শেখ রাসেলও হতে পারতো জাস্টিন ট্রুডো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন শেখ রাসেল। শেখ পরিবারের সকলের আদরের এই সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল দার্শনিক ও সাহিত্যিক বার্টান্ড রাসেলের নামে। রাসেল বেঁচে থাকলে হয়তো হতে পারতেন ওই রকমের উচ্চতার একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব। না কি হতেন রাজনীতিবিদ, যেমন হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুহৃদ পিয়েরে ট্রুডোর সন্তান জাস্টিন ট্রুডো। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যিনি। আমাদের স্বাধীনতার সমান বয়স উনার। বাবা পিয়েরে ট্রুডোও ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল হার্দিক সম্পর্ক।
পিয়েরে ট্রুডোর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা সদর্থক অর্থেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। এ কারণেই পিয়েরেকে দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়ক সম্মাননা।
আমাদের আলোচনা জাস্টিন ট্রুডো ও শেখ রাসেলকে নিয়ে। যার মধ্যে একজনের সম্ভাবনা বিকশিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে, আরেক জনের হয়নি। অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হয়েছে সেই সম্ভাবনা। অথচ শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে যদি হতেন জাস্টিন ট্রুডোর মতোই একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাহলে আশ্চর্য হওয়ার ছিল না। বরং সেটাই হতো সঙ্গত ও স্বাভাবিক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে করোনার কারণে স্বশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি জাস্টিন। এক ভিডিও বার্তায় অনেক কথার মাঝে এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। ‘আমার বাবা ও আপনার বাবা দুই দেশের প্রধানন্ত্রী ছিলেন, এখন আমরা প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি।’
জাস্টিনের এই কথার সূত্র ধরেই বলা যায় রাসেল বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো প্রধানমন্ত্রী হতেন আজ কিংবা আগামীকালের বাংলাদেশের। কিংবা হতেন অন্যকিছু, যার বিনিময়ে কিংবা অবদানে উপকৃত হতো দেশ-জাতি ও সভ্যতা। বেদনার হলো রাসেলকে এসবের কিছুই হতে দেওয়া হয়নি। বর্বর ঘাতকরা রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে কেবল একজন কিশোরকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে বহুমাত্রিক এক সম্ভবনা। রুদ্ধ করেছে একজন বার্টান্ড রাসেল কিংবা একজন জাস্টিন ট্রুডো হওয়ার পথ।
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তান-দুই মেয়ে তিন পুত্র। কন্যাদ্বয়ের নাম রেখেছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আর পুত্রত্রয়ীর নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। রাসেলের যখন জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, তখন প্রকৃতিতে হেমন্তকাল। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে উঠছে সোনার ধান। দেশীয় এই বাস্তবতার বিপরীতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই দশক পূর্ণ হওয়ার ক্ষণ। যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কা-ভয় আর সমূহ সর্বনাশ ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা-প্রাণনাশের ঝুঁকি দূর হয়নি তখনও। যে কোনো সময় লেগে যেতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ। সেসবের লক্ষণে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত ছিল বিশ্ব। যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে নতুন করে যুদ্ধ যেনো না লাগে এই লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী যারা শক্তভাবে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন তাদের অন্যতম হলেন নোবেলজয়ী দার্শনিক-সাহিত্যিক বার্টান্ড রাসেল। বিশ্বশান্তির পক্ষে তার এবং তাদের এই অবস্থান যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনেতা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সে লক্ষ্য থেকে সরে আসতে বাধ্য করে, বিরত রাখে। সেই কারণে বঙ্গবন্ধু প্রিয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন বার্টান্ড রাসেলের নামানুসারে- শেখ রাসেল।
