ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

বনবিবি : মটর শাক ও নববধূর পা 

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৯, ৯ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৩:৫০, ৯ মার্চ ২০২৩
বনবিবি : মটর শাক ও নববধূর পা 

মেঘদল

মেঘ আবার কী করে পরাজিত হয়? অথচ কবিতার বইয়ের ব্যাক কভারে লেটার প্রেসে ছাপা হলো ‘বিপ্লবী, কবি, প্রেমিক ও পরাজিত মেঘদল ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত ভুল শাসক, শোষক, ভণ্ড সমালোচক, পরিতোষক ও স্থূল সৌন্দর্য ধারকদের জন্যে আমি আমার এই বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি।’

লিখেছেন কবি আবুল হাসান, যার মৃত্যু হয় মাত্র আটাশ বছর বয়সে, ১৯৭৫ সালেই। এসব আমি জানতাম বিভিন্ন লেখাপত্তর পড়ে, আর্লি নাইনটিজে, যখন আমি কলেজে পড়ার নাম করে ঝিনেদা শহরে তুমুল ঘোরাঘুরি করছি। একদিন বোদলেয়রের চলিষ্ণু মেঘেরও অনুবাদ ভার্সন চলে এলো আমাদের হাতে। অথচ আমরা বুদ্ধদেব বসুকে কখনো চোখে দেখিনি। আমাদের মেঘের সঙ্গে দেখা হলো। মেঘ ও মেঘদল শব্দ বন্ধে একটা অবজার্ভেশন তৈরি থাকল আমার। 

একদিন জানলাম, একটি গানের দল আছে- ‘মেঘদল’। কারা সেই দলের মেঘ, কারা শূন্যে ভাসমান জলতরঙ্গের কণা? শিবু-সুমন-উজ্জ্বলদের দিকে চোখ গেল। ওরা হয়তো চারুকলার বকুলতলায় বসে ছিল। যদিও তখন বকুলের সিজন  ছিল না। তাহলে ওদের উদ্দেশ্য কি? গোপনে খেয়াল রাখলাম- কোথাকার মেঘ কোথায় গিয়ে বাদলা হয়ে আত্মবিসর্জন করে! 

মনে পড়ে, অনেক বছর আগে একদিন শিবুর সঙ্গে নিবিড় করে ‘ওম’ নিয়ে কথা হচ্ছিল নিউ এলিফ্যান্ট রোডে বসে। ‘ওম’ অ্যালবামই কি মেঘদলের আত্মপ্রকাশ ছিল? সেই অ্যালবাম অনেকবার শুনেছি, তখন একটা আর্টিকেলও লেখার কথা ভেবেছিলাম। ঝোড়ো জীবনের চাপে আরও অনেক কিছুই না পারার মতো ‘ওম’ নিয়ে তখন লেখা হয়নি। অথচ মেঘদলের গান বাজনা-নিরীক্ষার দিকে একটা নজর আমার ছিল বা আছেই সবসময়। আহ! মেঘদল। এত সুন্দর মোহময় নাম একটা বাংলা গান-ব্যান্ডের, বাংলাদেশের, ব্যাপারটা একটা সুখ দেয় না? ‘টেস্ট অফ চেরি’ তো চেরির মতো, এখানে টেস্ট অফ বাংলা গান বা সেই গানের দলের লোকেদের গানমর্মের মনোভঙ্গিটা আঁচ করা যায়। 

‘ওম’ এর পরে অনেক মেঘ উড়ে গেছে ঢাকার আকাশ দিয়ে। এবং মেঘদল আরও পরিণত হয়েছে, আরও আত্মনিমজ্জন আত্মস্থ করেছে। এই মেঘ ঝরুক, এই মেঘ আরও বৃষ্টি হোক, সৃষ্টি হোক, আরও গান হোক। মেঘে ‘হোক কলরব’ হোক। হোকের পরে আর কি কি হতে পারে? কোক স্টুডিও তো হইছেই, ফোক স্টুডিও হয়তো আছে, আরও লোকজন নিয়ে লোক স্টুডিও হোক। অনেক কিছুই দেখব বলে আমাদের জন্যে একটা চোখ স্টুডিও হোক, দিগন্তে মেঘের ঝুঁকে পড়া দেখে ভালোবাসার কাছে আরও ঝুঁকে পড়তে চাই, তার জন্যে একটা ঝোঁক স্টুডিও হোক। কার্যকারণ সাপেক্ষে জোঁক স্টুডিও কি হতে পারে? সঞ্জীব চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে একটা স্টুডিও হতে পারে, ঢোক স্টুডিও। এই বসন্তে যে আসেনি, যার আসার কথা ছিল, যে আর আসবে না, তার  অনুপস্থিতিতে পুরো পৃথিবী একটা শোক স্টুডিও। কিন্তু কথা হচ্ছে কোক স্টুডিও নিয়ে। কোক স্টুডিও বাংলা, সিজন টু তে পড়েছে। টু’র টু নম্বরে এসে পুনরায় আমাদের মেঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পুনশ্চ মেঘদল উপস্থিত, এবার বোনাস, জহুরা বাউল। গানের শিরোনাম, বনবিবি...

