বাঙালির স্বাধীন স্বদেশ যাত্রা
একান্ন বছর আগে সেই এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে বাঙালি ফিরেছিলেন স্বদেশে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ একটি দণ্ডে একাত্ম হয়েছিল স্বাধীনতার স্বাপ্নে। “আমি জানতাম, আমার বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। সেই বাংলায় আমি আবার আসিব ফিরে।”
ফিরে এলেন তিনি এই বাংলায় ‘ধনধান্য পুষ্পভরা বসুন্ধরায়’। দীর্ঘ দশ মাসের কারাবন্দি জীবন শেষে ফিরে এলেন সেই দেশে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবো নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ কিন্তু জন্মভূমি তখন রানি নেই, ধ্বংসস্তূপে পরিণত। লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয়গান গেয়েছিলেন তিনি, সেই জয়ের পতাকা ছিনিয়ে আনতে ঝরেছে লাখো লাখো মানুষের প্রাণ, মা-বোনের সম্ভ্রম, কোটি কোটি মানুষ হয়েছে সহায় সম্পদহীন, গৃহবসতিহীন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে ফিরে এলেন তিনি। বলতেনও, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার, যেন এই দেশেতে মরি’। সাহসের ভেতর থেকে উজ্জীবিত তিনি দশমাসে অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ জীবনে ভেঙ্গে পড়েননি। মানসিক বল ছিল অধিক প্রবল। জানা ছিল, যে সংগ্রামের ডাক তিনি দিয়েছেন, যে লক্ষ্যাভিসারে চলার জন্য দেশের মানুষকে আহ্বান করেছেন- সে লক্ষ্য পূরণ হবেই। তাঁর দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম-আন্দোলন, শ্রম-নিষ্ঠা-কোনো কিছুই বিফলে যাবার নয়। সুকঠিন কারা অর্গল ভেঙে অতীতের মতোই বাংলার মানুষ তাঁকে মুক্ত করবেই। মৃত্যুকূপ খনন করে মানসিক নিপীড়নের মতো ক্রুরতার মুখোমুখি করেও বাঙালির জাতির জনককে পর্যুদস্ত করা যায়নি। পরশ্রীকাতরতা স্পর্শ করেনি, শাসকের দীর্ঘ নিপীড়নেও ভাঙেনি কখনো মনোবল, আপসের পথে ধাবিত হতে হয়নি- সেই তিনি একাকী নিঃসঙ্গ কারাগারে উচ্চারণ করতেন, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’।
তিনি ফিরে এসেছেন মুক্ত মানবের আলোকবর্তিকা নিয়ে। কারাগারের অন্ধকার থেকে বাংলাদেশের সূর্যালোকের দিকে করছেন যাত্রা। মুক্তির পরে বলেছিলেন, “এই অভিযাত্রা হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির দিকে, হতাশা থেকে আশার দিকে।” ফিরে এসেছেন তিনি নিজের জনগণের সঙ্গে যোগ দিতে। যে জনগণ তাঁরই ডাকে ‘ঘরে ঘরে দূর্গ’ গড়ে তুলেছিল। ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে’ পড়েছিল। এনেছিল বাঙালির সহস্র বছরের সাধনার ধন স্বাধীন বাংলাদেশ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন শুধু নয়, কোর্ট মার্শালে সাজানো বিচার করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধে। পাকজল্লাদ বাহিনীর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিচারের আগেই রায় ঘোষণা করেছিলেন। ফাঁসির হুকুম হলো। জেলখানার পাশে কবরও খোঁড়া হলো। বঙ্গবন্ধুর তখনো অটল মনোভাব। আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নি, জবানবন্দীও নয়, এমন কি আইনজীবি নিয়োগে অনীহাও দেখিয়েছিলেন। বাঙালি নামধারী কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
কোনো কিছুই দমিত করতে পারেনি বাঙালি জাতির বীর পুরুষ মহানায়ক শেখ মুজিবকে। একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির করণীয় কি, তাঁর অবর্তমানে সে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিতে না পারি’। কিন্তু শেষ হুকুম তিনি দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ রাতে, গ্রেফতার হবার আগে। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ সারা বিশ্ব জেনেছিল। আর সাড়ে সাতকোটি মানুষ রণাঙ্গণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বাংলার মাটি, বাংলার জল রক্তে বারুদে একাকার। পুড়ছে ঘর, পুড়ছে মানুষ তবু মাথা নত করেনি বঙ্গবন্ধুর বাঙালিরা। ‘বাঙালি’ নামধারী কতিপয় ধর্মের লেবাস পড়ে রাজাকার, আল বদর, আল শামস আর শান্তি কমিটি নাম ধারণ করে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতেছিল, মা বোনদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছে, লুট করেছে সম্পদ, হত্যা করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষদের।
