বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের আল্টিমেটাম এবং বাস্তবতা
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরো অন্তত এক বছর। এর মধ্যেই নির্বাচন ইস্যুতে উত্তপ্ত রাজনীতি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি গত ১৪ বছর ধরে সংসদের ভেতরে-বাইরে নিরুত্তাপ থাকলেও দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি বসে নেই। এমনকি তাদের জোটের কার্যক্রমও চলমান বলে অনেকে মনে করেন। যদিও নাটকীয়ভাবে প্রধান মিত্র জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলেও সেটি কতটা সত্য এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ফলে ধারণা করা যেতে পারে, বিএনপি সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াত অতীতের মতো তাদের সঙ্গেই থাকবে।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে; এ সময়ে এসে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা একটাই- তারা সরকারের পতন চায়। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন না চাইলেও এটা তাদের দ্বিতীয় ধাপের ইস্যু। প্রথম পর্ব সফল করতে ইতোমধ্যে দলটির শীর্ষ এক নেতা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার ও তারেক রহমানের কথায় দেশ চলবে।
কি মারাত্মক কথা! এই আল্টিমেটামের মানে কী? তাহলে কি ঘোষিত তারিখে সরকারের পতন ঘটাতে যাচ্ছে দলটি? এরপর প্রধানমন্ত্রী হবেন বিএনপি প্রধান, তারেক রহমানের কথায় দেশ চলবে না কি বিএনপির নেতৃত্বে দেশের সব দল ১০ ডিসেম্বরের আগেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে মাঠে নামবে। তারা সবাই খালেদা জিয়ার কথামতো কর্মসূচি পালন করবে। অর্থাৎ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায় আমরা দেখব সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে।
এখন কথা হলো শুধু রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াতেই এসব বলে বেড়াচ্ছেন বিএনপি নেতারা না কি এই আল্টিমেটামের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ রয়েছে। প্রস্তুতি থাক বা না থাক- বিএনপি সরকার পতনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে এটা কিন্তু নেতাদের কথায় স্পষ্ট। এর ধারাবাহিকতায় আপাতত সভা-সমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচি পালন করছে দলটি। তাই ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারের পতনের লক্ষ্য কল্পনায় হলেও স্থির করা হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসলে তা কতোটা সম্ভব? বিএনপি সরকারের পতন ঘটাবে, আর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল বসে থাকবে? এ নিয়ে আওয়ামী লীগেরও পরিকল্পনা রয়েছে নিশ্চয়ই। সময়ের সাথে সাথে তা আরো হয়ত স্পষ্ট হবে।
একটি নির্বাচিত সরকারকে এভাবে আল্টিমেটাম দিয়ে পতন ঘটানো যায় না। মনে রাখতে হবে, এই সংসদে বিএনপিরও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তাহলে ১০ ডিসেম্বর আসলে কী হতে পারে? এই আলোচনায় যাবার আগে একটু রাজনীতির পেছনের ইতিহাসে ঘুরে আসতে চাই। মনে আছে ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিলের কথা? এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি বড় রকমের আতঙ্কের দিন ছিল।
দিনটিকে সরকার পতনের দিন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীণ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। একটি সরকারকে বলে-কয়ে দিন-তারিখ দিয়ে ফেলে দেওয়া অকল্পনীয়! কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেই অকল্পনীয় ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। এখন নতুন করে সেই অকল্পনীয় ঘোষণা দিতে শুরু করছেন বিএনপি নেতারা।
২০০৪ সালের এপ্রিলের শুরুর দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল জলিল ঘোষণা দেন- ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন ঘটবে। আবদুল জলিল বলেছিলেন, এমন ট্রাম্পকার্ড তার কাছে আছে, যার প্রয়োগে সরকারের পতন হবেই।
জলিলের কাছে কী ট্রাম্পকার্ড আছে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই সেদিন দলের সাধারণ সম্পাদকের দিন-ক্ষণ দিয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার এ ঘোষণা পছন্দ করেননি। যে কারণে ট্রাম্পকার্ড তত্ত্বের পরেও আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত সরকার পতনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২০০৪-এর ৭ ও ৮ এপ্রিল দুই দিনের হরতাল ডাকে। ১৫ এপ্রিল জেলায় জেলায় ‘গণঅনাস্থা মানবপ্রাচীর’ কর্মসূচি পালন করা হয়। ২১ এপ্রিল পালন করা হয় ‘হাওয়া ভবন’ ঘেরাও কর্মসূচি। ২৫ এপ্রিল সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে স্মারকলিপি দেন বিরোধী দলের সদস্যরা। ওই দিনই আওয়ামী লীগ অনাস্থা কর্মসূচি পালন শুরু করে।
৩০ এপ্রিলের দুই দিন আগে ২৮ এপ্রিল থেকে আওয়ামী লীগ দুই দিনের হরতাল পালন করে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বহাল থাকে। সেদিন ঢাকায় বা দেশের কোথাও বড় কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়নি। জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। বিকালে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়! এবার বিএনপি ব্যর্থ হলে হয়ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এভাবে ক্ষমা চাইতে বলা হতে পারে।
এরপর সেই আলটিমেটামের কারণ, ট্রাম্পকার্ডই বা কী- সেসব কথা গণমাধ্যমকর্মীরা অনেকবার জানার চেষ্টা করেছেন। প্রতিবারই আবদুল জলিল দাবি করেছেন- ৩০ এপ্রিল ছিল মিডিয়ার সৃষ্টি। তবে বিক্ষিপ্তভাবে তিনি এ নিয়ে কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাসহ সবার তথ্য জোড়া দিলে ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়ায়- এর নেপথ্যে ছিল একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সেই ট্রাম্পকার্ডের দুটি অংশ ছিল। প্রথমত, সারা দেশ থেকে লাখ লাখ কর্মী ঢাকা এসে রাজপথে অবস্থান নেবেন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান চলবে। দ্বিতীয় অংশ ছিল, সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব। বিএনপির সিংহভাগ সংসদ সদস্যও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন। এজন্য তাদের সঙ্গেও আঁতাত হয়েছিল। যেসব সংসদ সদস্য অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন বলে প্রাথমিকভাবে সায় দিয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন প্রয়াত আবু হেনা।
