ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর: শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু পরিবার 

সুভাষ সিংহ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২  
৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর: শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু পরিবার 

অতি সম্প্রতি ভারতের পেঙ্গুইন প্রকাশনী থেকে লেখক নেহা দিভেদী’র লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।  বইটির নাম ‘The Untold Story of the Rescue of SHEIKH HASINA THE LONE WOLF’

বইটিতে মূলত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক বীর সেনানী মেজর অশোক তারা (অবঃ) লেখক নেহা দিভেদী’র সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে উদ্ধারের বীরত্বপূর্ণ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। 

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেষ দুই দিন বেগম মুজিব ও তাঁর পরিবারকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। এমনকি বাড়িতে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর সকালে বাড়ির সামনে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই খবর পেয়ে ভারতীয় বাহিনীর মেজর অশোক তারার (পরে কর্নেল) নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর একটি দল ১৮ নম্বর সড়কের ওই বাড়িতে পৌঁছান। এ সময় হানাদার বাহিনীর দলটি গুলি করতে চায় এবং হুমকি দেয়- তাদের আক্রমণ করা হলে তারা বেগম মুজিবসহ অন্যান্যদের হত্যা করবে। তখনকার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মেজর তারা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পথ বেছে নেন। নিরস্ত্র হয়ে ১৮ নম্বর সড়কের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর মেজর তারা অত্যন্ত কুশলী ভাষায় দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তাদের বুঝান যে, নিজেদের মঙ্গলের জন্যই তাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত। 

২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত শুভজ্যোতি ঘোষের প্রতিবেদনে মেজর তারার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সেদিন বাড়িটিতে থাকা হানাদার সেনারা মারাত্মক খুনের মেজাজে ছিল। বাড়িটির কিছু দূরেই গুলিবিদ্ধ একটি গাড়ি, তার ভেতরে একজন সাংবাদিকের লাশ দেখতে পান মেজর তারা। লাশ থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। ওই সাংবাদিক বাড়িটির দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে হানাদার বাহিনী তাকে গুলি করে। আর আশপাশের লোকজন মেজর তারাকে জানিয়েছিলেন, আরও সকালের দিকে স্থানীয় একটি পরিবারকেও গুলি করে জখম করে হানাদারেরা। 

স্মৃতিচারণে মেজর তারা বলেন, ‘আমি তখন দেখলাম, সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার চালানোই একমাত্র রাস্তা। শেখ মুজিবের পরিবারকে বাঁচাতে হলে সেই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো পথও ছিল না। ...আমি হুমকির জবাবে জানালাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা গতকালই আত্মসমর্পণ করেছে, কাজেই তারাও অস্ত্র ফেলে দিলেই ভালো করবে। মনে হলো ওই সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণের কোনো খবর পৌঁছায়নি। ...একেবারে সামনে আসতেই গেটে যে সেন্ট্রি ছিল, সে তার বন্দুকের সামনে লাগানো ধারালো বেয়নেটটা আমার শরীতে ঠেঁকিয়ে ধরল। ... বললাম, আমি ইন্ডিয়ার আর্মির একজন অফিসার। ...একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি একলা তোমাদের এখানে এসেছি। তারপরও কি তোমরা বুঝতে পারছ না সব খেলা চুকে গেছে? তখনই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটা হেলিকপ্টার। আমি সঙ্গে সঙ্গে আঙুল তুলে বললাম, ‘তোমরা কি ওই হেলিকপ্টার দেখতে পাচ্ছ? বুঝতে পাচ্ছ কি ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন কাদের হাতে?’

এরপরও পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে গড়িমসি করে এবং সময় নেয়। মেজর তারা বুঝতে পারেন যে মনোস্তাত্ত্বিক সমরে শত্রুপক্ষকে তিনি ধীরে ধীরে ঘায়েল করতে সক্ষম হচ্ছেন। তিনি সতর্কতার সঙ্গে একের পর এক কথার অস্ত্র চালিয়ে যেতে থাকেন। সবশেষে চূড়ান্ত শব্দাস্ত্রটি প্রয়োগ করে বলেন, ‘এখনই সেরেন্ডার করলে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তোমাদের কথা দিচ্ছি, অক্ষত শরীরে তোমরা নিজেদের হেডকোয়াটারে ফিরে যেতে পারবে। আর না করলে তোমাদের লাশের যে কী হবে, তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই।’ 

পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রাণে রক্ষা পান বেগম মুজিব ও তাঁর স্বজনরা। মেজর অশোক তারার স্মৃতিচারণে আরও উল্লেখ আছে, ওই বাড়িতে শিশুপুত্র কোলে শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানাও ছিলেন। তাঁরা সবাই মেজর তারার অত্যন্ত কুশলী এই কথোপকথন শুনতে পান। উদ্ধারের পর মেজর তারাকে তাঁরা কৃতজ্ঞতা জানান। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১) 

পাকিস্তানিরা ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ করবে, এই আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু মার্চের প্রথম দিকেই ড. ওয়াজেদ মিয়াকে আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার পরামর্শ দেন। ধানমন্ডি ও হাতিরপুল এলাকায় একাধিক বাড়ি দেখার পর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ১৫ নম্বর (বর্তমান ৮/এ) রোডের ১৭৭ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন। ২৫ শে মার্চ রাতে ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এই বাড়িতে ছিলেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গমাতা শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে তাঁদের পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ শে মার্চ বঙ্গমাতা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল ধানমন্ডি এলাকা ছেড়ে খিলগাঁও এলাকার একটি ভাড়া করা বাড়িতে ওঠেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর মগবাজারে যান; এখানে প্রথমে একটি বাড়ির নিচতলায় এবং পরে অন্য একটি বাড়ির দুই তলায় আত্মগোপনে ছিলেন। মগবাজার থেকে ১২ই মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁদের আটক করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর (বর্তমান ৯/এ) রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে বন্দি করে রাখে। এই বাড়িতে কোনো আসবাব ও বিদ্যুৎ ছিল না। নয় মাস তাঁদের ফ্লোরে থাকতে হয়। এই বাড়িতে বন্দিকালে ২৭ শে জুলাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। এখান থেকে ৫ই আগস্ট পালিয়ে গিয়ে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা ৪ঠা জানুয়ারি (১৯৭২) শোনার পর বঙ্গমাতা ধানমন্ডির ১৮ নম্বর (বর্তমান ৯/এ) রোডের ২৩ নম্বর বাড়িটি ভাড়া নেন। ১০ই জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত ৩২ নম্বরের বাড়ি মেরামতের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে নিজের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। দেখুন, এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা ১৯৯৩, পৃ. ৭৩-১৩১; শেখ হাসিনা, সবুজ মাঠ পেরিয়ে, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০২০, পৃ. ৭২-৮৫; সাংবাদিক ইয়ং গেভিনকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার, The Observer, London, 16 January 1972. 

ইতিহাসের অনেক তথ্য এখন উপস্থাপিত হচ্ছে। পাকিস্তানের লেখক মানবাধিকার কর্মীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। যেমন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কয়টি করাগারে রেখেছিল। আগে আমরা শুধু পাকিস্তানে মিয়ানওয়ালী কারাগারের কথা জানতাম। এখন জানা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে একাধিক কারাগারে রাখা হয়েছিল।  

এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে বলা হয়েছে, ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর ২৯ শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ২৬ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় বা বাংলাদেশে অবস্থান সম্পর্কে গবেষক ও লেখকেরা আলোকপাত করেছেন। শেখ হাসিনার গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ৩২ নম্বর থেকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কিছু সময়ের জন্য সেই সময় নির্মাণাধীন সংসদ ভবনে রাখা হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘...আব্বাকে নিয়ে ওরা প্রথমে কিছুক্ষণ নির্মীয়মান সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসিয়ে রাখে। তারপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে।’ এখানে লেখক কেবল রাতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। অন্য কিছু প্রকাশনায় তিনদিনের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; জীবন ও রাজনীতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তিনদিন পরে অর্থাৎ ২৯ মার্চ প্লেনে করে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। উক্ত তিনদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার আদমজি স্কুলে প্রথমে এবং পরে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে আটক করে রাখা হয়।’ 

