখের সামনে, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৌরহিত্যে। 

স্বাধীনতা অর্জনের সময় যে দেশটিকে বলা হয়েছিল, ‘বটমলেস বাসকেট’। যে দেশের কথা শুনলেই কিছুদিন আগেও বিশ্ব ভূগোলের বাসিন্দারা বলতো, ‘ও বাংলাদেশ- ওখানে তো কেবল ঝড়-ঝঞ্ঝা আর বন্যা হয়’। ইত্যাকার সব ঔপনিবেশিক মিথ যে দেশটির ললাটে সেঁটে দেয়া হয়েছিল চাঁদের কলঙ্কের মতো। যদিও আমরা বলেছি বারংবার, ‘তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসী মন আদ্র হয়নি মোটেই। পদ্মা সেতু প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ কেবলই ঝড়-ঝঞ্ঝা আর বন্যার দেশ নয়। বটমলেস বাস্কেট নয়। নদীমাতৃক একটা দেশ। সুজলা সুফলা একটা ভূমি। তোমাদের ইউরোপীয় দেশগুলোর জ্ঞাতি ভাইয়েরা এই দেশটিকে লুট করেছে দিনের পর দিন। ঔপনিবেশিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশই ছিল প্রায় দু’শ বছর, পাকিস্তান ছিল সিকি শতাব্দী। এদের শাসন- শোষণ ও লুণ্ঠনে রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলার- সোনাতুল্য সম্পদ হয়েছে অন্যের। বনলতার রূপ হৃত হয়েছে বেহায়া বেনিয়াদের হাতে। সুতরাং, কিসিঞ্জার ও তার নাতি-পুতিরা ক্লাইভ ও তার উত্তরসূরিরা, ভাস্কো দা গামা ও তার সতীর্থদের চশমায় যে বাংলাদেশকে দেখা হয় সেই চিত্র আজকের নয়। একাত্তর পরবর্তী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নয়। বাঙালির দেশপ্রেম ৭১-এ যেমন স্পষ্ট হয়েছে- তেমনি স্পষ্ট হয়েছে জাতীয় ঘটনার সকল সংকটে- দেশমাতৃকার সকল প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্লভ নেতৃত্বগুণে স্বাধীন হয়েছিল এই দেশ। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নিশ্চিত করা হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের নিশ্চিত বিজয়। রূপকথার এক গল্প সংঘটিত হয়েছিল ৭১-এ। ঠিক তার পঞ্চাশ বছর পর ২০২২ এসে সংঘটিত হলো আরেক রূপকথা। যার ভরকেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। এ বুঝি ইতিহাসেরই চাওয়া। 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি পেয়েছিল প্রথমবারের মতো স্বাধীন সার্বভৌম এক দেশ, লাল সবুজের পতাকা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি পেল পদ্মা সেতুর মতো অনন্য এক স্থাপনা। এই সেতু বাঙালিকে নতুন করে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করবে। বাংলাদেশকে এক সূত্রে গ্রথিত করবে। বাঙালির জাতীয় জীবনে ডেকে আনবে নব উন্নয়নের জোয়ার-নবপ্রাণের আনন্দ। পদ্মা সেতু নির্মাণ ও বাস্তবায়নের স্বপ্ন সহজ ছিল না মোটেই। পদে পদে ছিল বাধা। পথ ছিল কন্টকাকীর্ণ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র ছিল বিস্তর। বঙ্গবন্ধু যেমন পাকিস্তানের সিকি শতাব্দীতে কোনো রক্তচক্ষুকেই পরোয়া করেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যাও সকল ষড়যন্ত্রকে পায়ের তলার ভৃত্য বানিয়ে নিজ লক্ষ্যে থেকেছেন অটল ও অবিচল। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রশ্নে থেকেছেন নিঃশঙ্কচিত্ত এক যোদ্ধা। হয়ে উঠেছিলেন জাতীয়তাবাদী এক নায়কের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি-বিরলপ্রজ এক রাষ্ট্রনায়ক। 

