ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২৩ ১৪৩১

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আলোচনায় মনে পড়ে ‘কিল মারার গোসাই’র কথা

প্রভাষ আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৩ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ১৩:২০, ১৩ অক্টোবর ২০২২
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আলোচনায় মনে পড়ে ‘কিল মারার গোসাই’র কথা

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১ থেকে ২০০৬-এর শাসনামল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ধকার এক সময়। অন্যসব দুঃশাসনের কথা বাদ দিলেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে আক্ষরিক অর্থেই সময়টিকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ বলা যায়।

বিদ্যুৎ নিয়ে তখন দেশজুড়ে হাহাকার ছিল। লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিদ্যুৎ কখন আসে সেটাই ছিল গবেষণার বিষয়। সেই আমলের শেষ দিকে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন হয়। বিক্ষুব্ধ মানুষের ওপর পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাই বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফল মেলে হাতে হাতে। ৫৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার তুলে এনেছে ২২ হাজার মেগাওয়াটে। ক্যাপটিভ পাওয়ার ধরলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ভুলতে বসা লোডশেডিঙের ভোগান্তি আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। শুধু ফিরে এসেছে বললে ভুল হবে, দাপটের সঙ্গেই ফিরে এসেছে। বেপরোয়া লোডশেডিঙে বিপর্যস্ত জনজীবন।

এটা ঠিক বিদ্যুতের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। লোডশেডিং হলে আমরা শুধু নিজেদের ভোগান্তির কথাই ভাবি। ঘরে ঘরে লাইট-ফ্যান-এসির চেয়েও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন আরো বেশি। বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, উন্নয়ন মন্থর হয়, অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে উন্নয়ন মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আর সে কারণেই তাদের প্রথম নজর ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় গতি পায় উন্নয়নের চাকা। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরকার ব্যয়ের দিকে নজর দেয়নি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায়। ক্যাপাসিটি চার্জে চলে যায় হাজার কোটি টাকা। তাই উন্নয়নে গতি এলেও চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনীতিতে উল্টো চাপ তৈরি করে। আমাদের অর্থনীতি এগুচ্ছে। তবে অবস্থা এখনও পা ঢাকলে মাথা উদোম হয়ে যায়, মাথা ঢাকলে পা।

এখন যে বিদ্যুতের জন্য দেশজুড়ে হাহাকার, তার কারণ কী? অনেকে বলছেন, এত সক্ষমতা, এত বিদ্যুৎ গেল কই? সমস্যাটা আসলে তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের পাগলা ঘোড়া হয়ে যাওয়া, জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি- সব মিলে বিদ্যুৎ খাত এলোমেলো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা এখনও ক্যাপটিভসহ প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটেই আছে। চাইলেই সরকার ঘরে ঘরে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাদের অন্য অনেক জরুরি কাজে অর্থের টান পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমাতেই সরকার ইচ্ছা করে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট তাই ইচ্ছাকৃত, অনুমিত এবং পরিকল্পিত। 

দুদিন আগে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪২০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল ১২৬৮৬ মেগাওয়াট। এই ১৫১৫ মেগাওয়াট ঘাটতিই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তবে সংকট পরিকল্পিত হলেও ভোগান্তি অপরিকল্পিত। দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতিতে যতটা সমস্যা হওয়ার কথা, সংকট তার চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান। গত ১৯ জুলাই থেকে সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে। কথা ছিল, দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। কিন্তু সরকার তাদের পরিকল্পনায় থাকতে পারেনি। এখন ঢাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টা, ঢাকায় বাইরে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। আসলে দীর্ঘদিন লোডশেডিং করতে হয়নি বলে, সরকার হয়তো লোড ম্যানেজমেন্টের বিষয়টিই ভুলে গেছে!