কিন্তু ২৯ শে মার্চ প্লেনে যাওয়া কিংবা তার আগে আদমজি স্কুলে ও ফ্ল্যাগ হাউসে থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য-উৎস উল্লেখ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগার-জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রগতিশীল পাকিস্তানি-লেখক আহমেদ সালিম। তিনি তাঁর Blood Beaten Track; Sheikh Mujibs Nine Months in Pakistan Prison গ্রন্থে ঢাকায় তিনদিনের অবস্থান সম্পর্কে কিছু লেখেননি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন তারিখে নেওয়া হয়েছে সে-সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, There are various conflicting accounts of hwo and when sheikh Mujib was flown out of Dhaka. লেখক এ-বিষয়ে কী কী ‘conflicting accounts’ আছে তা উল্লেখ করেননি বা নিজের উৎস থেকে কবে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নেওয়া হয়েছিল তা-ও জানাননি।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক অজানা তথ্য সম্বলিত দুটি আকর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman and struggle for Independence এই সাধারণ শিরোনামের গ্রন্থ দুটির একটিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত মার্কিন (১৯৫৩-১৯৭৩) ও অন্যটিতে ব্রিটিশ (১৯৬২-১৯৭১) সরকারের সকল গোপন তথ্য স্থান পেয়েছে। গ্রন্থ দুটি সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাস-গবেষক এনায়েতুর রহিম ও জয়েস এল রহিম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই উভয় গ্রন্থের ‘ফরোয়ার্ড’ লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বঙ্গবন্ধু গবেষক শেখ হাসিনা। এই প্রকাশনার UK Foreign & Commonwealth Office De-Classified Documents ১৯৬২-১৯৭১-এ  বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানে নেওয়া এবং তাঁর বন্দিজীবন সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই অংশ অর্থাৎ গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নেওয়া ও বিভিন্ন জেলের বন্দিজীবন নতুনভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। 

এই গ্রন্থভুক্ত ‘Sheikh Mujib in Custody’ শিরোনামের একটি গোপন বার্তায় বলা হয়, ‘Circumstantial evidence from a fairly reliable source indicates confirmation of earlier reports that Sheikh Mujib in custody at Attock fort.’ বার্তাটি ইসলামাবাদস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ৩রা এপ্রিল (১৯৭১) লন্ডনের ফরেন অফিসে প্রেরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ বা প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে আত্তক দুর্গে বন্দি করে রাখার কথা উল্লেখ  করা হয়নি। এমনকি পাকিস্তানি গবেষক আহমদ সালিমের গ্রন্থেও এই দুর্গের উল্লেখ নেই। এই আত্তক দুর্গ প্রসঙ্গে UK Foreign & Commonwealth Office De-Classified Documents ১৯৬২-১৯৭১-এ দ্বিতীয়বার উল্লিখিত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু ব্রিটিশ এমনি ব্রুস ডগলাস মান-এর এক রিপোর্টে। এই রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু কেবল আত্তক দুর্গে বন্দি আছে সেটি উল্লিখিত হয়নি; তিনি ২৬ শে মার্চ থেকে সেখানে ছিলেন বলেও তথ্য রয়েছে। হরিপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২৮ শে ডিসেম্বর ড. কামাল হোসেনকে সিহালা রেস্ট হাউসে আনা হয়। এই রেস্ট হাউসে রেডিও পাওয়া ও কামাল হোসেনের সঙ্গে দেখা হওয়া ছাড়াও এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার কণ্ঠ রেডিও-র মাধ্যমে শুনতে পান। এভাবে তিনি পরিবারের সদস্যরা যে বেঁচে আছেন, অবশ্য শেখ কামাল ও শেখ জামালের খবর তখনও তিনি জানতে পারেননি, তা নিশ্চিত হন। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা নিজের গ্রন্থে লিখেছেন:

‘সেই বাড়ি [জেলারের বাড়ি] থেকে আব্বাকে নিয়ে আর একটি বাড়িতে [অর্থাৎ সিহালা রেস্ট হাউসে] রাখা হয়। সেখানে একটি রেডিও দেয়া হয়েছিল। ড. কামালকেও নিয়ে একই বাড়িতে রাখে। একদিন ড. কামালকে আব্বা বলেছিলেন, ‘আমার বড় মেয়ে সন্তানসম্ভাবা দেখে এসেছিলাম। কিন্তু জানি না ওরা কোথায় আছে, কিভাবে আছে। আর বেঁচে আছে কিনা। ওদের কোন খবরই জানতে পারি নাই।’