সারা বাংলা তখন জেলখানা। অস্ত্র হাতে তরুণ যুবা শত্রু হননে মত্ত। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও গঠন হয়। যাঁর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু। সেই সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় যুদ্ধ। এগিয়ে আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত। কোটি শরণার্থীর চাপ তখন ভারতের উপর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন, মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহায়তা প্রদান শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের পাকিস্তানী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। চাপ প্রয়োগ করেছিলেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উপর। একাত্তরেই বিদেশী সাংবাদিক লিখলেন, “দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান, কেউ ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা এক অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে-সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখণ্ড শুধু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মত এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। এইখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা।”
মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসীর দণ্ডাদেশ নিয়েও ভীত ছিলেন না। জীবন ও মৃত্যুকে একবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিলেন। জল্লাদরা কারাগারে আনাগোনাও করেছে। তাদের বলেছিলেন, একজন মুসলমান একবারই মরে, মৃত্যুভয়ে তিনি ভীত নন, শুধু একটাই অনুরোধ, ওরা যেন তাঁর মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। না ঘাতক জল্লাদবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি নানা উদ্যোগ নিয়েও। আন্তর্জাতিক চাপ ও পাকিস্তানীদের নিজদেশে জটিল পরিস্থিতির জন্য হানাদার পাক সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলে ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু পৌঁছলেন লন্ডনে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। প্রবাসী বাঙালিরা আবেগ উৎফুল্ল হয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান।
১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী পরাজয় ও আত্মসমর্পণের পরও বাঙালি মুষড়ে পড়েছিল, বঙ্গবন্ধুর জন্য। চূড়ান্ত জয়ের মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায় উদ্বেগ আনে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বাঙালি তখন সোচ্চার বিশ্বজুড়ে। প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুবিহীন স্বাধীন বাংলাদেশের মায়েরা দু’হাত তুলে প্রার্থনারত বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, সংশয় বাংলাজুড়ে। বঙ্গবন্ধুবিহীন ভবিষ্যৎ কি হবে- উৎকন্ঠা ছিল। এরই মাঝে আশার আলো জ্বলে উঠলো। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তির খবর পেয়ে অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন যে, “আপনি বন্দি ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আপনি নিপীড়িত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।” বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে পৌঁছার পর মিসেস গান্ধী বলেছিলেন, “শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ এবং বিশ্ব জনমতের একটি বিজয়।”
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ঘোষণায় দোলাচল বাঙালি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। এতো রক্ত, এতো যুদ্ধ, এতো প্রাণহানি, ভূখণ্ড উদ্ধার- সব কিছুই তো তাঁরই আহ্বানের। সারা বাংলা ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠেছিল। ফিরে আসছেন তিনি, বাঙালির আরাধ্য পুরুষ। রাজপথে জনপদে বাঙালি পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে আনন্দে। অশ্রুসজল চোখে সেকি অপার আনন্দ। অবর্ণনীয় সেই সব মুহূর্ত। তরুণ প্রাণ কেঁদেছিল বৈকি। বাঙালির আশা বাঙালির ভালোবাসা ফিরে আসছেন নিজ বাসভূমে। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ একাত্ম ও অভিন্ন হয়ে ওঠে তখনই।
১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে বৃটিশ বিমানে দিল্লী যান। রাজকীয় সংবর্ধনায় তিনি ভারতের জনগণের প্রতি তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। সেদিন এই উপমহাদেশে এক নতুন সূর্যোদয় হলো অনেক প্রত্যাশার, আশার ও আকাঙ্খার। আকাশবাণী পুরো ধারাবিবরণী প্রচার করে। তারপর বঙ্গবন্ধু স্বদেশের পথে। বেজে ওঠলো গান ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে তোমার স্বাধীন সোনার বাংলায়।’ ১০ জানুয়ারি বিকেল ছিল অন্যরকম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলায় পৌষের শীতকে ছাপিয়ে সূর্যালো ঠিকরে পড়ছিল যেন সারা বাংলাদেশের। দশ জানুয়ারির সকাল থেকেই সব স্রোত যেন বিধ্বস্ত তেজগাঁও বিমান বন্দরে। কখন আসবে নেতা, কখন দেখতে পাবে বাংলার মানুষ আরাধ্য মহাপুরুষকে। লাখো লাখো মানুষের ভিড় রাজপথজুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পৌঁছুতে আড়াই ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেল। অজস্র বাঙালির অভিনন্দন বর্ষিত বঙ্গবন্ধু ময়দানে পৌঁছে কয়েক লাখ শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে এক গভীর আবেগপূর্ণ এবং সেই সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রের জন্য দিক নির্দেশনাপূর্ণ ভাষণ দেন। সারা বাংলার মানুষ এক পলক দেখার জন্য উদগ্রীব তখন। বেতারে ধারাভাষ্য শুনেও কেঁদে ফেলেন অনেকে। একান্ন বছর আগের ১০ জানুয়ারি এক মহামান্বিত ও অনন্যদিন বাঙালির ইতিহাসে। ১০ মাসের জেল জীবনে বঙ্গবন্ধু খানিকটা কৃশ হলেও কণ্ঠের তেজ ও মাধুর্য কমেনি। ক্রন্দনমথিত কণ্ঠে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন। বাঙালি জাতি আবার যেন নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হলো সেদিন। এবার তাকে দেশ গড়তে হবে। নতুন সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন বাংলায়। কিন্তু এ কোন বাংলা? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চারদিকে পাহাড় সমান সমস্যা, পাক হানাদাররা নয়মাসে দেশের প্রতিটি পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ ধ্বংস লীলার ছাপ রেখে যায়, তা নজিরবিহীন। তখন প্রয়োজন যুদ্ধের নয়মাসে তিন কোটি মানুষের পরিত্যক্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি ঘরের পুনর্বাসন। এককোটি গৃহত্যাগী শরণার্থীদের নতুন গৃহনির্মাণ সহায়তা। সম্বলহীন শরণার্থীদের ক্ষুধার অন্ন, পরণে বস্ত্র, মাথা গোঁজার জন্য ছোট্ট গৃহ, প্রজ্জ্বলিত শস্যক্ষেত্র আবাদ করা, বিরাণ নগর বন্দর, হাট বাজার চালু করা, শিক্ষালয়, শস্যহীন গুদাম- এসবই তখন পুঞ্জিভূত সমস্যার পাহাড় হয়ে আছে। খাদ্য ঘাটতি তিন লাখ টন, দুইকোটি মানুষের আশ্রয়, হাজার হাজার মাইল যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার, শত শত ধংসকৃত সেতু, কালভার্ট, হাট বাজার, হাজার হাজার বাস ট্রাক, নৌযান চালু করা।
স্বাধীন বাংলাদেশে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা আর অশ্রুতপূর্ব গণসমর্থন নিয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, তা সোনার বাংলা নয়, বিধ্বস্ত বাংলা। চারদিকে ‘নাই’ ‘নাই’ অবস্থা। আর তখন তিনি কেবল নেতা নন, রাষ্ট্রপতিও। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের কর্ণধার। গোটা দেশ তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর দিকে। সকল ধরনের শোষণ থেকে জাতিকে মুক্ত করার অভিপ্রায় বঙ্গবন্ধুর। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু- যেখানে পর্বত প্রমাণ সমস্যা। হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা তখনো সশস্ত্র অবস্থানে দেশের কোথাও কোথাও। অস্ত্রের ছড়াছড়ি। পাকিস্তানী শাসকের শোষণ নিপীড়ণে চব্বিশ বছর ধরে জর্জরিত বাংলাদেশ- তারপর পাক হানাদারদের ধংসযজ্ঞে লন্ডভন্ড দেশ। বিধ্বস্ত অর্থনীতির পূনর্গঠন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন-সবকিছুই তখন জরুরী হয়ে পড়েছে। আর প্রত্যেকটিই যেন দুরূহ। অথচ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে জরুরি কর্তব্য।
অবিস্মরণীয় সংবর্ধনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে তখন ভাবতে হচ্ছে দেশ গড়ার কথা। আর বাঙালি ভাবছে, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পূর্ণতা লাভের স্বাদ। আবারো সেই রেসকোর্স ময়দান, নেতা-জনতার আবারো মিলিত মাহেন্দ্রক্ষণ। নৌকা প্রতীকের আদলে তৈরি পাঁচশো ফুট দীর্ঘ মঞ্চ। মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অশ্রুসজল চোখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে পাকিস্তানীদের জঘন্য ধংসলীলার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রত্যুত্তরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমার বাংলাদেশ স্বাধীন, চিরকাল টিকে থাকবে।” বঙ্গবন্ধু সকল শহীদদের এবং নির্যাতিত অত্যাচারিতদের কথা স্মরণ করে বললেন, “আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। ... আপনারা আমাকে চেয়েছেন, আমি এসেছি। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। কবর খোঁড়া হয়েছিল। জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে, দুবার নয়, হাসতে হাসতে মরবো, তবু ওদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। মরার আগেও বলে যাব, আমি বাঙ্গালি, বাঙলা আমার ভাষা, জয়বাংলা। বলব বাঙলার মাটি আমার মা। আমি মাথা নত করব না।”
