ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

সিদ্দিকবাজারে দুর্ঘটনা: ঢাকাবাসী কতটা নিরাপদ 

লিটন মহন্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ১১ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৩:৪৫, ১১ মার্চ ২০২৩
সিদ্দিকবাজারে দুর্ঘটনা: ঢাকাবাসী কতটা নিরাপদ 

বিগত এক দশকে ঢাকায় মানুষের বিস্ফোরণ ঘটেছে- চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ! এত মানুষের বসবাস বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা যুক্তিযুক্ত? তারপরও ঢাকামুখী মানুষের ঢল থামানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, রাজধানীকে বসবাসের উপযুক্ত করতে হলে অবশ্যই এখান থেকে জনগণসহ অনেক স্থাপনা অন্যত্র সড়াতে হবে। কিন্তু কে শুনছে কার কথা!

অতি সম্প্রতী ঢাকায় দুটি বিস্ফোরণ এবং চট্টগ্রামে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব ঘটনায় অনেক মানুষ নিহত এবং আহত হয়েছেন। সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনায় গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে তিতাস গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। গ্যাসের লাইনে লিকেজ ছিল, বদ্ধ ঘরে গ্যাস জমা হয়ে একটা গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে, পরে সেখানে সামান্য স্পার্কে বিস্ফোরণ ঘটে। এ পর্যন্ত এই ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। 

স্বভাবতই ঘটনার শুরুতে জনমনে প্রশ্ন ছিল- এটা কি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে কোনো নাশকতার আলামত খুঁজে পাননি। যদি তিতাস গ্যাসের লিকেজের মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এক্ষুণি আমাদের সর্বচ্চো সতর্কতায় যেতে হবে এবং প্রতিনিয়ত লাইনগুলো চেক করে যেখানে বিন্দুমাত্র সমস্যা রয়েছে সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত টিম গঠন হয়, তারা তদন্ত করে সুপারিশও করেন। কিন্তু সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা সহজেই অনুমেয়। ঢাকা শহরে প্রচুর স্যুয়ারেজের লাইন রয়েছে, সেখানে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার টন মল-মূত্র যোগ হয় এবং সেখান থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দিতে হবে- না হলে এটিও কম বিপদ ডেকে আনবে না। একবার ভাবুন, আপনার পেটে গ্যাস হচ্ছে। গ্যাস কমানোর ওষুধ খেয়ে চাপ নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু ঢাকা শহরের পেটে যে প্রতিনিয়ত গ্যাস জমছে, তার ব্যবস্থা কে গ্রহণ করবে? 

মিথেন গ্যাসের প্রকৃতি হলো বর্ণ ও গন্ধহীন মারাত্মক দাহ্য পদার্থ যা অক্সিজেনের চেয়ে হালকা। বদ্ধ স্থানে এই গ্যাস অক্সিজেনকে হটিয়ে স্থান দখল করে। এ ছাড়াও নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, সালফাইড, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি গ্যাসও বর্জ্যস্থল থেকে বের হয়। যেগুলো কোনো কোনো জায়গায় ৩০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত আটকে থাকতে পারে এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। 

