বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয়
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কখনো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ পৃথিবীকে অস্থির করে তুলছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষের বছরগুলো ভীষণ বিভীষিকাময় ছিল। করোনা মহামারীর অমোচনীয় ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি। ইউরোপের যুদ্ধ শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ থাকলে তবুও কথা ছিল, কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে গরিব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি অনাহারী মানুষগুলোকে করছে আতঙ্কিত। যুদ্ধের ফলে দূষিত পরিবেশ আরো বেশি দূষিত হচ্ছে। ব্রিটেনের মতো দেশে আট মাসে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর আগমন-প্রস্থান, এশিয়া-ইউরোপের রাজনৈতিক তৎপরতা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়- বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি।
বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে বটে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়া বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা মানব সভ্যতাকে পিছিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করছি। উন্নতি করতে হলে শ্রম দিতে হয়। শক্তি, সাহস, নিষ্ঠা দিয়ে কাজ করতে হয়। আমেরিকা, ইউরোপ বৈজ্ঞানিক মেধা দিয়ে এমন সব মারণাস্ত্র তৈরি করেছে যার আর্থিক মূল্যমান অত্যন্ত বেশি। কিন্তু সেসব মারণাস্ত্র মানুষের মৃত্যুর জন্য তৈরি। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা ছাড়া ওই অস্ত্র আর কোনো কাজে লাগবে না। ঔপনিবেশিক যুগের অবসান হলেও অর্থ-ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে ক্ষমতাবানরা এজেন্ট ভিত্তিক ‘পরোক্ষ শাসন ব্যবস্থা’র প্রচলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো ‘এজেন্ট শাসন নীতি’ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার একটি গোপন কৌশল। দেশে দেশে সে-কৌশল বাস্তবায়ন করার জন্য আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠছে। ন্যাটোর মতো সন্ত্রাসী সামরিক জোট এক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করছে আমেরিকাকে। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট ও উন্নয়নশীল দেশ উপরিউক্ত সংকটগুলো প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করছে।
এসব সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ কিছুটা চাপে আছে বাংলাদেশ- এ কথা আজ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। দুর্ভিক্ষ সারাবিশ্বেই একটি অতি পরিচিত শব্দ। বাংলাদেশে বহুবার দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। অসংখ্য লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খাদ্য বর্তমানে উদ্বৃত্ত থাকলেও, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় বর্তমান সরকার কিছুটা মিতব্যয়ী আচরণ গ্রহণ করেছেন। সাবধানতা অবলম্বন করে কিভাবে প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করা যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল-তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য বঙ্গবন্ধু যেমন নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাও আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে।
কৃষি ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ করা হলে, কৃষি জমিতে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো স্থাপনা তৈরি না করে যুযোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে হয়তো এ দেশের মানুষের জন্য খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সারের চাহিদা মেটানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশে সার-কারখানা থাকলেও সেসব কারখানায় যে পরিমাণ সার উৎপন্ন হয় তা আমাদের চাহিদার তুলনায় নগণ্য। বাংলাদেশ প্রতি বছর লাখ লাখ টন সার আমদানি করে। সার আমদানি ব্যাহত হলে কৃষি কাজ হুমকির মুখে পড়ে। বহির্বিশ্ব থেকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সার আমদানি করতে না পারে, তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যদি দেশের সার-কারখানাও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কৃষকের পক্ষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে আরো কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ দ্বারা তা পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখন পর্যন্ত একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়- বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ২০ শতাংশ। সরকার যদিও মুদ্রাস্ফীতি কম বলে কিন্তু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান ২০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির কথাই বারবার প্রচার করছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান এতটাই অবনতি হয়েছে যা কল্পনাতীত। কয়েক মাস আগেও ৮০ (আশি) টাকায় এক ডলার কেনা যেতো। এখন এক ডলার কিনতে গুণতে হচ্ছে একশ দশ টাকা। এর ফলে রিজার্ভে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। বৈশ্বিক লেনদেনে আমাদের প্রায় দেড়গুণ অর্থ বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এ ধারা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি হোঁচট খেতে পারে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রিজার্ভ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই।
