ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

এ দেশেতে জন্ম আমার এ দেশেতেই মরি

জাফর ওয়াজেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫০, ১৭ মার্চ ২০২৩  
এ দেশেতে জন্ম আমার এ দেশেতেই মরি

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শাসক বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবকে। তাঁর ঘোষিত ছয় দফা দাবি বাঙালীর বাঁচার অধিকারে পরিণত হয়ে গেছে তত দিনে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে হাজারো জনতা অপেক্ষমাণ, কখন তিনি বেরিয়ে আসবেন। অবশেষে নেতা প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলেন হাজারো জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্য দিয়ে। ফটকের সামনে দাঁড়ানো নেতা নত হয়ে হাতের মুঠোয় মাটি তুলে কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলেন তাঁর প্রিয় কাব্যগীতির সেই লাইন, ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’ তিনি এই দেশের মাটিতেই শায়িত হয়েছেন। পাকিস্তানী জান্তা শাসক একাত্তরে পাকিস্তানী কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে কবরও খুঁড়ে রেখেছিল। কিন্তু তাদের সাহসই হয়নি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর। বিশ্বের চাপে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানী নরাধম শাসক গোষ্ঠী। যে ঔদ্ধত্য পাকিস্তানীরা দেখাতে পারেনি, বাঙালী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী মানসজাতরা সেই ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে এই বাংলায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোররাতে।

শেখ মুজিবের বিশ্বাসবোধে কখনও এমনটা নাড়া দেয়নি যে, কোনো বাঙালী তাঁকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান প্রত্যাগত বাংলাভাষীরা নির্মম, নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সামান্য দ্বিধা করেনি। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিতে পেরেছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য স্বাধীনতার পর একাধিক গোষ্ঠী তৎপর ছিল। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধুর নেতিবাচক ভাবধারা গড়ে তোলায় সেদিন যারা সচেষ্ট ছিল, কালপরিক্রমায় তারা আজ ইতিহাসের ডাস্টবিনে পড়ে আছে, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিশ্চিহ্ন হননি।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন পুরোপুরি বাঙালী। চেতনায় বাংলার আকাশ, মাটি, জলবায়ু, ফুল, ফল সবই ঘিরেছিল। রবীন্দ্রনাথের বাউলাঙ্গের গানটি খুবই পছন্দের ছিল মহাত্মা গান্ধীর।
একই গান প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুরও। গুনগুনিয়ে গাইতেনও তিনি। গান শোনা এবং আপন মনে গেয়ে ওঠার একটা বোধ ও ধারা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল। কারাগারেও বোধহয় গেয়ে উঠতেন পূর্বশ্রুত প্রিয় গানগুলো। রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...’ গাইতেন তিনি। এই গান তাঁর জীবন-যাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল বৈকি। একলাই চলেছিলেন তিনি স্রোতের বিপরীতে। পিছু ডাকে থামেননি বরং নদীর ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়ে গেছেন সামনে। তীরের পানে। একাকী মানবের মতো তিনি সহজ-সরল জীবনাচারে ছিলেন অভ্যস্ত। সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াতেন জান্তা শাসকের হুমকির মুখেও। নিজ সিদ্ধান্ত থেকে কেউ তাঁকে পারেনি টলাতে।

আরো পড়ুন:

বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে মানুষের সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখে মুখে তাদের আপনজন হিসেবে থেকেছেন। দলের জাঁদরেল নেতারা দল ছেড়ে পাল্টা দলগঠন করলেও বঙ্গবন্ধু মূলধারা থেকে সরে যাননি। একাই দল পুনর্গঠন করেছেন। দলকে সংগঠিত করেছেন সারা বাংলায়। সত্তর সালের নির্বাচনে তিনি অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধেননি। বলেছেনও অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাই তাঁকে জোট গঠনে আগ্রহী করেনি। বাঙালীর মুক্তির কর্মসূচী দ্বিতীয় বিপ্লব তথা বাকশাল কর্মসূচী ঘোষণা করে তিনি অনেকদূর এগিয়ে যান। কিন্তু দল তাঁর সঙ্গে সমানতালে যেতে পারেনি বরং দূরত্ব বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর যে অঙ্গুলি হেলনে তারা স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে যুদ্ধে পর্যন্ত গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারই নামে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তারা বোধহয় স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে আর অনুধাবন করতে পারেননি। ‘যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই’ বলে তারা আত্মস্বার্থে বলীয়ান হওয়ার পথে ছিলেন মত্ত। 