বঙ্গবন্ধুর আবেগপূর্ণ ও স্মৃতিচারণমূলক ভাষণের মাঝেই ছিল পরবর্তী দিক নির্দেশনা। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবেন না এমন বলিষ্ঠ উচ্চারণ তোলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ করতে হবে। আর সেই যাত্রায় বাংলার মানুষকে সাথে নিয়ে এগুতে হবে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ এবার গড়তে হবে। বললেন, “গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দূর্গ গড়ে তোল।’ আজ আবার বলছি ‘আপনারা একতা বজায় রাখুন।” বঙ্গবন্ধু সাহস জোগালেন, “বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই।”
সাহস বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাঁর পরম কবি রবীন্দ্রনাথকে তিনি কারাগারে ভোলেন নি। মঞ্চে সেই কবিগুরুকে আবার স্মরণ করলেন, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’। কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে, যার নজির ইতিহাসে নাই।” সব সাহসিকতাকে সামনে রেখে বাস্তবের বাংলায় এসে বর্ণনা করলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কথা। পাক বাহিনী বিরাণভূমি বানিয়ে গেছে। লাখো মানুষের মুখে খাবার নেই। অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে সাহায্য চেয়ে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বানও জানান। সেই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানেরও অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন স্বাধীনতা এসেছে। এখন বড় কাজ স্বাধীনতা রক্ষা। “বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না।’- বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্রের দিক নির্দেশনা দিলেন। রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তিও ঘোষিত হলো। “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ পরে অবশ্য সংযোজিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদ। যে জাতীয়তাবাদ বাঙালিকে নতুন রাষ্ট্র তৈরীর পথে নিয়ে গিয়েছিল।
সামনে যে বিশাল সমস্যা-বঙ্গবন্ধুর তা জানা হয়েছিল এই স্বল্প সময়কালের মধ্যেই। দূরদর্শিতা, দুরদৃষ্টিতে তিনি পুরো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চেহারা অবলোকন করেছিলেন। দেশ গড়তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যের অনুরোধও রেখেছিলেন। ‘‘আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরাই সবাই রাস্তা করতে শুরু করেন। যার যার কাজ করে যান।’’ বাংলাদেশে যৌথ বাহিনীর সদস্য ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন। বিশ্বের ইতিহসে যা নজিরবিহীন এবং ব্যতিক্রম। একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেকে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না।’’ দেশে থেকে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধের ঘোষণা দিলেন। ‘বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না।’ এসব দীপ্ত উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এতো বেসামরিক লোক মরে নাই।’’ স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আল-বদর, আল-শামস্সহ পাক বাহিনীর সহযোগীদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। সেই সঙ্গে দাবি করেন বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে।’’ একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করে বর্বর পাক বাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’’ বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলাদেশের আসনও দাবী করেন।
বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে স্বদেশ ফেরা টুঙ্গিপাড়ার সেই সাহসী সন্তান থেকে বাঙালির জাতির পিতাকে পরিণত শেখ মুজিব ভাষণে বাঙালির গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা, দেশের সমাজ নির্মাণসহ দেশ গড়ার পথ নির্দেশনা তুলে দিলেন। বাঙালির প্রত্যয়, সংগ্রাম, শৌর্য, বীর্য আর শপথের প্রতীক বঙ্গবন্ধু একটি নতুন দেশ ও জাতির চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খা আর স্বপ্নকে ধারণ করে ভবিষ্যতের পথ যাত্রায় বাঙালিকে এগিয়ে দিলেন। এবার শুরু হল মুক্তির সংগ্রাম। ডাক দিলেন, দেশ গড়ার সংগ্রামে। ভগ্ন বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনসহ বাঙালির নতুন স্বদেশযাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের দশ জানুয়ারি। জনসমুদ্রের মানুষ দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নিয়েছিলেন। ৫০ বছর আগে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি এক নতুন জাতি তাঁর নতুন আদর্শকে সামনে নিয়ে স্বদেশ গড়ার কাজে নেমেছিল। যে হাত অস্ত্র নিয়েছিল, সে হাতও পরিণত হলো কর্মীর হাতে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের কৈশোর কালে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুর সময়ের সন্তান।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
তারা//