ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

বিশ্বাস আর বিশ্বাস ভঙ্গের পরম্পরা

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ২২ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১৪:০২, ২২ আগস্ট ২০২২
বিশ্বাস আর বিশ্বাস ভঙ্গের পরম্পরা

একজন চা শ্রমিকের জীবন আর অন্য দিনমজুরের জীবন ও জীবিকার পার্থক্য দেশ কাল ও ইতিহাস নির্ধারিত। একজন চা শ্রমিক সারাদিন কাজ করে ১২০ টাকার বিনিময়ে পাওয়া জীবন আর অন্যান্য শ্রমিক; হোক সে রিকশাচালক কিংবা অন্য যে কোনো দিনমজুর তার মজুরি যদি ১০০ টাকাও হয় তবু দুই জীবনে পার্থক্যটুকু আকাশ-পাতাল। অমানবিকতা আর অনিবার্যতায়।

সেটা কেমন যদি জানতে চান,তবে খুব সহজ করে বলা যায় একজন দিনমজুর চাইলে রিকশা চালানো ছেড়ে মাটি কাটতে পারেন, একজন শ্রমিক মাটি কাটা ছেড়ে বাজারে সবজি বেচতে পারেন। কিন্তু একজন চা শ্রমিক চাইলেই তা পারেন না। তাদের জীবন দাসত্বের জীবন। ১৮৩৩ সালে রদ হয়ে যাওয়া নির্মম দাসপ্রথার অবশেষ এই চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যারা বেমানান। বেমানান মূলধারার সঙ্গে সংযুক্তিহীন তাদের ভাষা আর জীবনাচরণ নিয়ে।

সারি সারি চা গাছের মোড়কে ঢাকা পড়ে থাকা শোষণ ও বঞ্চনার অদৃশ্য দেয়ালে বন্দি এই  জীবনে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তাদের সরল বিশ্বাসকে পূঁজি করে। আর বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা। তারপর শুরু থেকে আজ অবধি চা শ্রমিকদের বঞ্চিত জীবনের সঙ্গে মিশে আছে শুধুই বিশ্বাস আর  বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস।

ইংরেজ শাসকরা বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ থেকে তাদের এই অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে। নিচু শ্রেণির দরিদ্র মানুষগুলো বিশ্বাস করেছিল, নিজস্ব মুলুক ছেড়ে আসলে তারা ‘গাছ নাড়বে টাকা পাবে’। কিন্তু আসার পর যে কঠিন সংগ্রামের জীবন তারা আবিষ্কার করেছিল সেখান থেকে তাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ ছিল না। হিংস্র শ্বাপদসংকুল প্রতিকূল পাহাড় জঙ্গলময় পরিবেশকে তৈরি করতে হয়েছিল চা চাষের উপযোগী করে। নিজেদের বসবাসের উপযোগী করে। এই উপযোগী করে তোলার লড়াইয়ে তাদের বেঁচে থাকাই হয়ে পড়েছিল দুঃসাধ্য। কতো প্রাণ যে বেঘোরে গেছে আপনার ব্রেকফাস্টের টেবিলে এক কাপ ধুমায়িত চা তুলে দেওয়ার জন্য, তার হিসাব কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। 

শুরুতে এই বঞ্চনার ফাঁদ যখন তারা আবিষ্কার করে, তখন ফিরে যাবার পথ বন্ধ হলেও বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল কেউ কেউ। কিন্তু পারেনি। বাঙালি বাবু আর ইংরেজ সাহেবরা তাদের ধরে এনেছে ক্রীতদাসের মতো। অত্যাচার, নির্যাতন আর অমানবিক শাস্তির আঘাতে তখনো প্রাণ গেছে অনেক। ‘সাহেব বলে ধরে আন, বাবু বলে লিব পিঠের চাম’ গানের এই যে মাতাল করা পাহাড়ি সুর, তা কেবলই গানের কথা নয়। দুমুঠো খাদ্যের নিশ্চয়তায় যারা সাহেবদের বিশ্বাস করে চলে এসেছিল নিজের মুলুক ছেড়ে শুরু থেকেই সেই বিশ্বাসের বিনিময়ে, কঠোর শ্রম আর সংকটময় জীবন বিপন্ন করা লড়াইয়ে তারা পেয়েছে কেবলই বিশ্বাসঘাতকতার পর বিশ্বাসঘাতকতা। একের পর এক।

