ইরান: রেভল্যুশন অফ দি ওমেন, বাই দি ওমেন অ্যান্ড ফর দি ওমেন
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বহু আগে ষোড়শ মার্কিনী রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন (মার্চ ৪, ১৮৬১-এপ্রিল ১৫, ১৮৬৫) বলেছিলেন ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার এবং জনগণের জন্য গঠিত সরকার।’
তারপর পৃথিবীতে দেড়শো বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। আর গত এক মাস ধরে পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিপ্লব সঙ্ঘটিত হচ্ছে যে বিপ্লবের অগ্রভাগে মূল সেনানী হিসেবে মার্চ পাস্ট করছে ইরানের মেয়েরা। তাদের সমর্থনে সেই বিক্ষোভে-প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে সেদেশের পুরুষেরা। মানবেতিহাসে এর আগে ফরাসি বিপ্লব বা রুশ বিপ্লবের মত বড় বিপ্লবগুলোয় মেয়েরাও পথে নেমেছে বা শ্লোগান দিয়েছে, তবে সেই বিপ্লবের পুরোভাগে ছিল পুরুষ। মেয়েরা ছিল ছেলেদের সহায়ক শক্তি। আর বিপ্লবের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবেও আমরা এর আগে সবসময়ই দেখেছি পুরুষদেরই নেতৃত্ব দিতে; সেটা ফরাসি বিপ্লবের জাঁ জাঁক রুশো বা ভলতেয়ার, রুশ বিপ্লবের লেনিন-স্ট্যালিন-ট্রটস্কি, চীন বিপ্লবের মাও সে তুং বা ভিয়েতনাম বিপ্লবের হো চি মিন কি কিউবান বিপ্লবের ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারাসহ যে বা যাঁরাই হোন না কেন!
কিন্তু এবার ইরানে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর থেকে গত ৩২ দিন ধরে সেদেশে যে অব্যাহত বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছে এবং পরিস্থিতি দেখে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই বিক্ষোভ-আন্দোলন দ্রুতই একটি ‘বিপ্লবে‘ রূপ পেতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন, নারীরা সেই ‘বিপ্লবে‘র শুধু পথসেনাই নন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী ‘ভয়েস অব আমেরিকা-ফার্সি‘ বিভাগের অগ্নিক্ষরা নারী সাংবাদিক মসীহ আলীনেজাদ বা ইয়াসমীন মাহমুদের মত প্রবাসী ইরানী নারীবাদীরা অন্তর্জালেই এই বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন পৃথিবীর সব দেশে।
এক মসীহ আলীনেজাদের ফেসবুক পেজ থেকেই গত ৩২ দিন ধরে এই গ্রহের সব সচেতন, কৌতূহলী মানুষ রাজধানী তেহরান থেকে শুরু করে ইরানের প্রতিটি ছোট-বড় শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের আগুন, গত একমাসে সেদেশে আহত-নিহত প্রতিটি শিশু-কিশোর-তরুণ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধার রক্তাক্ত সচিত্র ছবি, ভিডিও ফুটেজ, সরকারী বাহিনীর দমন-পীড়নের নানা ছবি দেখছে রুদ্ধ বিস্ময়ে। আমরা দেখছি ইরানের হাই স্কুলের মেয়েরা কীভাবে পাঠ্যপুস্তক থেকে সেদেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ছবি ছিঁড়ে ও আগুন ধরিয়ে স্কুল থেকে কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কীভাবে তেহরানের ওভারব্রিজ থেকে সাহসী ইরানী তরুণীরা খোমেনীর ছবি ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে বা রাস্তায় আবর্জনার বাক্সের উপর দাঁড়িয়ে মাথার হিজাব খুলে প্রতিবাদ করায় কোন্ ষোড়শীকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করছে সেদেশের পুলিশ, কোন্ গায়ক কারারুদ্ধ হচ্ছেন! আর প্রতিটি বিপ্লবের মতই ইরানের চলমান এই বিপ্লবেও অশ্রু-অগ্নির আল্পনায়, সঙ্গীত-নৃত্য-পথ নাটকের মিথস্ক্রিয়ায় অসম্ভব সুন্দর সব দৃশ্যের জন্ম হয়েছে বা হচ্ছে।
মাহসা আমিনীর ছবি হাতে রাজপথে নারীর বিক্ষোভ
এক বোন পারুলের ডাকে পথে নামে যখন সাত ভাই চম্পা!
ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘সিয়াসাত ডেইলী‘-তে গত ১৬ই অক্টোবর প্রতিবেদক সাকিনা ফাতিমা ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল‘-এর একটি সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে জানচ্ছেন যে ১৬ সেপ্টেম্বার মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর থেকে দেশব্যপী বিক্ষোভ-সমাবেশে পুলিশী হামলায় অন্তত ২৩ জন ১১-১৭ বছর বয়সী বালক-বালিকা নিহত হয়েছে যাদের ভেতর দু‘জনকে খুবই ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করা হয়। ইরানে গত এক মাসের বিক্ষোভে এ পর্যন্ত নিহত ২০১ জন প্রতিবাদকারীর ভেতর শিশুদের হার ১৬ শতাংশ। তবে এই ২৩ জনের ভেতর ২০ জনই বালক ও তিনজন বালিকা। বালিকারা মূলত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রবলভাবে প্রহৃত হয়ে মারা গেছে এবং নাবালক ছেলেরা গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ‘এ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনাল ইরান’-এর মতে, এই বালকদের অর্দ্ধেক মুসলিম হলেও তারা সংখ্যালঘু নানা জাতিসত্ত্বা যেমন কুর্দি বা বালুচদের সন্তান। মোট ২৩ জন কিশোর-কিশোরীর ভেতর ১০ জন মারা গেছে সিস্তান-বালুচিস্থান প্রদেশে, পাঁচ জন তেহরানে, চারজন পশ্চিম আজারবাইজানে এবং আলব্রোজ, কেরমানশাহ, কোহকিলুয়েহ, বয়ের আহমাদ এবং জানজান প্রদেশে একজন করে শিশু বিক্ষোভকারী মারা গেছে।
এই ২৩জন শিশুর অর্ধেকসংখ্যকই মারা যায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর বা ‘কালো শুক্রবারে‘ বিক্ষোভকারীদের জমায়েতে সরকারী পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার গুলী বর্ষণের কারণে। এমন নির্বিচার শিশু হত্যার পরও বিশ্ব সম্প্রদায় একরকম মৌনব্রত পালন করছেন বলে ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল‘-এর ‘মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা‘র আঞ্চলিক পরিচালক হেবা মোরায়েফ বলেন যে ‘এই শিশুদের পিতা-মাতার চোখের দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে চাইবেন? তাদের মাথা কি লজ্জায় নত হবে না?‘
ইতোমধ্যেই জাতিসঙ্ঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ‘ অবশ্য ইরাণে ‘শিশু ও কিশোরদের উপর সঙ্ঘটিত খুন, জখম ও গ্রেপ্তারে‘র ঘটনাগুলোয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবিসি ফার্সি সার্ভিসের একাধিক ভিডিও ফুটেজে ট্রাকে বসা ইরানী পুলিশ জনতার দিকে গুলি ছুঁড়ছে বা কুর্দিস্থানের বানেহতে গাড়ি ধাওয়া করছে বিক্ষোভরত জনতাকে- এমন সব দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে।
যদিও মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর শুরুতে সবাই ভেবেছিল যে দু/তিন দিন কি সর্বোচ্চ সপ্তাহখানেকের বিক্ষোভের পরই ইরানী সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে অতীতের মত দ্রুতই সব স্তব্ধ হয়ে যাবে, কার্যত: এবার সেটা হচ্ছে না। ফরাসি বিপ্লবের সেই অমোঘ ত্রয়ী শব্দ ‘লিবার্তে-ফ্রাতের্নিতে-ইগালিতে‘ বা ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা‘র মতই ইরানের নারী-পুরুষ আজ ‘জান-জিন্দেগী-আজাদি (নারী-জীবন-স্বাধীণতা)‘ শব্দত্রয়কে ঠোঁটে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে লড়াইয়ে। সেই সাথে ‘ডেথ টু দ্য ডিক্টেটর‘ বা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক!‘ শ্লোগানটিও ব্যবহৃত হচ্ছে হরদম। ইরানী কর্তৃপক্ষ অন্তর্জাল অভিগম্যতা কমিয়ে দিতে চাইলেও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ প্রজন্ম টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে তাঁদের সব জরুরি বার্তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। সত্যি বলতে সেই ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে অদ্যাবধি ইরানের ধর্মতান্ত্রিক সরকার আজকের মত বিপদে পড়েনি বলেই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন।
