মে দিবস: কে শুনবে নীরব কান্না?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতায় আছে: ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন, সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে।’
দেশের শিক্ষিত পেশাজীবীদের একটির অংশের অবস্থা একেবারে ঠিক এমন বলা যাবে না। তবে কতটা সুখী জানতে চাইলে বিষয়টি কোনো মতে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর উপায় থাকে না। সংসার চালাতে কষ্ট হয় কিন্তু সামাজিক অবস্থার কারণে কাউকে বুঝতে দেয় না। নিজেদের আয় রোজগারের সঙ্গে মিল রেখে সমাজ-সংসার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের জীবনে প্রতিদিন অনেক কষ্টের গল্প তৈরি হয়।
মে দিবস উপলক্ষে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভা, সেমিনার, র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির লেখালেখিতে, গণমাধ্যমের অনুষ্ঠানে ও সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচিতে মূলত সাধারণ শ্রমজীবী ও কায়িক পরিশ্রমী মানুষের কথাগুলোই প্রাধান্য পায়। শিক্ষিত পেশাজীবীরা অনেক সময় সেসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে অথবা অনেক সময় তাদের উপস্থিত থাকতে হয় শ্রোতা হিসেবে। কিন্তু নিজেদের কথা নিজেরা তারা বলতে পারেন না, আবার অন্যরাও বলেন না। ফলে তাদের জীবনের গল্পগুলো সবসময় সবার অগোচরে থেকে যায়।
সরকারি বা বিভিন্ন বেসরকারি পর্যায় থেকে সাধারণ শ্রমজীবী, কায়িক পরিশ্রমী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে সরকার তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাতার ব্যবস্থা করেছে। দেশের অনেক অঞ্চলে শতভাগ ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে অর্থাৎ সেখানে এমন কোনো লোক নেই যারা ভাতা পান না। সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ডিলারদের মাধ্যমে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে। পাশাপাশি টিসিবি তার কার্ড হোল্ডারদের মধ্যে নায্যমূল্যে চাল ও আটা বিক্রিসহ ট্রাকের মাধ্যমে প্রায় সারা বছর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কম মূল্যে বিতরণ করে থাকে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে ভালো আছে সেটা বলা যায় না, তবে তারা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে কোনো মতে জীবন পার করতে পারে। কিন্তু দেশের অনেক লোক বিশেষ করে শিক্ষিত পেশাজীবীদের একটা অংশ যারা মান সম্মানের কারণে পণ্য কেনার জন্য ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানোসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে পারেন না। যে কারণে অনেক সময় তাদের পরিবার নিয়ে অর্ধভুক্ত থাকতে হয়। স্বল্প আয় দিয়ে জীবনের সব কিছু ম্যানেজ করতে যেয়ে প্রতিদিন অনেক কষ্টের গল্প তৈরি হয়। এ সব শিক্ষিত পেশাজীবী শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতসহ অনেক।
স্বল্প আয়ের শিক্ষিত পেশাজীবীদের মধ্যে অন্যত্তম বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দ। সারা দেশে এমন অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। অনেকগুলো আবার সরকারি ভাতা পাওয়ার ও এমপিওভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মফস্বলের বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। সেখানকার শিক্ষকরা নামমাত্র সামান্য কিছু বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন, অনেকে আবার কিছুই পান না। এই শিক্ষকরা মূলত গৃহ শিক্ষকের কাজ, পৈত্রিক সম্পত্তি, নিজস্ব ব্যবসা ও অন্যান্য কাজের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
যাদের এগুলো নেই, তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ঢাকা শহরে অনেক বেসরকারি স্কুল আছে, যারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাত উল্লেখ করে বড় অঙ্কের টাকা নেয় কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থাটা উল্টো। অধিকাংশ স্কুল শুরুতে শিক্ষকদের ৪-৫ হাজার টাকা বেতন ধরে, নামকরা অনেক স্কুল ৮-১০ হাজার টাকা এবং আরও অনেক নামকরা স্কুলগুলো একটু বেশি বেতন দিয়ে শুরু করে। ঢাকা শহরের এই স্কুলগুলোর শিক্ষকদের মূলত গৃহ শিক্ষকের কাজ ও শিক্ষার্থী পড়িয়ে জীবনযাপন করতে হয়।
দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। প্রায় ছয় লাখের মতো শিক্ষক ও কর্মচারী যারা মান্থলি পে-অর্ডার বা মাসিক বেতন আদেশের মাধ্যমে সরকারের নিকট থেকে বেতন পান। একজন সাধারণ শিক্ষক স্কুল বা মাদ্রাসায় যোগদান করার শুরুতে বেতন পান ১২,৭৫০ টাকা। বিএড থাকলে আরও কয়েক হাজার বেশি পান। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি পায় এবং একজন সাধারণ শিক্ষকের অবসরের সময় বেতন দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার টাকা। সরকারি স্কেল অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক বেতন পায় ৩৩-৩৪ হাজার টাকা। ঈদ উৎসব ভাতা শিক্ষকদের জন্য বেতনের ২৫ শতাংশ আর কর্মচারীদের জন্য বেতনের ৫০ শতাংশ। পহেলা বৈশাখে ২০ শতাংশ হারে উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন।
এমপিওভুক্ত স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। পাঠ্যক্রম সিলেবাস, আইন এবং একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হলেও শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য। অধ্যক্ষ থেকে কর্মচারী পর্যন্ত নামমাত্র ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি হলেও অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য প্রতি মাসে বেতনের ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। তবে বৃদ্ধ বয়সে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা যথাসময়ে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই।
দক্ষ জনশক্তি তৈরির কারিগর শিক্ষকদের বঞ্চিত করে, তাদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ নাকরে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য টেকসই হবে না বলে তারা মনে করেন। দাবিদাবার প্রশ্নে শিক্ষকরা এখন বলছে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করা হলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ না হলে সরকার এগুলো বন্ধ করে দিক, কেননা তারা আর পারছে না।
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার এক স্কুলের শিক্ষক জানান এবার ঈদ করতে পারেনি। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে সারাদিন বাড়িতে ছিলেন। ঈদের বোনাস পেয়েছিলেন ৩০০০ টাকা, সন্তানের চিকিৎসার জন্য অধিকাংশ বোনাসের টাকা খরচ করাতে তিনি কিছুই কিনতে পারেননি, ঈদও হয়নি। ভাইবোন তো দূরের কথা, অসুস্থ পিতা-মাতাকেও কিছু টাকা দিতে পারেননি।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার এক সিনিয়র শিক্ষক জানান তার চাকরি আর মাত্র এক বছর আছে এবং মাসে বেতন পান ২৬ হাজার টাকা। সংসারে সব সময় টানাটানি লেগে থাকে। বয়স বাড়ার কারণে প্রতিদিন নিজের ও স্ত্রীর জন্য কিছু ওষুধ লাগে, দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে মাস চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমপিওভুক্ত নয় এমন এক স্কুলের শিক্ষক জানান স্কুল থেকে প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকা পায়। বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে একটি মুদিখানার দোকান খুলেছেন কিন্তু পুঁজির অভাবে সেটাও চালাতে পারছেন না। গত কোরবানীর ঈদে বাসায় গরুর মাংস রান্না হয়েছিল, তারপর আর হয়নি। সে মাংসটুকুও ছিল মসজিদ থেকে পাওয়া। মাসে দুই-একবার বাসায় বয়লার মুরগির মাংসের আয়োজন এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ আমাদের দেশে মোট জিডিপির দুই শতাংশের কম শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। অনেকের মতে সরকার শিক্ষা খাতের ব্যয় কিছুটা বাড়িয়ে শিক্ষকদের দুঃখ কিছুটা কমাতে পারে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিতে চাকরিরত অনেকের অবস্থা প্রায় একই রকম। কিছু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছাড়া অধিকাংশই বেতন কাঠামো ও নিয়মনীতি অনুসরণ করে না। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী মনিটারিং না থাকায় তারা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকের মতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর কোনো পণ্য বা বা সেবা কিনতে যে টাকা খরচ করতে হয়েছে, এখন তার তুলনায় অন্তত সাড়ে সাত শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়। বাস্তবে এই খরচ আরও বেশি। গত পাঁচ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া ডাল, আটা, খোলা সয়াবিন তেল ও ডিমের দাম অনেক বেড়েছে। যে হারে পরিবহন ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে তাদের বেতন বৃদ্ধি পায় না। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরী পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এটা কেউ না মানায় তাদের জীবন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অনেকে কোম্পানির সেলস এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করে, যাদের সারা দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতে, অথচ বেতন ৬-৭ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে।