ক্রমাগত বঞ্চনায় অসহায় চা শ্রমিকেরা একবার ফুঁসে উঠেছিল সেই ১৯২১ সালে। ‘মুলুক চলো’ সেই বিদ্রোহের নাম। ২১ মে দলে দলে চা শ্রমিকেরা জড়ো হয় সিলেট রেল স্টেশনে। মালিক পক্ষ আর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত গোপন ষড়যন্ত্রে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় এই স্টেশনের ট্রেনের স্টপেজগুলো। হতবিহ্বল শ্রমিকেরা তবু ফিরে না গিয়ে চলা শুরু করে চাঁদপুর অভিমুখে। মেঘনা ঘাটের উদ্দেশ্যে। তারা যে কোনোভাবে ফিরে যাবে নিজ ভূমিতে। এই দাসের জীবন আর কাটাবে না তারা। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বা গাড়িতে। তখন চাঁদপুর স্টেশনে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় শতাধিক চা শ্রমিক। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা প্রাণভয়ে লঞ্চে উঠতে গেলে খুলে দেওয়া হয় লঞ্চের পাটাতন। পানিতে পরে মারা যায় অনেক চা শ্রমিক। এই দুই দুইটি হত্যাকাণ্ডে কতোজন শ্রমিক মারা গিয়েছিল তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না কোথাও। অসংখ্য মৃত্যুর বিনিময়ে রচিত হয় দ্বিতীয়বার বিশ্বাস ভঙ্গ আর চা শ্রমিকদের ক্রমাগত পরাজয়ের আরেকটি ইতিহাস।

স্থানীয়ভাবে চা শ্রমিকদের বলা হয় ‘কুলি’। সাধারণ ভদ্র সমাজে এরা অচ্ছুত। এদের ভাষা আলাদা, জীবনাচরণ আলাদা। কয়েক প্রজন্ম এদেশে বসবাসের পর এদের প্রাণপণ চেষ্টা নিজেদের ভোজপুরি, তেলেগু, ওরাং ভাষা ভুলে ক্রমাগত মূলধারায় মিশে যাওয়া। অথচ শিক্ষা, রুচি কিছুই গড়ে উঠার সুযোগ নেই তাদের। মূলধারা কখনোই তাদের নিজের ভাবে না।

বাংলাদেশে ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। বৃহত্তর সিলেটেই এর অধিকাংশ অবস্থিত। কিছু চট্টগ্রাম আর কিছু বর্তমানে পঞ্চগড়ে। চা বাগানকেন্দ্রিক অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে দুরকম শ্রমিক। নিবন্ধিত শ্রমিক এবং অনিবন্ধিত শ্রমিক। নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার। এবার ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে সিলেট ভ্যালি, হবিগঞ্জ ভ্যালি এবং মৌলভীবাজার ভ্যালির শত শত চা শ্রমিক যখন রাজপথে তখন উত্তাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত পড়ছি আর ভাবছি দুটি পাতা একটি কুঁড়ির কাব্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা কিছু মানুষের না-মানুষী জীবনের করুণ গাথা। হলিডে মুডে রিসোর্টে থেকে ছায়াবৃক্ষের নিচে সারি সারি সবুজ গাছের সারি, দিগন্ত ঘেঁষে সবুজ গাছ আর নীল আকাশের মাখামাখি দেখার যে অপার আনন্দ তার দর্পণে কোনোদিন দেখা যাবে না এই পর্যুদস্ত জীর্ণ শ্রমিকদের মুখচ্ছবি।

বর্তমানে তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। আপনার মোবাইল অ্যাপস যখন জানাচ্ছে আপনার শহরের তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফিল ৪৭ ডিগ্রি তখন চা শ্রমিকেরা খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে। একবার ভাবুন, এসি থেকে বের হয়ে আপনি দরদর ঘামছেন, আর এরা রাজপথে। তপ্ত পিচ পায়ের নিচে আর মাথার উপর উদগ্র সূর্যের তাপ। বাতাসে অসহনীয় আর্দ্রতা। ধর্মঘটে কর্মবিরতি, তাই মজুরি নেই। ঘরে খাবারও নেই। একবার শুধু ভাবুন...। প্রায় পনেরো দিন আন্দোলনে, পুলিশের বেধড়ক পিটুনি খেয়ে রফা হয়েছে ১৪৫ টাকা। ভিক্ষার চাল কাড়া আর আকাড়া। শ্রম অধিদপ্তর আর চা শ্রমিক ইউনিয়নের পারস্পরিক চুক্তিতে এই রফা হয় ২০ আগস্ট। যদিও চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল সভাস্থল থেকে বেরিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে জোর করে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। তিনি এই চুক্তি মানেন না। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২১ আগস্ট হাজার চা শ্রমিক ঢাকা সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। এবং দুপাশে ছিল দীর্ঘ যানবাহনের জট।