বিশ্বায়নের যুগে অবরোধপ্রথা কতটা যৌক্তিক সেটাও ভেবে দেখা দরকার। এক দেশ আরেক দেশকে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। এটি মানুষ মারার নীল নকশা। ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলেও, আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে এ বিষয়ে বাংলাদেশ যে সোচ্চার সেটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ডিঙিয়ে কিভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য আরো বেগবান করা যায়, কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে বাংলাদেশের লাভ হবে, এসব বিষয়ে আরো গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বিশ্বে ক্ষমতার নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। একক ক্ষমতার পরিবর্তে বিশ্বে এখন দ্বৈত ক্ষমতার মহড়া চলছে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে মোকাবিলা করতে সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বেশ কিছু দেশ আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এই লড়াই সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিশ্ববাসীর সামনে দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রায় চার বছর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় ছয় বছর স্থায়ী হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি পূর্ববর্তী যুদ্ধগুলোর মতো স্থায়ী হয়, তাহলে বাংলাদেশ কিভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে সে বিষয়ে আগাম পদক্ষেপ নিতে পারলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যুদ্ধ আমরা না চাইলেও বারবার যুদ্ধের কবলে পড়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও যুদ্ধ থাকবে, তবে যুদ্ধের মধ্যেও কিভাবে বেঁচে থাকা যায় সে-কৌশল আবিষ্কার করে টিকে থাকতে হবে।
জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বারবার ঘোষণা করছে ২০২৩-২৪ সাল মহামন্দার কবলে পড়বে। অনেক দেশেই মন্দাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা যেন কিছুতেই আমাদের গ্রাস করতে না পারে সেজন্য দেশের টাকা দেশে রাখার কঠিন পদক্ষেণ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধ করে অর্থনৈতিক মন্দা রোধ করা সম্ভব। যারা দুর্নীতিবাজ, যারা টাকা পাচারকারী, ব্যবসার কথা বলে যারা দুইশ’ শতাংশ মূল্যে বিদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করছে তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দিলে আর্থিক মন্দা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মহামন্দার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী সংসদ নির্বাচন। আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এমনিতেই নানা অপপ্রচারে ব্যস্ত। জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে না পারলে, দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে মানুষ রাস্তায় নামতে দ্বিধা করবে না, আর এই সুযোগটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে সরকারবিরোধীরা। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভঙ্গুর অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা সঙ্কট সৃষ্টি করলেও এগুলো সামাল দেওয়া কঠিন নয় বলেই বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। অর্থনীতি ও রাজনীতি এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রেখেই আগামী দুই বছর সরকারকে খুব ঠান্ডা মাথায় পার করতে হবে। কেউ যেন কোনো অনৈতিক সুযোগ না পায় সব ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে দেশবিরোধীরা কী কী ষড়যন্ত্র হচ্ছে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো- আমরা দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি পাগল একদল লোক দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, আরেক দল লোক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। সুযোগ পেলেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার জেগে উঠবে। বাংলাদেশকে বিধ্বংস্ত, বিপর্যস্ত করলে কারা লাভবান হয় এটা এদেশের মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে বর্তমান সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাচনপূর্ব সময়ে সরকারের ভাবমূতি ক্ষুণ্ন হয়, এমন সব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের রাশ টেনে ধরতে হবে। একটা দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সে দলের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগে যেসব সুবিধাবাদী, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী নেতাকর্মী রয়েছে তাদের প্রতি কঠোর হয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বাংলার নিরন্ন গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন উন্নত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম করে সেই কাজটিই নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বিশ্বকে বিস্মিত করে শত বাধা অতিক্রমের মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন এদেশের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
/তারা/