যাই হোক, সেই উন্নয়ন সংস্থার চাকরিজীবীরা শেষ পর্যন্ত রাজপথ দখল করতে চাননি বা পারেননি। ৩০ এপ্রিল তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর বিএনপির সংসদ সদস্যরাও বেগম জিয়ার সামনে বিদ্রোহের বীরত্ব দেখাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত আবদুল জলিলের ট্রাম্পকার্ড এক রাজনৈতিক কৌতুকে পরিণত হয়। অথচ এটি যদি সফল হতো তাহলে হয়তো আবদুল জলিলের রাজনৈতিক পরিণতি অন্যরকম হতে পারত।
সেদিনের সেই ব্যর্থতা থেকে আমাদের রাজনীতকরা কিছু শিখেছেন বলে মনে হয় না। না হলে ১০ ডিসেম্বরের ঘোষণা তারা দিতেন না। অনেকের ধারণা দেশে আবারো রাজনৈতিক হানাহানি, ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, অশান্তি আসন্ন। আবারো কী তাহলে হরতাল অবরোধের দিকে যাচ্ছে দেশ? না কি ১০ তারিখ বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশে খালেদা জিয়াকে হাজির করার নামে গুলশানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেই ধাক্কাধাক্কির চিত্র দেখা যাবে?
সংঘাত আর সংঘর্ষের পর সরকার পতনে বিএনপি কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। বিএনপির কী মনে আছে খালেদা জিয়াকে কোন কোন শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে? যেসব শর্তে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বাসায় রয়েছেন- সেসব শর্তের অন্যতম হলো তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না বা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবেন না। অপরটি হলো তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। তাই আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে ইচ্ছা করলেও বিএনপি খালেদা জিয়াকে ১০ ডিসেম্বর বাসা থেকে বের করতে পারবে না।
আরেকটি বাস্তবতা হলো গেল ১৪ বছর দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের কী কোনো ব্যর্থতা নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু এই সময়ে দেশে যে কয়টি হরতাল হয়েছে এর একটিও কি সফল হয়েছে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতিসহ নাগরিক নানা সংকটের প্রতিবাদে সম্প্রতি বাম জোটের হরতালে দেশে এক সেকেন্ডের জন্যও কোনো প্রভাব পড়েনি। তাছাড়া বিএনপি কি তাদের রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে অবগত নয়। এ রকম হাস্যকর কথা বলা মানেই হলো নিজেদের অবস্থান আরো খাটো করা। দলটির ১৪ বছরের হুঙ্কার তো সবই বানের পানিতে ভেসে যাওয়ার বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
৯০ দশকের শেষ দিকেও দেখেছি সপ্তাহব্যাপী মাইকিং করে হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। আওয়ামী লীগের ৯৬ সালের অসহযোগ আন্দোলনের কথা মনে আছে। ধারাবাহিক এই আন্দোলনের কারণে মানুষের কী অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছিল তা ভুলে যাবার নয়। এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের কোনো সুযোগ নেই। যখন করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি টালমাটাল। আগামী বছর দুনিয়াজুড়ে খাদ্যসহ মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। জীবন চালানোর যুদ্ধে যখন সবাই অবতীর্ণ তখন হুঙ্কার বা আল্টিমেটামের ধারাবাহিক কঠোর আন্দোলন জমানো অনেক কঠিন।
তাছাড়া বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের আল্টিমেটামের পেছনে কোনো এনজিও বা গার্মেন্টস সেক্টরের কেউ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা তাদের সংসদ নেতার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনবেন এটা আকাশ কুসুম কল্পনা। বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া বা জনবল দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহায়তা করা বিদেশী কূটনীতিকদের কাজ নয়। সব মিলিয়ে নিছক রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানোর প্রয়োজনেই হয়ত বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান ১০ ডিসেম্বরের টাম্পকার্ড ছেড়েছেন। গত ৮ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। এর বাইরে দেশ চলবে না কারও কথায়।’ এরপর থেকেই বিষয়টি রাজনীতিতে মূল আলোচনায় স্থান পায়।
পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদও পাল্টা কড়া বার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘আমানউল্লাহ আমান স্বপ্নে দেখেছেন যে ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। আমানের জানা উচিত, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রয়েছে শেখ হাসিনার বদন্যতায়। সেটা তারা ভুলে গেলে সরকার আবারও ভাববে, খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে পাঠানো উচিত কিনা।’
হয়তো আমানের আল্টিমেটামও আব্দুল জলিলের আল্টিমেটামে রূপ নেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো কঠোর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন আশা করে লাভ নেই। তেমনি রাজপথে সহিংস কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি মানুষ প্রত্যাশা করে না। সর্বোপরী সবারই জীবনের মায়া আছে। এসব বিবেচনায় নির্বাচনেই হলো ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি আদায় ও নির্বাচনে অংশ নেওয়াই হয়ত উত্তম গণতান্ত্রিক পক্রিয়া। তাহলে বাংলাদেশ নতুন করে সংকটের মুখে পড়বে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
/তারা/