আলাপকালে অনেক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য কিছু অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় মেটানোর জন্য বেতনের প্রায় পুরো অংশটাই মাসের শুরুতে খরচ ফেলেন। বাকি পুরো মাসটা অনেক টানাটানি ও কষ্টের মাধ্যমে পার করতে হয়। অনেকে ঢাকায় সংসারের খরচ মেটাতে না পেরে পরিবার এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে মেসবাড়িতে অবস্থান করছেন। একজন সদ্য বিবাহিত বেসরকারি চাকরিজীবী জানান- সংসারের খরচ মেটাতে পারব কি না, এই ভয়ে বিয়ের পরও ব্যাচেলর বাসায় আছি।
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা মোট দুই হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে দেশি এনজিওর সংখ্যা দুই হাজার ২৮৯টি ও বিদেশি এনজিও’র সংখ্যা ২৬৫টি। এছাড়া নিবন্ধনের বাইরে অনেক এনজিও আছে। বিদেশি ও দেশের প্রতিষ্ঠিত এনজিও গুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো বলা যায়। তবে মাঝারি, ছোট ও নিবন্ধন বহির্ভূত এনজিওতে যারা কাজ করেন তাদের সংসার চালাতে বেশ চাপে থাকতে হয়। পরিশ্রমের তুলনায় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম। এনজিও গুলোতে প্রজেক্ট ভিত্তিক এবং পার্মানেন্ট বা স্থায়ীভিত্তিক এই দুই ধরনের কর্মী দেখা যায়। প্রজেক্ট ভিত্তিক কাজগুলোতে কর্মীরা চুক্তি ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়। প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হলে তারা নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। তারপর ইদানিং প্রকল্পের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা আরও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এনজিওতে বেতন কাঠামো নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ও সক্ষমতার উপর। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে এন্ট্রি লেভেলে বেতন কম থাকে কারণ আদর্শগতভাবে এনজিও কোনো ব্যবসায়িক লাভের জন্য কাজ করে না। তাই এনজিওর লক্ষ্য থাকে কর্মীদের যত কম বেতন দিয়ে অবশিষ্ট অর্থ উন্নয়নের কাজে লাগানো যায়। বেশিরভাগ এনজিওতে পদোন্নতি সময় ভিত্তিক না হয়ে পারফর্মেন্স ভিত্তিক হয়ে থাকে। তাই, অন্যান্য সেক্টরের মত এখানে একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করলেই পদোন্নতির নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না যে কারণে অনেকে সমস্যায় পড়েন।
অনেকের অভিযোগ এনজিও ব্যুরোর নিয়মানুযায়ী প্রতিটি প্রকল্পের ১৫ ভাগ টাকা প্রশাসনিক ব্যয়ের জন্য রেখে বাকি ৮৫ ভাগ টাকা কর্মসূচির কাজে ব্যয় করতে হয়। অথচ এমনও দেখা যায়, প্রকল্পের বরাদ্দের একটা বড় অংশ পরিবহন ও দেশি- বিদেশী কর্মকর্তা উপদেষ্টাদের পেছনে খরচ করতে হয়। এর ফলে স্থানীয় কর্মচারীদের পেছনে এবং টার্গেট গ্রুপের জন্য ব্যয়ের পরমাণ কমে যায়।
আমাদের দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো সুন্দর মসজিদ নির্মাণের জন্য তারা অনেক অর্থ দান করেন তবে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের স্বচ্ছলে চলার মতো অর্থ দিতে তারা রাজি নয়। আমাদের মধ্যে যে সামাজিক ঐক্য নষ্ট হচ্ছে তার বড় প্রমাণ মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় এমনি কি গোত্রে গোত্রে মসজিদ তৈরির প্রতিযোগিতা। একে অপরকে টপকে কিভাবে দামী পাথর বা টাইলস দিয়ে ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র স্থাপন করে মসজিদের জৌলুস বাড়ানো যায় চলে সেই প্রতিযোগিতা। এক সময় এক গ্রামে বা এলাকায় দুই-একটি মসজিদ ছিল। সবাই জামাত সহকারে নামাজ পড়ত, সামাজিক ঐক্য ছিল। এখন মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সৎ লোকের সংখ্যা কমেছে। মসজিদ বৃদ্ধির পেছনে অনেকেই জনসংখ্যা ও নামাজি বৃদ্ধিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চান। কিন্তু আমি মনে করি, কখনোই জনসংখ্যা ও নামাজি বৃদ্ধির প্রধান কারণ এটি নয়। সামাজিক ঐক্য থাকলে মসজিদের আয়তন বড় করে বাড়তি লোক ম্যানেজ করা যায়।
