উড়াল পথে রেলগাড়ি
অজয় দাশগুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক || রাইজিংবিডি.কম
কি অপার বিস্ময়! মেট্রোরেল চলবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। তবে প্রথম পর্যায়ে মাটির নিচ দিয়ে নয়, রেল চলবে এলিভেটেড মেট্রোরেল হিসেবে- উড়াল পথে।
লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন বা ভূগর্ভস্থ রেলপথের কথা পড়েছি বিদ্যালয়ে, এখন থেকে অন্তত ছয় দশক আগে। তত দিনে সাবওয়ে কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা টিউব নামে পরিচিতি পাওয়া লন্ডনের এ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা শতবর্ষ পালন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র্র, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ আরও অন্তত ৬০টি দেশে এ ধরনের আধুনিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। চীনের সাংহাই মেট্রোরেলকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম মেট্রো নেটওয়ার্ক- দৈর্ঘ্যে ৮০৩ কিলোমিটার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানায় ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে কলকাতায় দেখেছি মেট্রোরেলের নির্মাণ যজ্ঞ। উড়াল নয়, মাটির নিচ দিয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য কত যে খোড়াখুড়ি! জনদুর্ভোগের শেষ ছিল না। ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরবর্তী সময়ে উড়াল পথেও রেল গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎচালিত এ রেল ব্যবস্থার জন্য প্রচুর ঋণ দিয়েছে জাপান, কারিগরি সহায়তাও এসেছে এশিয়ার ধনবান এ দেশ থেকে। রেল লাইন, ইঞ্জিন-বগি ও অত্যাধুনিক স্টেশনের সরঞ্জাম এবং দক্ষ কর্মী দল- প্রায় সব কিছু জাপানের। এ মেট্রোরেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে অংশগ্রহণ করা ৭ জন জাপানি বিশেষজ্ঞ প্রাণ দিয়েছেন ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় আরও অনেকের সঙ্গে তাদের করুণ মৃত্যু হয়। আমরা তাদের ভুলব না! রেল স্টেশনগুলোতে এদের পরিচয় রাখার আয়োজন থাকবে- এটাই প্রত্যাশা।
পদ্মা সেতু একটি চেতনার নাম- এমনটিই বলা হয়। এখন কুয়াশার মৌসুম। আরিচা-পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি বন্ধ কুয়াশার কারণে, এমন খবর থাকে নিয়মিত। মাওয়া-কাঁঠালবাড়িতেও এমন ঘটত। ফেরির দুই পাশে শত শত গাড়ির সারি। লঞ্চ-বিমানও বন্ধ। গ্রীষ্ম-বর্ষাতে ঝড়ের শঙ্কাতেও ফেরি-লঞ্চ বন্ধ। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর বরিশাল-যশোর-খুলনা অঞ্চল এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে। কুয়াশা ভেদ করে ঢাকা থেকে মাত্র তিন-চার ঘণ্টাতেই গাড়ি চলে যাচ্ছে এ সব জেলায়। মংলা বন্দর প্রাণ পেয়েছে পদ্মা সেতুর কারণে। বিশ্বব্যাংক কাদের প্ররোচনায় পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল, সেটা দেশবাসীকে জানানো দরকার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের চরম অসহযোগিতার মুখে নীরবে বসে থাকেননি। নিজেদের অর্থে সম্পন্ন করেছেন রেল-সড়ক সেতুটি।
মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও বাধা কম আসেনি। রাজধানীতে জমির চেয়ে মূল্যবান আর কী-ই বা আছে? বিশেষভাবে মিরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা ও নিয়মিত যাতায়াতকারীরা টানা প্রায় এক দশক অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট-শাহবাগ-প্রেস ক্লাব এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে এখনও। প্রতিদিন এ পথে নানা গতির যানবাহনে চলাচল করেন লাখ লাখ মানুষ। যানজটের কারণে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নিত্যদিন। বলা হয়ে থাকে, গন্তব্য স্থানে দ্রুত পৌঁছাতে হলে গাড়ির পরিবর্তে হেঁটে যাওয়া উত্তম। উত্তরা-আগারগাঁও রেলপথের প্রতি এ কারণে তীক্ষ্ম নজর থাকবে সবার। যদি এ নতুন রেলপথ নগরীর একটি অংশে চলাচলকারীদের জন্য স্বস্তি আনতে পারে তাহলে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ পথের সুফল তুলে ধরা হতে থাকবে। আগারগাঁও-ফার্মগেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-মতিঝিল রুটের নির্মাণ কাজে গতি আনার জন্য জনগণ সহযোগিতার হাত আরও বাড়িয়ে দেবে।
ঢাকা মহানগরে রাজপথ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য এ পথের একটি অংশ অকার্যকর রাখতে হয়েছে। মাটির নিচে কিংবা ওপরে, যেখানেই রেল পথ নির্মাণ করা হোক না কেন ‘পথ বন্ধ রাখতেই হবে’। ২৮ ডিসেম্বর, আজ থেকে অতি সীমিত পরিসরে চালু হলো উড়াল রেল পথ। এ পথ পরীক্ষামূলক। যদি সফল হয়, খুব ভালো কথা। কিন্তু যদি প্রত্যাশা পূরণে সামান্য পরিমাণ সমস্যাও তৈরি হয়- সরকার, সিটি করপোরেশন ও রেল কর্তৃপক্ষের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি।
মেট্রোরেলের প্রতি বাস-মিনিবাস এবং অন্যান্য যানবাহন মালিকদের মনোভাবও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাস মালিকরা যদি দেখে, মেট্রোরেল তাদের ‘ব্যবসায় হাত দিচ্ছে’, তাহলে পদে পদে অসহযোগিতা করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেলের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের যে কোনো ধরনের ‘আন্দোলনে’ রাজপথ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তিন দশক আগে জাপানি একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, বাংলাদেশে তাদের জন্য ‘কালচারাল শক ছিল’ রাজধানী এবং দেশের নানা স্থানে রাজপথ অবরোধ। কারখানার শ্রমিক-মালিক বিরোধ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হলে প্রতিবাদ করা অথবা চিকিৎসক-আইনজীবী-শিক্ষকরা তাদের দাবি তুলে ধরতে চাইলে পথ একটিই- রাজপথ বন্ধ করে দাও। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটে? এ রেল ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য অভিন্ন নেটওয়ার্ক বজায় রাখতে হবে। একটি ট্রেন বন্ধ হলে সব ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। এমন সর্বনাশা পথ অনুসরণ করার মতো অপশক্তির আবির্ভাব না ঘটুক এটাই কাম্য।
মাত্র কিছুদিন আগেও ‘উন্নয়ন’ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আমাদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল। পদ্মা সেতুর লাখ লাখ নাট-বল্টুর মধ্যে রেলিং থেকে একটি খুলে নিয়ে অপপ্রচার চালানো হলো- ‘এই হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু’। সব টাকা পদ্মায় বিসর্জন গেল। কিছুদিন আমাদের বিদ্যুতের চরম সংকট সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু এখন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা প্রায় নেই। কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় না বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে কোথাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেনি। অতীতের মতো হামলা হয়নি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ চালুর জন্য প্রস্তুত। আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বোরো ধান পরিচর্যার জন্য কৃষক মাঠে নেমে পড়েছে। সার-সেচের পানি নিয়ে সংকটের কথা শোনা যায় না। রফতানি-আমদানি বাণিজ্যে ফের গতি এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ফের ভরপুর হচ্ছে। রাজধানিতে অভিনব সংযোজন মেট্রোরেল তো এরই ধারাবাহিকতা!
তারা//