আমাদের জন্য বেদনার বিষয় হলো, যে রাসেলের নাম রাখা হলো যুদ্ধের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণকারী সাহিত্যিক-দার্শনিক রাসেলের নামে, সেই রাসেলকে মাত্র ১১ বছর বয়সে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ১৫ আগস্টেরা কালো রাত্রে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পাশাপাশি সেই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাসভবনে অবস্থানরত পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করে। এমনকি শেখ রাসেলকেও।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে উদ্যত হয়েছিলেন ঠিক ঐ মুহূর্তে হাবিলদার মুসলেহউদ্দিন তাঁকে তাক করে ব্রাশ ফায়ার করে। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত বঙ্গবন্ধুর দেহ তক্ষুণি সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়ে। অতঃপর দু’জন মেজর ও হাবিলদার মোসলেহউদ্দিন আমার শাশুড়িসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এক এক করে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। এরই এক ফাঁকে রাসেল দৌড়ে নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো বাড়ীর কাজের লোকজনদের নিকট আশ্রয় নেয়। তাকে দীর্ঘকাল যাবত দেখাশুনার ছেলে আব্দুর রহমান রমা তখন রাসেলের হাত ধরে রেখেছিল। একটু পরেই একজন সৈন্য রাসেলকে বাড়ীর বাইরে পাঠানোর জন্য রমার কাছ থেকে তাঁকে নিয়ে নেয়। রাসেল তখন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আল্লাহর দোহাই, আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকবো। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে হাসু আপা ও দুলাভাই-এর কাছে পাঠিয়ে দিন।’ তখন উক্ত সৈন্যটি রাসেলকে বাড়ীর গেটস্থ সেন্ট্রিবক্সে লুকিয়ে রাখে। এর প্রায় আধঘণ্টা পর একজন মেজর সেখানে রাসেলকে দেখতে পেয়ে তাঁকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে তার (রাসেলের) মাথায় রিভলবারের গুলীতে।’’
এই বর্ণনায় স্পষ্ট হয় খুনীরা কতোটা পিশাচ ও বর্বর ছিলেন। একজন শিশুর কান্নাও তাদের বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি; খুন যেন তাদের নেশা। এবং খুন করায় ছিল তাদের প্রধান কাজ। আমরা জানি বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগমন থামিয়ে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও চার স্তম্ভ থেকে দেশকে সরিয়ে নেওয়া। এবং পাকিস্তানী কায়দায় দেশ শাসনের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অর্জনসমূহকে ভূলণ্ঠিত করা।
অন্যদিকে, রাসেলকে খুন করার পেছনে খুনীদের উদ্দেশ্য ছিল বিকাশমান ও সম্ভাবনাময় এক কিশোরের বহুমাত্রিক ভবিষ্যতকে রুদ্ধ ও নিশ্চিহ্ন করা। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সকল শিশুর অন্তরে।’ এই কথার মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট করে বলা হয় যে, সকল শিশুর মধ্যেই রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। একজন বয়স্ক ও পরিণত বয়সের ব্যক্তির পক্ষে যা হওয়া সম্ভব তার সবটাই উন্মোচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। কিন্তু একজন শিশু বা কিশোর ভবিষ্যতে কী হবেন-কী হতে পারেন, তার সবটাই অধরা থেকে যায় তার সম্ভাবনা ও বিকাশের মধ্যে। এ কারণেই আমরা বলছি শেখ রাসেল বহুমাত্রিক এক সম্ভাবনার নাম, আমরা বলছি শেখ রাসেলও হয়তো হতে পারতো জাস্টিন ট্রুডো।
শেখ রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সন্তান। এ কারণে তার সম্ভাবনা ও বিকাশের পক্ষে আরও প্রত্যয় রাখা যায়। বঙ্গবন্ধু কেবলই একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা তিনটি বইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে। লেখকমাত্রই সংবেদনশীল মনের হন। আর সেই লেখক যদি বঙ্গবন্ধু স্বয়ং হন তাহলে তাঁর সংবেদনশীলতার মাত্রা কেমন ও কোন উচ্চতার হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ কারণে আমাদের পক্ষে অনুমান করতে মোটেই কষ্ট হয় না যে, রাসেল বেঁচে থাকলে সত্যিই একজন বড় মাপের প্রতিভার অধিকারী হতেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের শোণিত ধারা যার সত্তায় প্রবহমান তিনি জগজ্জয়ী এক ব্যক্তিত্বে পরিগণিত হবেন এটাই স্বাভাবিক; যুক্তিযুক্তও বটে। বঙ্গবন্ধুর রাসেলের প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা ও স্নেহ।