বিশ্বাসভঙ্গের গল্পগুলো এখানেও একই রেখায় বহমান। চা শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত পঞ্চায়েত যারা মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় নায্য মজুরি আদায় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচিত হন, মালিক পক্ষের সঙ্গে সবার আগে আপস রফা করেন তারা। শ্রমিকরা বিশ্বাসে নির্বাচিত করে প্রতারিত হয় বারবার। বারবার বিশ্বাস ভঙ্গের শিকার হয়ে এরা এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এমনকি কোনো এনজিও, ইউনিসেফ, স্বতোপ্রণোদিত হয়ে কেউ ব্যক্তি বা সাংগঠনিক পর্যায়ে যদি এদের সাহায্য করতে যায় তাদের দিকেও তারা সন্দেহের চোখে তাকায়। প্রতারিত হতে হতে বিশ্বাসহীনতা যেনো এদের মজ্জায় মিশে গেছে। ২০ আগস্ট আন্দোলনরত শ্রমিকরা যখন জানতে পারলো নির্মল পাল ১৪৫ টাকায় আপসনামা করেছে তখন তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন যে, সেই মুহূর্তে তাকে কাছে পেলে কাঁচা খেয়ে ফেলবে তারা।

চলুন তাদের দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি আর রেশন, বসতভিটা, ফ্রি চিকিৎসার শুভঙ্করের ফাঁকিগুলো জানি। আগে উল্লেখ করেছিলাম, চা বাগানগুলোতে দুই ধরনের শ্রমিক। নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত। এই নিবন্ধন, অনিবন্ধনের সঙ্গে দক্ষতা, পারঙ্গমতা, শ্রমিকের প্রয়োজনের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতি পরিবার থেকে একজনকে নিবন্ধিত শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া হয়, যে দৈনিক মজুরি পায়। সে হোক তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জন কিংবা ১২ জন কিংবা ততোধিক। এই দৈনিক মজুরিরও রয়েছে নানা শর্ত। নিবন্ধিত শ্রমিকটি থাকার জন্য একটা ঘর পায়, একখণ্ড ভূমি পায়। এই নিবন্ধিত শ্রমিকদের প্রায় ৬৪ ভাগই নারী। এক নারী কোনো কারণে অক্ষম হলে পরিবারের অন্য নারীকে স্থলাভিষিক্ত করতে হয়। নইলে তার বসবাসের ভূমিটি হারায়। হারায় নড়বড়ে ঘরটি। এ ক্ষেত্রে যদি সেই নারী শ্রমিক হয় আঠারো বছরের নিচে সেক্ষেত্রে কোনো পক্ষেরই কিছু করার নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ধরে রাখার জন্য নিবন্ধিত হতেই হবে। নব্য দাসদের এ এক অনিবার্য অসহায়ত্ব। 

১২০ টাকা মজুরির অন্যতম শর্ত প্রতিদিন কমপক্ষে ২৩ কেজি পাতা তুলতে হবে। ২৩ কেজির নিচে হলে  প্রতি কেজিতে ৬ টাকা করে মজুরি কম। আর বেশি হলে ২ টাকা করে বেশি। তাদের অভিযোগ রয়েছে এই পাতা মাপায় রয়েছে নানা কারসাজি। নানা অজুহাতে টাকা কেটে নেওয়া হয়। প্রফিডেন্ট ফান্ড কেটে নেওয়া হয়। ফলে কখনোই ১২০ টাকার ‘তোলা’ বা মজুরির ১২০ টাকাই তাদের হাতে পৌঁছায় না।