বিশ্বে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’। কারণ বাংলাদেশ নামক ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির সাহস-সংকল্প আর সমৃদ্ধিকে উচ্চকিত করেছে পদ্মা সেতু।

বিশ্বের বিরল নদীসমূহের অন্যতম পদ্মা প্রমত্তা গুণে আমাজানের সমধর্মী। এ রকম একটা নদীশাসন সহজ কথা নয়। পদ্মা নদীতে আজ থেকে একশ বছরেরও অধিক সময় আগে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নির্মাণ করা হয়, তখনও বেগ পেতে হয়েছিল ভীষণভাবে। ভেড়ামারা-ঈশ্বরদীর ষোলদাগ-রূপপুর এলাকায় ব্রিজটি নির্মিত হলেও নদীশাসন করতে হয়েছে বাহাদুর-কুচিয়ামোড়ার রায়টা এলাকা থেকে। বলা প্রয়োজন ভেড়ামারা-ঈশ্বরদীর তুলনায় মাওয়া-জাজিরা এলাকায় পদ্মা নদীর খরস্রোতারূপ অনেক বেশী তীব্র ও ভয়ঙ্কর রকমের। এ রকম একটা দানবীয় নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা শুধু কঠিন নয় অনেক খরচেরও ব্যাপার। কিন্তু এখানেই সাহসের পরিচয় দিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা। যতো দুরুহ হোক-যতো অসম্ভবই হোক, পদ্মা সেতু নির্মাণ তিনি করবেনই। 

প্রধানমন্ত্রী শুধু সাহসী হলেন না, সংকল্পবদ্ধও হলেন। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছিলেন, ‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ প্রধানমন্ত্রীও যেন করেছিলেন সেরকম পণ, পদ্মা সেতু তিনি বাস্তবায়ন করবেন। জটিল ও দুরুহ নদী শাসন প্রক্রিয়া এবং বৃহৎ বাজেটের অঙ্কটা অবহিত হওয়ার পরও যখন সাহসী হলেন- শুরু করলেন প্রকল্পের কার্যক্রম। ঠিক তখুনি নির্মাণ সহায়তাকারী-সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলেন সকল প্রকার বিনিয়োগ কার্যক্রম থেকে। মিথ্যে এক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাহায্যের পাততাড়ি সরিয়ে নিলেন তারা। বেগতিক অবস্থায় সকলেই যখন সর্ষে ফুল দেখলেন চোখে। হতাশ- হতোদ্যম হয়ে ক্ষান্ত দিতে চাইলেন রণে। প্রধানমন্ত্রী তখনও অবিচল। তিনি সাহসকে পুঁজি করে সংকল্পবদ্ধও হলেন। তিনি সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ হওয়া মানে গোটা বাংলাদেশ-বাঙালি জাতি সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ হওয়া। বাস্তবে হলোও সেটাই। 

সাহসী ও সংকল্পবদ্ধতো হলেন, কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো দ্বিতল- সড়ক ও রেলসেতুর বিশাল ব্যয় সংকুলান হবে কোত্থেকে? দাতা দেশ ও ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো তো মিথ্যে অভিযোগে ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ। তাহলে কী হবে উপায়। সাহস ও সংকল্পবদ্ধ হওয়ার পরও কি থেমে যাবে পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেখা জাতির যূথবদ্ধ স্বপ্ন? প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন নিজস্ব ব্যয়ে নির্মিত হবে পদ্মা সেতু। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো অসাধ্য সাধনের কর্ম যজ্ঞ। কাজ করতে গিয়েও দেখা দেয় বিবিধ সমস্যা, কখনও পাইলিংয়ে, কখনও অন্যবিধ কাজে। বেড়ে যায় বাজেট। তবুও হাল ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। 

পদ্মা সেতু অনেকগুলো কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই বলতে হয় জিডিপির কথা। পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে। ২০০৫ সালের পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, এই সেতু চালু হলে সারা দেশে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে।