এ কারণে আসুন গ্যাস সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা অর্জন করি। ১৮৫৭ সালে বিজ্ঞানী বার্থেলো পরীক্ষাগারে সর্বপ্রথম কার্বন ও হাইড্রোজেন থেকে মিথেন নামে জৈব যৌগ তৈরি করেন। মিথেনের একটি অণু একটি কার্বন পরমাণু এবং চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে গঠিত হয়। এটি অ্যালকেন বা প্যারাফিন সমগোত্র শ্রেণীর প্রথম যৌগ। মিথেন একটি সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন। মিথেন প্রথম আবিষ্কার করেন আলেসান্দ্রো ভোল্টা ১৭৭৬ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন কর্তৃক লেখা প্রজ্বলনীয় বাতাস পড়ার পর ঐ প্রজ্বলনীয় বাতাস অনুসন্ধান করার জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গিয়েছিলেন মাগিওরি নামক এক জলাভূমিতে। ভোল্টা জলাভূমি থেকে ঊর্ধ্বগামী গ্যাস সংগ্রহ করেন এবং ১৭৭৮ সালে মিথেনকে একক গ্যাস হিসেবে পৃথক করেন। তিনি একটি বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ দিয়ে এই গ্যাস প্রজ্বলিত করার উপায় প্রদর্শন করেন। আসলে বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কার হয় মূলত মানুষের কল্যাণে কিন্তু সেটা সঠিক প্রয়োগ না হলে সাধারণ মানুষের জন্য তা অভিশাপ ডেকে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশেও মিথেন গ্যাসের মাধ্যমে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডভান্স ইকোটেক ইউকে লিমিটেড’এর পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরামর্শক ড. নাসির খান জানান, কোনো জায়গায় স্তূপ করে গৃহস্থালি বর্জ্য ফেললে তা থেকে ৭ থেকে ১০ দিন পর নানা ধরনের গ্যাস নির্গত হয়। যাকে বলা হয় ল্যান্ডফিল্ড গ্যাস। এর মধ্যে ৯০ থেকে ৯৮ ভাগই হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেন। প্রাকৃতিক গ্যাসেও ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যন্ত মিথেন গ্যাস থাকে। এর মধ্যে মিথেনকে বিবেচনা করা হচ্ছে বিপজ্জনক গ্যাস হিসেবে। বর্জ্য ফেলার স্থান বা আবর্জনার ভাগাড় ভরাট করে দালানকোঠা বা স্থাপনা নির্মাণ করলে মেঝেতে বা অন্য যে কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে মিথেন গ্যাস ঘরের ভেতর জমা হতে থাকে। এই ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রতিদিন আনুমানিক আধা কেজি হিসেবে এক কোটি কেজি তথা ১০ হাজার টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপন্ন করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল কৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়- বাসা বাড়িতে লাইনের গ্যাস কিংবা এলপিজি গ্যাসের লিকেজের সাথে আবদ্ধ রুমে জমে থাকা চার মাত্রার বেশি মিথেন গ্যাসের সাথে আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে সুয়ারেজ লাইনের ত্রুটির কারণেও মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।

সুতরাং আমরা বলতে পারি ঢাকাবাসী বিরাট ঝুঁকির মধ্যে মিথেন গ্যাস চেম্বারের উপরিভাগে বসবাস করছে। এত দিন বিষয়টি তেমনভাবে আমাদের ভাবায়নি কিন্তু এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে গিয়েছে। তবে এই দুটি ঘটনায় একটি জায়গায় মিল পাওয়া যায়- বিস্ফোরিত বিল্ডিং দুটিই পুরাতন। ফলে অতি দ্রুত এই শহরে যত পুরাতন বিল্ডিং আছে, সেগুলোর গ্যাস লাইন চেক করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত গ্যাস লাইন চেক করা, সুয়ারেজের লাইন হতে মিথেন গ্যাস বের হচ্ছে কিনা মনিটরিং করা এবং বর্তমানে যে সব নতুন বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে সেখানে সুয়ারেজের বা সেফটি ট্যাংক হতে গ্যাস বের হওয়ার লাইন তৈরি নিশ্চিত করা। 

নাগরিক জীবনে গ্যাসের লাইন, পানির লাইন, বিদ্যুতের লাইন, বর্জে্যর লাইন বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ। সুতরাং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এটা একটা ফুল সিস্টেম। সিস্টেমের একটা জায়গায় সমস্যা হলে পুরোটাই বন্ধ হয়ে যাবে। ঢাকা শহরের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? সরকার, নাকি আমরা সকলে! আমরাই তো সরকার, আমরাই তো জনগণ। এই দেশ আমাদের, এই রাজধানী আমাদের। ফলে কোনো এলিয়েন এসে এই সিস্টেম ঠিক করে দিয়ে যাবে না। এই সহজ সরল সমীকরণ আমাদের আগে বুঝতে হবে। 

আরেকটি কথা, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ভাবছেন এর মধ্যে নাশকতার গন্ধ আছে কিনা! ভাবাটা স্বাভাবিক! আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এ বিষয়ে আর্ন্তজাতিকমানের এবং সময় সাপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া উচিত।  সেক্ষেত্রে দেশের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী বা গবেষকদের কাজে লাগাতে হবে। কারণ এ ধরনের দুর্ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে ল্যাবরেটরির ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি।   

লেখক: বিজ্ঞান গবেষক ও গল্পকার  
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়