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছোটবেলা পেয়েছি বলে সুন্দরবনের বনবিবি উপকথার সঙ্গে পরিচিত যারা, তাদের একজন তো আমিও। বিপদে বনবিবি রক্ষা করেন, এরকম ভাবনার বয়স হাজার বছর। অবশ্য গানের প্রারম্ভেই আমরা পরিচিত হই শিল্পী সুলতানের কৃষিবাংলা-ক্যানভাসের সঙ্গে; আমরা স্মরণ করে নিতে পারি বঙ্গবিদূষী কবি খনাকে। খনার বচনে বাংলার কৃষি পদ্ধতি ও গ্রামজনপদের যে দার্শনিক ন্যারেশন রচিত হয়ে আছে সেসবের ভেতর দিয়ে একটা জংলি সিকোয়েন্সে প্রবেশ করি বনবিবি’র গানের শুরুতেই। নৈঃশব্দ্য, নৈঃশব্দ্য ভেদ করে আসা বনজ শব্দসমগ্র, ঢেঁকিতে ধান ভানছে নারীরা, কুলোয় ঝাড়া হচ্ছে ধান_এক মানবজীবন পুড়িয়ে তৈরি কণ্ঠে হাঁক দেন জহুরা বাউল- ‘বনবিবির পায়ে রে ফোটে বুনো রোদের ফুল...’ এরপরেই তো খনার শ্লোক, বৃষ্টি আসবে, ব্যাঙ ডাকছে...আর তক্ষুণি শিবুর গলা সপ্রতিভ, আমরা দেখতে পাই ‘তামাটে কৃষাণীর ঘামে ভেজা মুখ’, তখন ‘লাল মেঘে বৃষ্টি হয়, আদিবাসী কোনও গ্রামে/ তোমার কান্না আমার কান্না ঝিরিপথ হয়ে নামে। ও ও ও পাখি ঠোঁটে তুলে নাও খড়কুটো গান/ ও ও ও রাখাল মিথ্যে বাঘের গল্প শোনাও।’ 

এইভাবে একটা গান পেলাম আমরা এই চৈত্রে, এর চেয়ে আর ভালো কিছু হয় না। যেন বা বাংলায় জমিলারা ঢেঁকিতে ধান ভানছে গানের তালে আর যেন বা সুবোধ মাঠে সুবাস ফলাচ্ছে হাজার বছর ধরে। আর্ট ডিপার্টমেন্টকে বলছি, তোরা এত কিছু দেখালি, খুব সুন্দর করে দেখালি, তাইলে সেটে একটা রিয়েল ঢেঁকি রাখলি না কেন? এস এম সুলতানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্বালে খুব জমে গেল আয়োজন। আমরা সাঁওতাল গ্রামের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকি, গান আমাদের নিয়ে যায়, মাঝি নোঙর ফেলেছে সোজন বাইদ্যার ঘাটে, বনবিবির গান আমাদের নিয়ে যায় সেই ঘাটে; আর লিরিকের এইখানে গিয়ে কী পাই আমরা? ‘বাঁশির সুরে ভাইসা আইল দূরে সুলতানের গাঁ/ মটর শাক পেচাইয়া ধরল নববধূর পা।’ 

আহ আহ আহ! মটর শাকের এই নববধূর পা পেচাইয়া ধরার দৃশ্যকল্পটি আমি আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতায়ও কখনো পড়িনি, গানে তো শুনিইনি। কী সুর আর কী লিরিক! কী অনবদ্য পরিবেশনা! যেন একটা অপেরা থেকে ছিটকে আসে আলো, একটা অর্ক্রেস্ট্রা থেকে ভেসে আসে সুর। মাদকতা সম্পন্ন একটা ঘোর তৈরি করে ফেলে, বারবার শুনি বনবিবি। বাংলা কবিতা থেকে গানে এসে যুক্ত হয় কোনও জাদুকরী পঙক্তি, যেন বা আরেকটি পালক এসে যুক্ত হয় ডানায়। আটলান্টার সালেমে উপশহর কিংবা পুরানা পল্টন বা বিউটি বোর্ডিং থেকে হয়তো শহীদ কাদরী একবার উঁকি দিয়ে যান, ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ কিম্বা ময়ূর নাচে আদিম তালে তালে/... এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবু মুক্তির ফুল ফোটে। ও ও ও পাখি ঠোঁটে তুলে নাও খড়কুটো গান/ ও ও ও রাখাল মিথ্যে বাঘের গল্প শোনাও... পৃথিবীর শেষ গানটা শোনাও...’