১১ বছরের আয়ুষ্কাল পাওয়া রাসেল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তার অর্ধেকটা সময়। এমনকি রাসেল যখন জন্মগ্রহণ করেন এ পৃথিবীর আলো হাওয়ায়, ঠিক সেইসময়ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে অন্তরীণ। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
এক. ‘‘সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল- চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’’ (পৃষ্ঠা: ৯৩)
দুই. ‘‘জেলগেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্য হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।’’ রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’’ (পৃষ্ঠা: ২২১)
তিন. ‘‘পাঁচটায় আবার গেটে যেতে হলো। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম, সংগ্রাম- চলবে চলবে- পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ও শিখলো কোথা থেকে?’’ রেণু বলল, ‘‘বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।’’ বললাম, ‘‘আব্বা আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করুক।’’ (পৃষ্ঠা ২৪৬-২৪৭)
চার. ‘‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘‘আব্বা বালি চলো’’। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আবার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যায় বাড়িতে।’’ (পৃষ্ঠা: ২৪৯)
সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসা কেমন হয়, হওয়া উচিৎ, হতে পারে তার এক বিশ্বস্ত দলিল বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’। রাসেলের জন্য বঙ্গবন্ধুর মন কীভাবে পুড়েছে-কতোটা বেদনার্ত হয়েছে তার সাক্ষ্য দেয় এই বই। এবং বঙ্গবন্ধুর এর সবটাই করেছেন পাকিস্তানের অন্যায় শাসন- শোষণ-বঞ্চনা ও নিগ্রহ থেকে এই দেশ-জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে-এই ভূখন্ডের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করার অভিপ্রায়ে।
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গান তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘‘কবিগুরু তুমি বলেছিলে- ‘সাতকোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরু তুমি দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হয়তো স্বপ্ন দেখতেন তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলও কবিগুরুর মতো জগৎ জোড়া খ্যাতির অধিকারী হবেন। বিজ্ঞানী হলে হবেন নিউটন আইনস্টাইনের মতো; কবি হলে হবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা শেলী, কীটস, গ্যেটের মতো; দার্শনিক হলে বার্টান্ড রাসেলের মতো; রাজনীতিবিদ হলে বাবার মতো কিংবা মহাত্মা গান্ধী-পিয়েরে ট্রুডোর মতো। নিশ্চয় অজস্র স্বপ্ন খেলা করতো পিতার স্বপ্নের জমিনে।
কিন্তু সেসবের কিছুই হতে দেয়নি ঘাতকেরা। ওরা শেখ রাসেলের জীবন ঘড়ির কাঁটা ১১বছরে এসে থমকে দিয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে মৃত্যু কেবল শেখ রাসেলের হয়নি, মৃত্যু হয়েছে অগনণ-অজস্র সম্ভাবনারও। যা রুদ্ধ করে দিয়েছে একবিংশ শতাব্দীর একজন রাষ্ট্রনায়ক-রাজনীতিবিদ-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সম্পাদক-অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী-অর্থনীতিবিদ-কূটনীতিক-দার্শনিক-বিজ্ঞানী হওয়ার সকল পথ। হত্যাকারীরা একটা নূতন সকাল উদিত হওয়ার প্রত্যাশিত স্বপ্নকে ট্রিগার টিপে যেমন হত্যা করেছে, ঠিক তেমনি আমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশকে একজন শিশুর অনিরাপদ বাসযোগ্য হিসেবে বিশ্বে উপস্থাপন করেছে-যা শুধু নিন্দনীয় নয়, ক্ষমারও অযোগ্য।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক
/তারা/