দুই. যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব গতি সঞ্চার করবে পদ্মা সেত। প্রধান তিন নদী পদ্মা যমুনা ও মেঘনা দেশের ভূখণ্ডকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। পূর্বাঞ্চলে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ। পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী রংপুর খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং মধ্যাঞ্চল মূলত ঢাকাকে ঘিরে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে  রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে বিস্তৃত হলেও পশ্চিমাঞ্চল ছিল বিচ্ছিন্ন। বঙ্গবন্ধু, মেঘনা, ভৈরব ও মেঘনা গোমতী সেতু যেমন পূর্ব ও উত্তরকে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগকে সহজ ও দ্রুত করেছে। পদ্মা সেতু শুধু পশ্চিমাঞ্চল নয় সারা দেশকে একসুতোয় বেঁধে দেয়ার কাজটি করেছে।

পদ্মা সেতু হওয়ায় ফেরীর তুলনায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সময় লাগবে অনেক কম। মানুষের ভোগান্তি কমবে। এবং সময় বেশী লাগার কারণে পচনশীল যেসব জিনিস ঢাকায় আনা সম্ভব হতো না। বিশেষ করে মাছ, ফল-ফুল ও শাকসবজি সেগুলো সহজেই ঢাকায় আনা সম্ভব হবে। ফলে, অর্থনেতিক লেনদেন বাড়বে এবং মানুষের কর্মসংস্থান ও ভাগ্যেন্নয়নের সুযোগ ও সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।

পশ্চিমাঞ্চলের দুটো সামুদ্রিক বন্দরকেই এখন চট্টগ্রাম বন্দরের মতো সার্বক্ষণিক কাজে লাগানো সম্ভব হবে। আমদানী-রপ্তানি খাত বিকশিত হবে। ভারী শিল্পের বিকাশ ঘটবে ক্রমান্বয়ে আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ হবে দীর্ঘমেয়াদে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চারিত হলে পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আয় বেড়ে যাবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন ঘটবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দারিদ্র্য মানচিত্র বলছে, পদ্মার ওপারে জেলা রয়েছে ২১টি, এর মধ্যে ৫৩টি রয়েছে উচ্চ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে, ৪২টি মধ্যম দারিদ্র্য এবং ৩৮টি রয়েছে নিম্ন দারিদ্র্য ঝুঁকিতে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই চিত্র দ্রুতই বদলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

পদ্মা সেতু চালু হলে কিছু পেশা বিলুপ্ত হওয়ার যেমন ঝুঁকি রয়েছে তেমনি নতুন নতুন পেশাও যুক্ত হবে। এবং সেখানে ব্যাপক আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। পর্যটনের সুযোগ তৈরি হবে এবং একে ঘিরে বড়ো ধরণের অর্থনৈতিক লেনদেনের সম্ভাবনা দেখা দেবে।

কৃষি ও পরিবহনশিল্পে বিপ্লব সাধিত হবে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও পরিবহনশিল্প অবিকশিত ছিল কেবল পদ্মা নদীর কারণে। আধুনিকতার ছোঁয়া বঞ্চিত এই দুই শিল্প শিগগিরই দেশের অন্যান্যাঞ্চলকেও টেক্কা দেবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট খাত বিশেষজ্ঞরা। কৃষি ও পরিবহন খাত জমজমাট হয়ে ওঠা মানে অন্যান্য খাতেও এর প্রভাব পড়বে। ফলে, এক পদ্মা সেতু গোটা পশ্চিাঞ্চলের ভাগ্যোন্নয়নে যেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তেমনি দেশের সার্বিক উন্নয়নেও গতি সঞ্চার করবে।

বাংলাদেশের মানুষের সাহস সংকল্প ও প্রবৃদ্ধির প্রতীক। জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক ও বাহক। বাংলাদেশকে একসূত্রে বাঁধার বীজমন্ত্র। একারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ‘সিগনেচার নেম’ পদ্মা সেতু।

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়