মসজিদের ইমামরা সমাজের সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত অথচ তাদের বেতন এক অর্থে অসম্মানের। এক রাতের মাহফিলের জন্য লাখ টাকা খরচ করে বক্তা আনা হয়, লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু যারা সারা বছর ইসলামের বাণী শুনায় এবং নামাজ পড়ায়, তাদের বেলায় যত কৃপণতা। মসজিদ কমিটি থেকে দেওয়া অর্থে তাদের মাস চলে না। অভাব-অনটন সবসময় লেগেই থাকে। অধিকাংশের মসজিদ লাগোয়া একটি ছোট্ট ঘর অথবা মসজিদেই জীবন চলে। দুটি লুঙ্গি, একটি পাজামা আর দুটি পাঞ্জাবিতে বছর পার।
ইদানিং সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সিটি করপোরেশনের অধীন মসজিদগুলোর ইমাম-মুয়াজ্জিনরা কিছুটা সম্মানজনক বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। বর্তমানে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০ টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করেছেন। এ সব মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেতন পাবেন।
তবে দেশের বাদবাকি মসজিদগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ২০০৬ সালে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ প্রণয়ন করলেও বাধ্যবাধকতা না থাকায় অধিকাংশ মসজিদ কমিটি এসব কোন নিয়ম মানে না।
রাজধানীতে গড়পড়তা ইমামদের মাসিক আয় ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। আর মুয়াজ্জিনদের সর্বোচ্চ আয় ১৫ হাজার টাকা। অধিকাংশ মসজিদে মুয়াজ্জিনের সম্মানি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। রাজধানী ঢাকায় মোটামুটি মানের দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ থাকতে প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। যে কারণে অনেকে পরিবার গ্রামের বাড়িতে রাখেন।
অন্যদিকে গ্রাম বা মফস্বলের ইমামদের বেতন ২ থকে ৫ হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মসজিদ কমিটি সময় মতো চাঁদা আদায় করতে না পারলে পুরো বেতনটাও সময়মত পাওয়া যায় না। গ্রামের কোনো কোনো মসজিদে বছরে মৌসুমভিত্তিক ধান বা অন্যান্য ফসল বা টাকা তুলে দেওয়া হয়।
একজন ইমাম জানান তাদের বেতন বাড়ে কচ্ছপ গতিতে। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো যখন-তখন একজন ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে চাকরি থেকে অব্যহতি বা বহিষ্কার করা হয়। কোনো মসজিদে দীর্ঘকাল ধরে কেউ ইমামতি করছেন; কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে দুই-এক সপ্তাহ সমস্যা হল, মসজিদ কমিটি তাকে অব্যহতি দেয়। ইমামতি করতে করতে বার্ধক্যে চলে যান, তবুও তাকে বিদায় নিতে হয় একদম খালি হাতে। যে কারণে সংসার চালাতে বাসাবাড়িতে দোয়া অথবা মিলাদ অনুষ্ঠান পরিচালনা, গৃহ শিক্ষকের কাজ, ছো-খাট ব্যবসাসহ নানা কাজ করতে তারা বাধ্য হন।
অভিযোগ রয়েছে দেশে ধর্মকে পুঁজি করে বড় বড় দল বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যাদের অর্থবিত্তের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। তবে পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা ইমামদের অসহায়ত্ব বা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে স্বার্থ হাসিল করা যায় সেই কাজে ব্যস্ত থাকে সবাই। অনেক সময় মসজিদ কমিটি ও প্রভাবশালীদের ইচ্ছামাফিক চলতে হয় তাদের যে কারণে ধর্মের সঠিক কথা ও ব্যাখ্যাটা তুলে ধরতে পারে না।
প্রায় একইভাবে অসহায় হয়ে পড়ছে হিন্দুদের পুরোহিত সমাজ। এখন আর বংশ পরম্পরায় পুরোহিত সম্প্রদায় নিজেদের ছেলে মেয়েদেরকে আর এই কাজে দিতে চায় না। জীবনের তাগিদে তারা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে চায়। দুর্মূল্যের বাজারে সবই বাড়ছে শুধু বাড়ে না দক্ষিণা। অভিযোগ রয়েছে পুজোর সময় কিছুটা ভালো আয় হয় কিন্তু তা থেকে কমিটি কর্তৃক পুরোহিতদের বরাদ্দ থাকে সামান্যই।
সাংবাদিকরা সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম ও অসঙ্গতি তুলে ধরে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। অথচ পেশা বা চাকরি, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অবস্থা একেবারে তলানিতে।
২০১৮ সালের সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত পত্রিকার (প্রিন্ট মিডিয়া) সংখ্যা ৩ হাজার ২৫টি। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংসদে জানিয়েছেন জাতীয় ও স্থানীয় মিলে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে বারো শত দৈনিক পত্রিকা আছে। বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ৪টি টিভি চ্যানেল এবং ৩৪টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল তাদের কার্যক্রম চালিয়া যাচ্ছে। তবে অনুমোদন আছে ৪৫টির।