এই কথা বলছিলেন আর রেডিওর নব ঘুরাচ্ছিলেন। হঠাৎ শোনেন আমার গলা। কোনো একটা রেডিও স্টেশন আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল, তখন সেটা চালাচ্ছিল। আমি তখন বলছি ‘আমার আব্বা কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কিনা আমরা সে খবর কিছুই জানি না।’ ঐ ইন্টারভিউতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর কিভাবে অত্যাচার করেছে, মেয়েদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অত্যাচার করেছে। গণহত্যা চালিয়েছে। আমাদের নিজেদের গ্রামের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িসহ বাংলাদেশের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে। কেমন করে বস্তিতে আগুন লাগিয়েছে, আর যখনই মানুষ বাঁচার জন্য ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছে তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। ছোট ছোট মেয়ে, বারো তেরো বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে কত মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে। তরুণ বা যুবক দেখলেই গুলি করে হত্যা করেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা আমি সেই সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলাম। আমার ছেলে হয়েছে বন্দিখানায়। আব্বার দেয়া নাম ‘জয়’ রেখেছি । আমি ঠিক ঐ কথাই বলেছিলাম যে আব্বা বলেছিলেন, আমার ছেলে হবে। আমার ছেলে হয়েছে কিন্তু আব্বা তো জানতেও পারলেন না আমি ওর নাম জয় রেখেছি। ঠিক যে কথাগুলি তাঁর মুখ থেকে বের হচ্ছিল সে কথাগুলি আমি বলেছিলাম, আর তখনই জানতে পারলেন যে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু কামাল, জামাল কেমন আছে বা দাদা ও দাদি বেঁচে আছেন কিনা তা কিছুই জানতে পারেন নাই।’

সিহালা রেস্ট হাউসে থাকাকালে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রথমে চাপ তৈরি এবং পরে বিনীত অনুরোধ করেন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো না কোনো ধরণের সম্পর্ক রাখার জন্য। সেই সময়ের পাকিস্তানি রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করা ভুট্টোর জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধ করছে ভুট্টো তখন ইয়াহিয়ার ওপর প্রচন্ড চাপ দেন তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য। কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা না দিয়ে বাঙালিদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহারের চেষ্টা করে। প্রথমে ভুট্টোকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে পাকিস্তানের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর ইয়াহিয়া জনতার চাপে ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। এ-অবস্থায় ভুট্টোকে জনতার সামনে এটা দেখানোর প্রয়োজন হয়, সামরিক জান্তার কারণে যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে সেই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার একটি বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষমতা বা নেতৃত্ব গুণ রয়েছে। নিজের ইমেজ বৃদ্ধি ও সামরিক জান্তার বিপরীতে নিজের সমর্থনের পরিসর সম্প্রসারণের জন্য ভুট্টোর কাছে বঙ্গবন্ধুর কৃপালাভ খুব দরকার ছিল। এজন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করে বারবার এই অনুরোধ জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক গেভিন ইয়ং-এর কাছে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর বিনীত আবেদনের কথা উল্লেখ করেন এভাবে: Bhutto appealed-yes, appealed-to me help save some sort of connection with West Pakistan. But you knwo what position I was in. He was friendly-but all I could say was `I have first and above all to consult my people and my provisional government. 

বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুনয়-বিনয় করে কোনো প্রতিশ্রুতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ভুট্টো প্রত্যক্ষ চাপ প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করেন। ২৮ শে ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নিয়ে আলোচনা হয়। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি বাংলাদেশে পাঠাতে অনাগ্রহী। ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং ঢাকার সঙ্গে বিমান চলাচল চালু না হওয়াকে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হয়। ভুট্টো প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু যেন পাকিস্তান থেকে তুরস্ক বা ইরান হয়ে বাংলাদেশে যান। ভুট্টো ইরান হয়ে যাওয়ার ওপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর প্রস্তাবে বাজি হননি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবেই লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন। মাঝে বিমানে তেল নেওয়ার জন্যে সাইপ্রাসে যাত্রা বিরতি করা হয়েছিল। 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক  
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়