ঠিক এই সময় আমাদের পাঁজর চিরে দিয়ে যান জহুরা বাউল, এর আগে অর্ণবের ‘চিলতে রোদে’র মধ্যে বগার ‘ও কি একবার আসিয়া...ওরে ডাহুকী কান্দনে সই মুই...’ ভাওয়াইয়া ও হাসান হায়দার খানের সানাই যেভাবে পাঁজর চিরে গেছে সুযোগ নিয়ে! জহুরা বাউল যেন বা গগণবিদারী নাদ শুনিয়ে চিরে দেন আমাদের- ‘বনবিবির পায়ে রে ফোটে বুনো রোদের ফুল...’।  সার্জিক্যালি এই চিরে যাওয়া জোড়া লাগানো যাবে আবার? এর দায় কে নেবে? মেঘদল নেবে? 

লোকবাংলার শতবছরের চিত্র উঠে আসে বনবিবি গানে। সুলতান-জসীমউদদীন-জীবনানন্দ-আব্বাসউদ্দিন-জয়নুল চিত্রিত করেছেন বাংলাকে। একটি গানের ভেতর দিয়ে মেঘদল আমাদের কোথায় যেন নিয়ে গেল। যে বাংলাকে একদিন আমরা ফেলে এসেছি, ভুলেও গেছি। বনবিবি তা এক ঝটকায় যেন বা ফিরিয়ে দিল আবার। এবার যেন না হারাই! হারাব কেন? সুরে বাঁধা পড়ল তো! গানে ধরা পড়ল তো! 

আহ! কী ম্যাজিক! ছোটন, খুব ভালো হচ্ছে তোদের ভিজুয়াল, অবশ্য টিম তো পর্যাপ্ত শক্তিশালী!  এখন পর্যন্ত এদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শিবু, সুমন, শোয়েব, কিবরিয়া, আমজাদ, রনি ও সৌরভ_এই মেঘদেরকে আবার আমরা পাচ্ছি, আবার যেন পাই। পরাজিত মেঘ ঝরে পড়ুক, বৃষ্টি হোক। মেঘ ঝরলেই বৃষ্টি, খারাপ কি! খনার বচনের এমন সাংগীতিক প্রকাশ আগে শুনিনি। অনেক অনেক আনন্দ। অনেক অনেক ঘোর। ঘোরাচ্ছনতা কাটেই না। অতএব, পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো অর্ণবকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। তবে, শিবুই যে সুবোধ, তার দৃশ্যমান প্রমাণ দর্শক পাবে কিছুদিনের মধ্যেই। সুবোধ আগে গ্রামে কৃষি কাজ করত। কিছুটা লেখাপড়া জানাকে পুঁজি করে একদিন সে ঢাকায় চলে এসেছে। সিনেমা হলে টিকিট চেকারের চাকরি তার। সুবোধের বউয়ের নাম স্বপ্না, স্বপ্না রানী দাস। তারা আসে আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে, নারিন্দায়, ৩৬ ভূতের গলিতে, তারা ভাড়াটিয়া হয়ে জীবনযাপন করতে চায়। বাকিটা ‘কাঁটা’তে দেখা যাবে। খুব শিগগিরই দেখা যাবে ‘কাঁটা’। কিন্তু এখন আমরা আছি বনবিবিতে। 

বনবিবি গানটিতে বাংলা জনপদ উঠে এসেছে। মুগ্ধবৎই আছি। এর মধ্যেই হঠাৎ আমার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে একটি ইমেইজ পাঠাল এক তরুণ। সেই তরুণকেও সম্মান করছি আমি। একটি পেইন্টিং ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’, সুলতানের। যেখানে একজন পেশীবহুল আদি পুরুষ দুই হাতে একটি গাছের চারা রোপণ করছেন। আমার ম্যাসেঞ্জারে যে ইমেইজ এসেছে, সেখানে দেখলাম, আদিপুরুষের হাতে বৃক্ষ চারা নয়, কোকের বোতল। কী বলব আমি? কী বলতে পারি আমি? কিছু বলাবলির চেয়ে কি ভালো নয়, আরেকবার বনবিবি শোনা? ইউটিউবে আরেকবার দেখি, মটর শাক ক্যামনে পেচাইয়া ধরে নববধূর পা! আরেকটু বুঁদ হয়ে থাকি না! 

মেঘ ডেকে যাক, মেঘদল গান গেয়ে যাক...

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়