অনলাইন মিডিয়ার সম্ভবনার কারণে দেশে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালের উদয় হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় হতে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ১৬২টি, দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল ১৬৯টি এবং টিভি চ্যানেলের অনলাইন পোর্টাল ১৫টিসহ ৩৪৬টির অনলাইন নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান গুলো থেকে ধারণা করা যায় মিডিয়া জগতে কি চলছে। কে বা কারা রেজিস্ট্রেশন, নিবন্ধন ও অনুমোদন নিচ্ছে বা নেওয়ার পর কি করছে তা জানার বা দেখার প্রয়োজনীয়তা যেন কেউ অনুভব করছে না। প্রকৃত সংবাদকর্মীরা চাপা পড়ছে। সামাজিক প্রেক্ষাপট, অব্যাহত অনিয়ম ও মালিক পক্ষের সুযোগ সন্ধানী নীতির কারণে সাংবাদিকের হাহাকার বেড়েই চলেছে। এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নের জন্য কেউ কোন পদক্ষেপ নিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন হওয়ার কথা সরকার ঘোষিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী এবং সেই অনুযায়ী সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যও নির্ধারণ হয়। বর্তমানে চলছে নবম ওয়েজ বোর্ড। সেই অনুযায়ী সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারীরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করার কথা। কিন্তু ওয়েজ বোর্ডের বাস্তবায়ন হয় খুবই কম। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা, আর কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন করে। অধিকাংশই এর কিছুই মানে না। এমন অনেক পত্রিকা আছে যেখানে সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে বলা হয় “তোমার বেতন, তুমি সংগ্রহ করো।”
বিভিন্ন শিল্প বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ধনী ব্যাক্তিরা অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিক। পত্রিকার ডিক্লারেশন নেয়ার সময় মালিকরা আইন অনুযায়ী সকল বেতন-ভাতা ও পাওনাদি দেওয়ার অঙ্গীকার করে। ভালো বেতন ও সুযোগসুবিধার লোভ দেখিয়ে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য ডিএফপি-র রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর তাদের চেহারা পাল্টে যায়। ছাঁটাই শুরু হয়, অনেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। বাজারে বেকার সাংবাদিকদের সংখ্যা বাড়তে হয়। অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা আবার নতুন করে চাকরি খোঁজা শুরু করে, অনেকে এই সুযোগ গ্রহণ করে। এক সময় সংসার নামক ঘানির কারণে তাদেরকে লজ্জাজনক ও অপমানজনক বেতনে পত্রিকায় চাকরি নিতে হয়। সাংবাদিক সমাজ যেন এই চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে আছে।
বাজারে চালু অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি সাংবাদিকের নিয়মত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন, বাকিগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক জানান ভাই আমরা কোট পরা ভদ্রলোক, পেঙ্গুইন পাখি, পকেটে টাকা নেই।
মফস্বলদের সাংবাদিকদের অবস্থা আরও খারাপ। অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকদের আইডি কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুব সামান্যসংখ্যক সাংবাদিকদের সামান্য পরিমাণে টাকা দেওয়া হয় যেটা তাদের যাতায়াত, ইন্টারনেট ও মোবাইলের পিছুনে খরচ হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কর্মরত এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক জানান নিজের বেতনের কথা বলে আর লজ্জা পেতে চায় না। যা কিছু দেয় তাও আবার ১৪ মাস ধরে বকেয়া।
আরেকজন জানান অনেকের ধারণা আমাদের কোনো খরচ নাই, কিন্তু সমাজের আর দশজন মানুষের মতো আমাদেরও যে পরিবার পরিজন আছে সেটা কেউ বুঝতে চায় না। ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে এত কম টাকায় বাংলাদেশে আর কোনো পেশার মানুষ কাজ করে না।
সারাজীবন চাকরি করার পর অধিকাংশ সাংবাদিককে প্রায় খালি হাতে বাড়ি চলে যেতে হয়। কারণ মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডও চালু করেন না। নাই কোনো পেনশন সুবিধা।
লেখক: সাংবাদিক
তারা//