চুল কেটে নারীর প্রতিবাদ
দুই নিহত কিশোরী যখন ইরানী বিক্ষোভ-বিদ্রোহের নয়া প্রতিভূ
গত ১৩ অক্টোবর ‘নিউইয়র্ক টাইমস‘ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইরানী বংশোদ্ভুত সাংবাদিক ফারনাজ ফাসিহি আরো জানাচ্ছেন যে কীভাবে ইরানী কিশোরেরা রক্ত ঝরালেও মাহসার পর সরকার বিরোধী বিক্ষোভে দুই কিশোরীর মৃত্যু গোটা দেশকে আরো অগ্নিগর্ভ করে তুলছে! কুড়ি জন চম্পা ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিলেও তিন পারুল বোনের মৃত্যু গোলাপ ও কবিতার দেশ ইরাণ কিছুতেই মানছে না।
সেপ্টেম্বরে মাহসার মৃত্যুর পর গোটা ইরান যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, প্রতিটি ছোট-বড় শহরে যখন মেয়েরা তাদের মাথার স্কার্ফ আগুনে ছুঁড়ে মারছে, তখন দুই ইরানী কিশোরী ঘর ছেড়ে বিক্ষোভে অংশ নিতে চলে যায়। চলে যাবার পর তারা আর ফেরেনি। একটি মেয়ের পরিবার দশ দিন ধরে তাদের কন্যাকে পাগলের মত খুঁজেও না পেয়ে তাদের সন্ধান দেবার জন্য সামাজিক মাধ্যমে আকুল আবেদন জানাতে থাকে। অন্য একটি পরিবার অবশ্য তাদের মেয়ে বিক্ষোভে জমা দেবার কয়েক ঘণ্টার পরই তার করুণ পরিণতি জানতে পারে। তবে দু‘জনের ভাগ্যই ছিল সেই একই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ। একটি মেয়ের মাথার খুলি থেঁতলে গেছে এবং অন্য মেয়েটির মাথা লাঠির আঘাতে ফেটে গেছে। ক্ষত-বিক্ষত এবং ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দুই ষোড়শীর মরদেহ পরে তাদের পরিবারকে ফেরত দেয়া হয়। এই দুই ষোড়শী হলো নিকা শাকারামি এবং সারিনা ইসমাইলজাদেহ। ২০০৯ সালের পরে অবধি আজ পর্যন্ত ইরানে চলমান সবচেয়ে বড় নাগরিক বিক্ষোভে আজ প্রতিটি মিছিলে এই দুই কিশোরীর ছবি ব্যানারে শোভিত হচ্ছে, ইরানের শহরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে তাদের ছবি দেখা যাচ্ছে এবং ইরানের মোল্লাশাহীর বিরুদ্ধে প্রতিটি মিছিলের শ্লোগানে ওদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে।
নিরাপত্তা বাহিনী শুধু নিকার মাথার খুলিই থেঁতলে দেয়নি, ওর দাঁত ও চোয়ালের হাড় ভেঙেছে বলেও নিকার মা জানান। সারিনাকে পুলিশ পিটাতে পিটাতে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলায় তার মাথা ভেঙে যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে সরকার দাবি করে যে এই দুই কিশোরীই ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে এবং কিশোরীদের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় টিভিতে এই সরকারী বয়ান বলতে বাধ্য হয়, তবে তাদের আত্মীয়রা জানান যে জেল-জুলুমের হুমকি দিয়ে একথা তাঁদের দিয়ে বলানো হয়েছে। বাস্তব জীবনে নিকা ও সারিনা ছিল দুই সুখী কিশোরী যারা গান গাইতো এবং নাচতো, বন্ধুদের সাথে মজা করতো, শপিং মলে ঘুরতো এবং সেলফি তুলতে ভালবাসতো। ওদের মৃত্যু আজ সেদেশের মোল্লাতন্ত্রের সাথে মুখোমুখি করে দিয়েছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে। এই নতুন প্রজন্ম অন্তর্জাল প্রিয় এবং পূর্বতন প্রজন্মের মত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদে আচ্ছন্ন নয়। কর্তৃপক্ষ ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে এবং সন্ত্রাস চালিয়ে এই তরুণদের কণ্ঠরোধ করতে চাইলেও লাভ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইস্কুল অবধি প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। হাই স্কুলের মেয়েরা শুধু হিজাব খুলে এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ছবি ছিঁড়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা গণমানুষের কাছে ভয়ের আর এক নাম বাসিজি মিলিশিয়া বাহিনীর উপস্থিতিতেই এক অতিথি বক্তাকে স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