রেশন রয়েছে সামান্য মূল্যে। পরিমাণও সামান্য। সপ্তাহে তিন কেজি চাল নিশ্চয়ই একজন মানুষেরও এক সপ্তাহের খোরাকী নয়? তাদের ফ্রি চিকিৎসার নামে যা দেওয়া হয়, দুবেলা প্যারাসিটামল। পানীয় জলের সন্ধানে এরা মাথায় কলসী নিয়ে যায় দূরের ছড়ায়। ইদানিং কিছু কোম্পানি কিংবা এনজিও এদের গভীর নলকূপ দেয়, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করে দেয়। এজন্য ১২০ টাকা থেকে নির্দিষ্ট হারে কিস্তি পরিশোধ করতে হয় এদের। ফলে সপ্তাহ শেষে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর এদের হাত শূন্য।
যেভাবে বলছিল চা শ্রমিক ছেলেটি ক্যামেরার সামনে, কোম্পানি প্রদত্ত মাটির দেয়াল আর ছনের ছাউনি দেওয়া একটা ঘর। বছর বছর সংস্কারের কথা থাকলেও চৌকিদার রিপোর্ট দেয় না। ফলে পাঁচ বছরেও সংস্কার হয় না সেসব ঘরের। বৃষ্টিতে পানি পড়ে আর শীতে হু হু করে কুয়াশা। একই ঘরে গরু ছাগল, হাঁস মুরগি, শশুর শাশুড়ি, বউ ছেলে। জীবন তো এদের সেই পশুদের মতো। জৈবিক ক্ষুধা তৃষ্ণার মতোই যৌনতাও। মানুষ বলে কোনো সভ্যতার আড়াল নেই। কারণ উপায় নেই। এতো গেলো নিবন্ধিত কর্মীদের কথা। অনিবন্ধিত কর্মীরা আশায় বসে থাকে, কখন কোন প্রয়োজনে কোম্পানি ডাকে। গাছে পানি দেওয়া, বাবুর বাসায় রান্নাবাড়া করা, ম্যানেজারের সেবা করা এসবই তাদের কাজ। মজুরির কোনো হার নেই। 

শিপ্রা বাউরির বাড়ি যান। দেখবেন হাড়িয়া খেয়ে টাল হয়ে আছে তার স্বামী। পাশে ধুলাবালিতে খেলছে তার গণ্ডাখানেক সন্তান। সবচেয়ে ছোটটির বয়স দুই। শিপ্রা বাউরি হবিগঞ্জ শহরের এক বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। ছয়মাস বাড়ি আসে না। বেশ কিছু টাকা জমিয়ে আসতে হবে তাকে। ঘরটা একেবারেই বসবাসের অযোগ্য। ঠিক না করলে এই বর্ষা পার করা কঠিন। তার শাশুড়ি নিবন্ধিত কর্মী, কাজ করতে চলে যায় সাত সকালে। হাঁস মুরগির বাচ্চার মতো শিপ্রার বাচ্চাগুলোও কী খায়, কই থাকে, কখন ঘুমায় খবর নেওয়ার কেউ নেই।

প্রতিটি বাগানে রয়েছে বৈধ হাড়িয়ার দোকান। সপ্তাহান্তে মজুরির টাকায় অভুক্ত পেটে এরা পেট পুরে হাড়িয়া খায়। খেয়ে মালিক পক্ষ আর বাবুর বঞ্চনা ভুলে যায়। হাভাতে জীবনের যন্ত্রণা জুড়ায় বউয়ের পিঠে চেলিকাঠ ভেঙে। আহা জীবন!

এরা কই যাবে একটু বেশি রোজগারের আশায়?  শহর অনেক দূর! বাগানে যে একটা মাথা গোঁজার ঘরটা দিয়েছে কোম্পানি, ঝড়-বৃষ্টিতে সেখানে আশ্রয় নেওয়া যায়। শহরে এরা কই আশ্রয় নেবে? এদের জীবন আসলে কেনা গোলামের জীবন। এরা নব্য দাস। যাদের বাঁচার কোন পথ খোলা নেই। ১৫ দিন আন্দোলনের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এদের। মালিক পক্ষের কেউ আসেনি এদের সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে। শ্রম অধিদপ্তর কথা বলেছে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে। আসল যে মালিক পক্ষ তারা কোথায়, কেন আসেনি? 