বাঙালী জনগণ বুঝি সহস্র বছরের সাধনা শেষে পেয়েছিলেন তাদের অবিসংবাদিত নেতাকে। যে নেতার জন্ম না-হলে এদেশ স্বাধীন হতো না। পাকিস্তানীদের ফাই ফরমায়েশ খেটে যেতে হতো বাঙালীদের। কিন্তু শেখ মুজিব বাঙালীকে একটি রাষ্ট্র, একটি পতাকা এনে দিয়েছেন। এ জন্য তাকে লড়াই-সংগ্রামের পথ ধরতে হয়েছিল। কারাগারে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। সমকালীন সব নেতাকে ছাপিয়ে তিনি অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ভুখা, নাঙ্গাসহ দরিদ্র এবং কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। তাই সংগঠনের নাম শুধু আওয়ামী লীগ থেকে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। শিক্ষিত সমাজসহ রাজনীতিকদের একটা অংশ তাঁর বিরোধিতায় ছিল উদগ্র। প্রতিহিংসা আর পরশ্রীকাতরতায় আবিষ্টরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি। টুঙ্গিপাড়ার মতো সেকেলের অজপাড়াগাঁয়ের যুবকটি তরতরিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে জনগণের মাঝে নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তোলার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেননি তারা। তাই শেখ মুজিবকে এসব বিরোধিতা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আর এ এগিয়ে যাওয়ার পথে পথে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। জনগণ ক্রমশ তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে বলেই তিনি সাহসের সঙ্গে চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু একলাই চলেছেন। জীবনের শেষ কারাগারে কাটিয়েছেন একাকী পাকিস্তানে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি।

শেখ মুজিব মানব মুক্তির কর্মসূচি দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দল ও নেতারা তা অনুধাবন করতে পেরেছে, এমন নয়। যদি পারত তবে ইতিহাসের ঘটনা অন্যভাবে মোড় নিত। দলের নেতৃবৃন্দের উদাসীনতা, নির্বিকারত্ব বঙ্গবন্ধুবিরোধী পরিস্থিতিকে শক্তিশালী হওয়ার পথ করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশবাসীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দেশের সাধারণ মানুষ এতে সাড়া দিলেও শিক্ষিতজন ও বাম রাজনীতিকদের দল ও গ্রুপগুলো মুজিব বিরোধিতায় ছিল উচ্চকণ্ঠ। থানা ফাঁড়িতে হামলা, অস্ত্র লুট, খাদ্য ও পাটের গুদামে অগ্নিকাণ্ড, সেতু, কালভার্ট ধ্বংস করা শ্রেণীশত্রু খতমের নামে আওয়ামী লীগের এমপি ও কর্মী হত্যার কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলো রচিত হতে থাকে বাহাত্তর সাল থেকেই। অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশলে পূর্ণ ছিল বাম ধারার রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ।

বিশেষত চীনাপন্থীরা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী নামধারী গণবাহিনী শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের জন্য ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে, বাম বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসা দূরে থাক, কোনো দিকনির্দেশনাও দেয়নি। তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লাগামহীন তুচ্ছ সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছিল। কোনো গঠনমূলক সমালোচনাও তারা করেনি। এদের সম্পর্কে লেখক অধ্যাপক আবদুল হালিম লিখেছিলেন, ‘আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জীবনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো যে গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সর্বাংশে গণমুখী সরকার গঠিত হয়েছিল, তার বাণী ও তাৎপর্য বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। সে দায়িত্ব পালনে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষিত সুবিধাবাদী শ্রেণীর একাংশ; বিশেষত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের বৃহত্তম অংশ বাহাত্তরের শেষ দিক থেকে শুরু করে সাধ্যমতো বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিষোদগার করেছেন, একটা সদ্য স্বাধীন দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে এমন আচরণ স্বাধীনতার পিঠে ছুরিকাঘাতের মতোই নিকৃষ্ট কাজ।’ 

তিনি এমনও উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পরেও দেশের ব্যাপকসংখ্যক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতির তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিকাশের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পদ্ধতির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।’

তার এই ভাষ্য প্রমাণ করে মুজিববিরোধীদের হীনমন্যতা এবং ষড়যন্ত্র চর্চা। অবশ্য বঙ্গবন্ধু আজীবনই ছিলেন ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্যবস্তু। যেমন একালে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। আমৃত্যু দুইজনকেই একা লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী শাসক এবং দেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের মূল্যায়ন ছিল অভিন্ন। তারা বঙ্গবন্ধুকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছিল এবং তাকে হটকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, র‌্যাডিকাল, বামপন্থী ইত্যাদি বিশেষণে বিধৃত করেছিল।

সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা তাকে ইসলামবিরোধী অভিধা দিয়েছিল বামেরা তাকে ডানপন্থী, সিআইয়ের দালাল, সমাজতন্ত্রবিরোধী বলে প্রচার চালাত। আর ডানপন্থীরা তাকে সমাজতন্ত্রী হিসেবেই চিহ্নিত শুধু নয়, ‘ভারতের পুতুল’ বলে গলা ফাটাত। কথিত বুদ্ধিজীবীরা সেমিনারের ভাষণে যেমন, তেমনি প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ সংবাদপত্রে কলাম লিখে এবং গ্রন্থ প্রকাশ করে শেখ মুজিবকে হেয় করার যত ভাষা আছে সবই প্রয়োগ করতেন। সত্যের লেশমাত্র যেখানে ছিল না।

বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তর পর্যন্ত টানা তিন বছর লাগামহীন অপপ্রচারের শিকার হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। আওয়ামী লীগ এসবের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। এসব প্রচারণায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। সরকার পরিচালিত ট্রাস্টের সাপ্তাহিক পত্রিকাটিও মুজিব বিরোধিতায় এক পা খাঁড়া থাকত। বিদ্বেষধর্মী বাক্যেপূর্ণ থাকত তাদের রচনা। তাদের সেসব কল্পনাপ্রসূত, বিদ্বেষপূর্ণ, অলীক, হালকা, বায়বীয় লেখা ও আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়ন করা হতো কার্যতভাবে। যেমন ‘আরণ্যক দৃশ্যাবলী’ নামক গ্রন্থে প্রথিতযশা বামমার্গীয় শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ‘যে পথে তিনি (শেখ মুজিব) অগ্রসর হচ্ছিলেন তাতে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছিল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা চান। শোনা যায় দেশে যত না বিদেশে ততধিক বিত্তবৈভব গড়ে উঠেছিল তার ও পরিবারের।’ ভদ্রোচিত মোড়কে মিথ্যাচার কেমন হতে পারে, এই তার নমুনা। বিদেশে বৈভবের কোন প্রমাণ দিতে পারা না গেলেও মিথ্যা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষাবিদের এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছিলেন আরও অনেক প্রথিতযশারা। কার্যত তারা মাঠে নেমেছিলেন।

দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর সকল প্রচেষ্টাকে মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের নিচে চাপা দেয়ার ঘৃণ্য প্রয়াস দেখা গেছে সে সময়। স্বাধীনতার পর সন্ত্রাস, নাশকতা, হত্যাযজ্ঞ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরা ছিলেন পুরোপুরি নীরব। তারা সম্ভবত এমনটাই চাইতেন। স্বাধীনতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে তারা কোন বাক্যই উচ্চারণ করেনি। তাদের সকল আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কুৎসার ধরন কত প্রকার হতে পারে, এসবই তার নিদর্শন বৈকি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই একই ব্যক্তিরা মনগড়া, স্ববিরোধী, ভ্রান্তিপূর্ণ ও কাল্পনিক আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো’ করার প্রয়াস পান সামরিক জান্তা শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায়। 

এনায়েত উল্লাহ খান, যিনি বাকশালের সদস্য ছিলেন এবং সংবাদপত্রের সংখ্যা হ্রাসের পরিকল্পক, তিনি ছিলেন উগ্র ও কট্টর মুজিববিরোধী। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি যা লিখেছেন তা অভব্যতায় পূর্ণ। লিখেছিলেন এই খান, ‘ব্যক্তিত্বের অপরিমিত শৌর্য ও অনুকূল ইতিহাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তার রাজকাহিনী। তিনি ছিলেন রূপকের রাজা। ... পরদেশী পটুয়ার হাতে সৃষ্টি হলো পুতুলের রাজা, শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন দক্ষ নট। অভিনয়ের চাতুর্যে প্রতিটি নাটকীয় মুহূর্তে দর্শকবৃন্দের তুমুল করতালি কুড়িয়েছেন, বাগ্মীতার  সন্মোহনে বিদ্রূপের মায়াজাল রচনা করেছেন।’ 

আবার লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বুর্জোয়া ও মুৎসুদ্দীদের নেতা।’ তার পুরো লেখাটি পাঠে স্পষ্ট হবে শেখ মুজিবকে নিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্তদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল বাহাত্তর হতে। স্থূলতায় পূর্ণ এসব অপপ্রচার জনগণকে ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করেছিল একসময়ে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামী লীগে বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছড়িয়ে পড়েছিল। দলের উগ্র ও কট্টরপন্থীরা ‘মুজিববাদ’ নামক স্লোগান দিয়ে এক অরাজক অবস্থা তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু এই ‘মুজিববাদ’-কে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য সেদিন উঠেপড়ে লেগেছিল প্রগতিশীলরাও। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর সময়ের চেয়েও অনেক দূর এগিয়েছিলেন। কিন্তু তার দলের নেতারা সেই পথে বেশি দূর যেতে পারেননি। ঘাতকরা যে দলের মধ্যেই ঠাঁই পেয়েছিল, সে তো অজানা নয় আজ আর কারও কাছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু হত্যার নেপথ্যে যে ষড়যন্ত্র, তার কোনো কিছুই উদ্ঘাটন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে চোখের জল সংবরণ করতে পারিনি। ডিএল রায়ের সেই গান যা বঙ্গবন্ধু গাইতেন ‘... এই দেশেতে মরি’ মনে এলো। সেই সঙ্গে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানের সুর কানে বাজতে থাকে। বঙ্গবন্ধু আছেন এই দেশের মাটিতে মিশে, থাকবেনও বাঙালীর মনে ও মননে।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়