ইরানী রেভল্যুশনারী গার্ডসের ডেপুটি কম্যান্ডার ইন চীফ আলী ফাদাভি গত সপ্তাহে জানান যে জেলে বন্দী বিক্ষোভকারীদের গড় বয়স হলো ১৫। সেদেশের শিক্ষামন্ত্রী ইউসেফ নূরীর মতে, গ্রেপ্তারকৃত স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের ‘মনস্তাত্ত্বিক আরোগ্য কেন্দ্রগুলোয় নেয়া হচ্ছে শিক্ষা ও আচরণগত সংস্কারের জন্য।’
ইরানে চলমান বিক্ষোভের প্রধান দিক
১. নারী পরিচালিত বিদ্রোহ: এই বিদ্রোহের মুখ্যভাগে রয়েছে মেয়েরা। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় বা হাই স্কুলের মেয়েরা পুরোভাগে ছিল। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চা মেয়েরাও ‘জান-জিন্দেগী-আজাদি‘ বলে পথে নামছে।
২. রেভল্যুশনারী গার্ডস: ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ‘রেভলুশ্যনারী গার্ডস‘ ইরাণের বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও ক্ষমতা কাঠামোর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। এবং এই ক্ষমতা কাঠামো ভেঙ্গে পড়লে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কাজেই জনতার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান অত্যন্ত মারমুখী।
৩. অর্থনৈতিক হতাশা বা নৈরাশ্য: যদিও সাধারণ ইরাণী জনতার বঞ্চণা নানামুখী, তবে ইরাণের বর্তমান অর্থনৈতিক দূরবস্থাও এই প্রতিবাদের অন্যতম সুপ্ত চালিকাশক্তি। ইরাণের তেল-সেক্টরের শ্রমিকেরা এই বিক্ষোভে যোগ দিলে অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ হবে।
৪. কুর্দিদের উপর হামলা: দীর্ঘদিন ধরে ফার্সি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে কূর্দি সংখ্যালঘুরা নানা বঞ্চণার পর তাদেরই মেয়ে মাহসার মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। আর এই অজুহাতে ইরাণী রাষ্ট্রীয় বাহিনীও তাদের উপর প্রবলতর করছে আক্রমণ।
মুখমণ্ডলে লাল রঙে আঁকা হাতের ছাপ
এদিকে ১২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘গ্রিড‘-এ এই পত্রিকার বৈশ্বিক নিরাপত্তা প্রতিবেদক জশুয়া কিটিং ঠিক কতটা বিড়ম্বনা ও বিপদের ভেতর ইরানী সরকার আছে তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। জশুয়া তাঁর প্রবন্ধ শুরুই করেছেন তেহরাণের শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সদ্য উত্থাপিত একটি শ্লোগান দিয়ে, ‘আমাদের প্রতিবাদকে আর প্রতিবাদ বলো না/একে বিপ্লব বলো।’
ইরানে কিন্তু এর আগেও গণ-বিক্ষোভ হয়েছে। ২০০৯ বা ২০১৯-এর বিক্ষোভগুলোতেও প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছেন। তবু মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর এই বিক্ষোভ একদম ভিন্ন মাত্রার এই কারনে যে ঠিক যেন ঢেউয়ের মত নানা গোষ্ঠী এই আন্দোলনে একত্রিত হচ্ছে। কোন নির্দিষ্ট নেতা বা নেতৃত্বহীন এই আন্দোলন একদমই তরুণ-তরুণীদের আন্দোলন এবং তরুণীরাই লড়াইয়ের অগ্রভাগে রয়েছেন। ইতোমধ্যে ডজন ডজন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে জাতিগত ও শ্রেণীগত সব বৈষম্য ঘুঁচে গিয়ে সবাই একসাথে মিছিলে সামিল হচ্ছেন। সবচেয়ে অভিজাত স্কুলের ছাত্ররা থেকে তেল শোধনাগারের শ্রমিকেরা এই আন্দোলনে একাত্ম। আর এই সব বিক্ষোভকারীর ভেতরেই ক্ষমতাসীন দল ও তার প্রধান মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ খোমেনীর প্রতি প্রবল রাগ জমা হয়ে আছে।
‘কোনো নির্দিষ্ট বঞ্চনা নয়। বিক্ষোভকারীরা তাক করেছে খোদ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের হৃদয়যন্ত্রেই,’ বলেন ‘সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ইন ইরান‘-এর পরিচালক হাদি ঘায়েমি। মনে রাখতে হবে যে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক সেই সময়ে যখন ইরান ভুগছে অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি, নানা ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা এবং পুরনো আয়াতুল্লাহর বিদায়ের পর নতুন আয়াতুল্লাহর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগের মধ্যবর্তী সমেয়র সঙ্কটে।