সরকারের আশা ছিল অক্টোবরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে ঘটনা ঘটেছে উল্টো, অক্টোবরে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সরকারের আশার উৎস ছিল প্রকৃতি। অক্টোবর নাগাদ তাপমাত্রা কমে এলে চাহিদাও কমে আসবে; এমন আশা থাকলেও প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে। তাপমাত্রা এখনও কমেনি, তাই চাহিদাও কমেনি। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ শীত এলে হয়তো পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি হবে। তবে যুদ্ধ বন্ধ না হলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে, জ্বালানী তেলের দাম না কমলে পরিস্থিতির টেকসই উন্নতি হবে না। আগামী মার্চ-এপ্রিলে আবার বিদ্যুৎ নিয়ে হাহাকার শুরু হবে।

বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব সর্বব্যাপী ও দীর্ঘমেয়াদী। বিদ্যুৎ না থাকলে ঘরে ঘরে অন্ধকার, গরমের কষ্ট তো আছেই, কমবে শিল্প উৎপাদন, সেচ বিঘ্নিত হলে ফসল উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে। বিদ্যুতের সংকট ডেকে আনবে পানির সংকট। এমনকি লোডশেডিঙের কারণে ফ্রিল্যান্সারদের আয়ও কমে যাচ্ছে। তাই একদিকে টাকা বাঁচাতে গিয়ে অন্য দিকে আয় কমে যাচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানীর আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীসহ জ্বালানীর বিকল্প উৎসে মনোযোগ দিতে হবে।

তবে বিদ্যুৎ সংকট দারুণ একটা চক্রে আবদ্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গেলে রিজার্ভে টান পড়ে, আবার কমালে সার্বিক উৎপাদনে টান পড়ে। তবে আমরা এখন নগদ অর্থ বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাগাম টেনে ধরেছি। কিন্তু সেই লাগাম যদি শিল্প ও খাদ্য উৎপাদনেও টান লাগায় তখন দীর্ঘমেয়াদে সংকট ঘনীভূত হবে। ডিজেল কেনার টাকা নেই বলে আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখছি বটে, কিন্তু লোডশেডিঙে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে। আসলেই এই লাভ-ক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখা সত্যি কঠিন।

বিদ্যুৎ নিয়ে এই যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা, তখন নতুন আলোচনা- বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। তবে বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, এবার পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হলেও, ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে না। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় আপাতত বিদ্যুতের বাড়তি দামের দায় বিতরণ সংস্থাগুলোর ওপরই থাকবে। আসলে সরকারকে বরাবরই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়। এখন বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি প্রায় ৬ টাকা আর উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ টাকা। এই ভর্তুকির বেশিরভাগই বহন করতে হয় পিডিবিকে। তাই পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে সরকার আসলে ভর্তুকিটা পিডিবি থেকে কিছুটা কমিয়ে বিতরণ সংস্থাগুলোর মধ্যে ভাগ করে দিতে চায়। তাতে চাপের মুখে পড়বে বিতরণ সংস্থাগুলো। বিতরণ সংস্থাগুলো চাইবে সেই চাপ ভোক্তার ওপর দিয়ে দিতে। তাই সরকার আপাতত ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও কতদিন সে অবস্থানে থাকতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আপাতত পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও শিগগিরই তার প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে যাবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে যখন বেসামাল পরিস্থিতি, তখন দাম বাড়ানোর এই উদ্যোগ অনেকের কাছে ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাই’ মনে হতে পারে। 

তবে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল থাকলে সরকারকে গাল দিয়েও পরিস্থিতির বদল হবে না। আমাদের সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে মনোযোগ দিতে হবে, এমনকি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও। বিদ্যুৎ অন্য সব পণ্যের মতো নয় যে, আমি টাকা থাকলেই ইচ্ছামত খরচ করবো। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে, আমার যত অর্থই থাকুক, আমি কিন্তু বিদ্যুৎ কিনছি উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে। গরিবের জন্য দেয়া ভর্তুকির সুবিধা যেন বড়লোকেরা নিতে না পারে, তার একটা উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজনে অভিজাত এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের লিমিট ঠিক করে দিতে হবে বা যত বেশি ব্যবহার, তত চড়া দামের ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তুকির সুবিধাটা যেন গরিব মানুষ, শিল্প-কারখানা, সেচে যায়। চড়া মূল্যের বিদ্যুতে সারাদিন এসি চালিয়ে রাখা, অপ্রয়োজনে লাইট জ্বালিয়ে রাখা বা আলোকসজ্জার বিলাসিতা বন্ধ করতে হবে।

১২ অক্টোবর, ২০২২ 

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়