তাদেরও রয়েছে নানা যুক্তি। চা উৎপাদনকারী মালিক পক্ষ জিম্মি নিলামকারীদের কাছে। বাংলাদেশে ইস্পাহানি, ফিনলে, কাজী এন্ড কাজী, বসুন্ধরাসহ হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী নিলামে চা পাতা কিনে নেয়। এই নিলামকারীদের কাছে উৎপাদনকারী কর্তৃপক্ষেরও কিছু করার থাকে না। তারা যে দাম দেয় এর বাইরে কোথাও চা পাতা বিক্রির উপায় নেই। তাদের সঙ্গে দাম নিয়ে বাড়াবাড়িতে গেলেই তারা পাতা না কিনে ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়  করিয়ে দেবে কোম্পানিকে। কখনো চা বাগানের মালিক পক্ষই ক্রেতা পক্ষ। তখন তারাও সিস্টেমের অংশ। শ্রমিকদের মানবেতর জীবন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর মালিক পক্ষের বিনিয়োগ। যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে চা শিল্পের সঙ্গে তাদের বাইরে এক বিশাল লাভের টাকা গুনে নেয় মধ্যসত্ত্ব ভোগী ব্রোকাররা। 

বলা হচ্ছে এই কদিনের ধর্মঘটে ২০ কোটি টাকারও বেশি চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। ব্রোকাররা মুখ ফিরিয়ে নিলে একদিনেই নষ্ট হবে এর চেয়ে বেশি চা পাতা। আমরা বাজার থেকে ৪০০ টাকা কেজি যে পাতা কিনি ফ্যাক্টরি থেকে সেই চা পাতা হয়তো ব্রোকার কেনে ৭০ টাকা কেজিতে। এক্সপার্ট কোয়ালিটি চা পাতা, যা মানের দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত, আমরা হয়তা কোনো দিন যা চোখেই দেখিনি তার নিলাম মূল্য ১৯৮ টাকা। এ এক দুষ্ট চক্রের বিশ্বাস ভঙ্গের ইতিবৃত্ত। নিলামকারীরা দাম দিতে চায় না তাই মালিকরা লাভবান হতে পারে না। মালিকরা লাভবান হতে পারে না তাই শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে পারে না। কেউ জানে না এই দুষ্ট চক্রের কেন্দ্রে কে! কেউ জানে না কে এই দুষ্ট চক্রের জাল ছিন্ন করতে পারে! 

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলছে। শ্রমিক ইউনিয়নের চুক্তি তারা মেনে নেয়নি। মালিক এবং শ্রম অধিদপ্তর খুঁজছে কারা তাদের উস্কানি দিচ্ছে। কারণ নির্বোধ শ্রমিকদের এমন কঠোর দৃঢ়তায় তারা বিশ্বাস করে না। আর নিলামকারী ব্রোকাররা নিরাপদ দূরত্বে মুচকি হাসে।

কাকলি কৈরি, মনীষা বাউরি এরা সারাদিন চা বাগানের পাতা তোলে, কিন্তু এদের কারো ঘরে চা খাবার পাতা নেই। এরা বাড়ির পাশের গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে এনে জ্বাল দিয়ে তাতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে যা খায় তার নাম চা। আপনি এর তুলনা করতে পারেন ফাইভ স্টারে হাজার টাকায় কেনা এক কাপ চায়ের! এরা বিশ্বাস করে এদের মজুরি তিনশো টাকা হবে। এই বিশ্বাসে পুলিশী হামলার মুখে, খালি পায়ের ফোস্কা নিয়ে অনাহারে রাস্তায় পড়ে আছে। কিন্তু ইতিহাস বলে এদের জীবনের চেয়ে চা পাতার মূল্য বেশি। কয়দিন খালি পা আর খালি পেটে রাজপথে পড়ে থাকবে এরা? বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা নিয়ে এরা দাসজীবনে ফিরে গেলো বলে!

আপাতত আজ ২২ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে ফিরে গেছে তারা। জানি না সেই বিশ্বাসের মূল্য কতোখানি পাবে তারা। তবু আশাই শেষ ভরসা। ১৮ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ আমলে যে বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস শুরু, ইতিহাসে শাসক বদলায় কিন্তু তাদের ভাগ্য বদলায় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কেবল সেই বিশ্বাসভঙ্গেরই পুনরাবৃত্তি।

লেখক: নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক 

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়