১৭ সেপ্টেম্বর মাহসা আমিনীর জানাজা বা শেষকৃত্যের পরই তাঁর জন্মশহর সাকেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে!‘ মেয়েদের নানা বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ এবং বাসজি বা সরকারী মিলিশিয়া বাহিনী চালালো উন্মত্ত বর্বরতা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনী দক্ষিণ-পূর্বের শহর জাহেদানে বিক্ষোভরত জনতার উপর গুলি চালিয়ে একদিনে ৬৬ জন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে। বেশ কিছু নিহত কিশোর-কিশোরীর পরিবারকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার জন্য চাপ দেয়া হয়। শেরভিন হাজিপুর যিনি কিনা ‘বারায়ে আজাদি‘ নামে প্রতিবাদী গানের রচয়িতা, তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন এবং জাতীয় ফুটবল দলের কয়েকজন খেলোয়াড়কেও জেলে নেওয়া হয়।
মাহসা হত্যার দুই সপ্তাহ পর খোমেনী প্রতিবাদী জনতার উদ্দেশ্যে ৩রা অক্টোবর বক্তব্য দিলেও ততদিনে সরকারী দমন-পীড়নে মানুষের ক্রোধ হয়েছে দ্বিগুণ। তবে মাহসার মৃত্যু খড়ের স্তূপে দেশলাই ছুঁড়ে দিলেও গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক দুর্দশা, করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নামের কেরোসিন আগেই এই খড়ের গাদায় ধরানো ছিল। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল নাগাদ দেশটির জিডিপি প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়। গত বছর থেকে প্রবৃদ্ধির হার পুনরুদ্ধার হওয়া শুরু হলেও মুদ্রাস্ফীতি একটি প্রবল সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে এবং গত বছরের তুলনায় এবছর খাদ্য কিনতে ইরানীদের ৭৫ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। রাস্তার বিক্ষোভগুলোয় তাই শুধু মধ্যবিত্ত ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, কিছু তেল এবং পেট্রো-কেমিক্যাল প্ল্যান্টের শ্রমিকেরাও যোগ দিচ্ছে। এদের ভেতর রয়েছে প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ‘আবাদান অয়েল রিফাইনারী‘র শ্রমিকেরাও যারা ১৯৭৮ সালে শাহ সরকারের পতনের আগে ধর্মঘট ডেকেছিল। এছাড়াও গতবছর দেশটি বজ্রবৃষ্টি, খরা ও তাপপ্রদাহের ভেতর দিয়ে গেলেও সরকার সেসব ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি বলেও বিক্ষোভকারীরা জানায়। দেশটির নানা জায়গায় পানীয় জলের সঙ্কটের কারণে গত বছর যেমন ইস্পাহান শহরে দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল।
ইরানের জাতিগত সমস্যা
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে মাহসা আমিনী ছিল ইরানের মুসলিম, তবে ভাষিক সংখ্যালঘু কুর্দি জনগোষ্ঠীর মেয়ে। কুর্দিরা সংখ্যায় প্রায় এক কোটি ও কাজেই উড়িয়ে দেবার মত সংখ্যালঘু নয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমে বসবাসকারী এই জনগোষ্টি দীর্ঘদিন ধরে নানা বৈষম্যের শিকার। মাহসার মৃত্যুর পর এই জাতি-গোষ্ঠীর তরুণেরা অধিকতর বিক্ষোভমুখর হলে ইরান সরকার সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ থেকে সেখানে বিমান থেকে হামলা শুরু করে। সুন্নী মুসলিম অধ্যূষিত সিস্তান-বালুচিস্থান অঞ্চলের জাহেদান শহরে ডজনখানেক বিক্ষোভকারীকে হত্যা করার পর যদিও ইরান সরকার দাবি করেছে যে বিক্ষোভকারীরা প্রথম আক্রমণ শুরু করার পর তারা তাদের নিরস্ত করতে গুলি চালিয়েছে, জাহেদান শহরের প্রধান ইমাম এই অভিযোগ অগ্রাহ্য করেন।
সত্যি বলতে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা‘ শ্লোগানটি মূলত কুর্দি আন্দোলনের দীর্ঘদিনের শ্লোগান যা এখন গোটা ইরানে সবাই ব্যবহার করছে বলে সম্প্রতি ইরানী কুর্দি রাজনৈতিক দল ‘কোমালা‘-র নির্বাসিত নেতা আব্দুল্লাহ মোহতাদি গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতে জানান।
চলমান বিক্ষোভে অন্তত ২৩ শিশু নিহত হয়েছে
আয়াতুল্লাহ খামেনীর অসুস্থতা
আয়াতুল্লাহ খামেনীর বর্তমানে ৮৩ বছর বয়স এবং ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায়। সাম্প্রতিক একটি অস্ত্রোপচারের পর থেকে তাঁকে প্রায়ই নানা বৈঠক ও জনসম্মুখে উপস্থিতি বাতিল করতে হচ্ছে। খামেনীর পরবর্তী উত্তরাধিকারী কে হবেন সে বিষয়ে ৮৮ জন ইসলামী আইনবেত্তার একটি পরিষদ থাকলেও বাস্তবে এই পরিষদ কতটা গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি তাঁর কড়া রক্ষণশীল মতবাদের জন্য খামেনীর প্রিয়পাত্র হলেও ইরানের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং গত একমাসের অচলাবস্থা তাঁর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছে। তেহরানের আল জাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা গত সপ্তাহে রাইসি তাদের ক্যাম্পাসে গেলে ‘চলে যাও- ভাগো!‘ জাতীয় শ্লোগান দিতে এতটুকু ভয় পায়নি। খামেনীর ছেলে মোজতবা নিজেও পরবর্তী ‘খামেনী‘ হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যে ইসলামী দল কিনা পহ্লবী রাজবংশকে হঠিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা যদি ‘রাজপুত্র‘ নির্বাচনের মত বংশগত বিচারে ‘উত্তরাধিকার‘ নির্বাচন করে, তাহলে ইরানের সাধারণ মানুষ সেটা পছন্দ করবে না।
ইরানে আগের সরকারবিরোধী বিক্ষোভগুলোয় কত মানুষ হত্যা হয়েছে?
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘এসবিএস’র এক প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হচ্ছে যে ২০১৯-এর ‘রক্তাক্ত নভেম্বর (ফার্সি ভাষায় নভেম্বর মাসকে বলা হয় ‘অবন‘)‘-এ এক সপ্তাহের ভেতর ৩০৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। পেট্রলের মূল্য বৃদ্ধিতে ১০০টির উপর শহরে সেবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৭-১৮ সালেও অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ১৯৯৯ সালে সরকার ছাত্রদের পরিচালিত একটি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেবার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৯-এ ইরানের তদানীন্তন প্রগতিশীল প্রধানমন্ত্রী মীর হোসেইন মৌসাভিকে হঠিয়ে রক্ষণশীল মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ‘নির্বাচনে ব্যপক কারচুপি‘র পর ক্ষমতায় আসার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছিল এবং সেই বিক্ষোভ ছয় মাস ধরে চলেছিল। মোট ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক তখন খুন হন। এই আন্দোলনকে ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ‘সবুজ আন্দোলন‘ বলা হয়।
তবে এবারের আন্দোলন এ কারণেই আলাদা যে ইতোমধ্যে তেল শোধনাগারের শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করছে এবং স্কুল বালিকারাও সরকারবিরোধী শ্লোগান দিচ্ছে। সরকার এসবের পেছনে ‘আমেরিকা‘ ও ‘ইজরাইলে‘র চক্রান্ত দেখলেও গুলি খাচ্ছে সেদেশের সাধারণ ছেলে-মেয়েরাই! অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘ইরানীয়ান স্টাডিজ‘ বিভাগের প্রভাষক আলম সালেহ অবশ্য মনে করেন যে একদমই কোন নেতাবিহীন এবং মূলত তরুণীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনে কুর্দি বা বালুচসহ সব জাতিসত্ত্বার মানুষ অংশ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। মেয়েরা এবার আর ধর্মগুরু বা কোন পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ‘অধিকারের আশা‘ না করে নিজেরাই নিজেদের ‘অধিকার‘ কেড়ে নিচ্ছেন।
ইরানী-অস্ট্রেলীয় গবেষক ও এ্যাক্টিভিস্ট আজাদেহ দাভাচি মনে করেন যে ইতোপূর্বে ‘ইরানী নারীদের জন্য এবং তাঁদের দ্বারা পরিচালিত এত বড় আন্দোলন‘ আর হয়নি। ‘ইরানের বিদ্যমান সরকার পতনের এখনো কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও এত বড় ঘটনাকে ‘বিপ্লব’ আখ্যা না দিয়ে কি কোনো উপায় আছে?‘ দাভাচি বলেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
/তারা/