ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

উন্নয়নে সামাজিক মূলধনের ভূমিকা

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ৬ মে ২০২৩   আপডেট: ১০:৫৯, ৬ মে ২০২৩
উন্নয়নে সামাজিক মূলধনের ভূমিকা

সামাজিক মূলধন বা পুঁজি (social capital) মূলত সমাজবিজ্ঞানের একটি ধারণা। এবং বোধকরি তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান অগ্রযাত্রায় তা নতুন রূপ লাভ করেছে। যুগযুগ ধরে এ মূলধন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ সংস্কারক লিডা জুডসন হ্যানিফান ১৯১৬ সালে প্রথম ‘সামাজিক পুঁজি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সেখানে তিনি মানুষ ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় তার ধারণা পরিবর্তিত হয়নি বরং ৯০-এর দশক থেকে তা উন্নয়ন আলোচকদের চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ করে। 

উৎপাদন উপকরণ হিসেবে ভূমি, শ্রম, মূলধন ও উদ্যোগের মতোই সামাজিক মূলধন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় (mode of production) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজকের আলোচনা মূলত এ বিষয়কে কেন্দ্র করে।

উন্নয়ন আলোচকগণ অন্তত তিনটি কারণে সামাজিক পুঁজিকে গুরুত্ব দিয়েছেন; এক. সামাজিক সংহতির মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি, দুই. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, এবং তিন. উন্নয়নের সাংস্কৃতিক ধারা সৃষ্টি। স্বল্পমেয়াদে এ তিনটি সূচক কার্যকরভাবে কাজ না করলেও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কারণ সামাজিক পুঁজির অবক্ষয় ঘটলে তা অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। 

একটি উদাহরণ দিয়ে সামাজিক পুঁজির বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির নতুন বর্ষ শুরু হয়। ঢাকাসহ দেশজুড়ে মহাসমারোহে দিনটি উদযাপিত হয়। এখানে বিষয়টি সামাজিক মূলধন হিসেবে বিবেচিত হবে কারণ সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিনটি উদযাপন করেন। এ ‘স্বতঃস্ফূর্ততাই’ মূলত সামজিক মূলধনের মূল শক্তি। এছাড়া, সামাজিক মূলধনের উপর একটি সমাজ বা দেশের সকল মানুষের ‘সমান অধিকার’ থাকে। 

সামাজিক মূলধনের দুটি ভিন্ন স্তম্ভ রয়েছে, ক. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এবং খ. মানুষের আচার-আচরণ। উন্নয়নের জন্য সামাজিক মূলধন তৈরিতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখে তা হলো: শিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবার। আপনি যদি দেখেন কেউ আপনাকে সম্মান করছে কিংবা আপনার কাজটি যথাসময়ে করে দিচ্ছে তবে বুঝে নেবেন তিনি কোনো ভালো পরিবার থেকে আসা সন্তান। 

একজন মানুষ আরেকজনের সঙ্গে কী আচরণ করবে সেটা একটা সমাজের বড় বৈশিষ্ট্য। ইউরোপিয়ান একটি সমাজে মানুষ তার প্রতিবেশীর সঙ্গে যে সম্পর্ক বজায় রাখে আমাদের দেশে সেরকম নয়; হওয়ার দরকারও নাই। হয়তো দেখা যাবে, ইউরোপে দীর্ঘ সময়েও একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো কথাই হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা অসম্ভব। প্রশ্ন হতে পারে, এ সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

ধরা যাক, কেউ একজন দূরের কোনো জায়গা থেকে অপরাধ করে আপনার প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে শুরু করল। আমাদের সমাজের অবস্থান অনুযায়ী তার পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। যা হয়তো প্রাশ্চাত্য দেশে সম্ভব হতেও পারে। ফলে অপরাধীদের সহজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে।

আরেকটি ভিন্ন উদাহরণ দেই। ইউরোপের কোনো এক শহর থেকে ট্রেনযোগে অন্য শহরে ভ্রমণ করলে আপনার পাশের যাত্রীর সঙ্গে আপনার কথা না-ও হতে পারে; এমনকি চোখাচোখিও! সে সব দেশে চোখাচোখিরও আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। অযথা কারও দিকে তাকালে তারা বিরক্ত হন। কষ্ট করে হাসি দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু আমরা এতটাই সামাজিক প্রাণী যে আমাদের দেশে ট্রেনে ভ্রমণ শেষে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েও হয়ে যেতে পারে! আমরা লিফটেও প্রচুর কথা বলি যা প্রাশ্চাত্য যে কোনো দেশেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এখানে যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য তা হলো এসব সামাজিক আচরণের যে পার্থক্য বিদ্যমান এর মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা নির্ণয় করা যাবে না। যে সামাজিক মূলধন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে সেটাই ভালো হিসেবে বিবেচিত হবে। পায়ু পথে বাতাস ঢুকিয়ে কাউকে হত্যা করা, ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে শিক্ষককে পিটিয়ে আহত করা স্পষ্টত সামাজিক মূলধনের দৈন্য প্রকাশ করে। মাইক্রোক্রেডিট যে সোশ্যাল কোলেটারেল (social collateral) এর উপর নির্ভর করে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে থাকে তার মূল ভিত্তি সামাজিক মূলধন। তাই এ মূলধনকে একটি সমাজ যেভাবে কাজে লাগাবে সমাজে সেরকম প্রাপ্তি যোগ হবে। 

ধরুন, কেউ একজন নিজ উপজেলা থেকে জেলা শহরে ঘুরতে গিয়ে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করলেন। এখানে সমাজে নেতিবাচক সামাজিক মূলধন যোগ হলো যা জাতীয় মূলধনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ ব্যক্তি ও সামাজিক মূলধনের সমষ্টিই হচ্ছে জাতীয় মূলধন।

সামাজিক মূলধনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সাম্প্রতিক সময়ে আগুন লাগার ঘটনায় স্পষ্টত দৃশ্যমান। বঙ্গবাজার কিংবা নিউমার্কেটে আগুন লাগার পর একদল মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে মালামাল নিরাপদে সরাতে এবং আগুন নেভাতে সাহায্য করেছেন। এটাই সমাজের ইতিবাচক সামাজিক মূলধন। অন্যদিকে, আরেকদল মানুষ দোকানের মালামাল চুরি করেছে যা নেতিবাচক সামাজিক মূলধন তৈরি করে।

তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে, যা স্বাভাবিক। সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল কোয়েনিগ বলেছেন, ‘সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মিথ্যাচার ও অসামাজিকতা আমাদের জীবনযাত্রায় নতুন রূপ নিয়ে এসেছে। ইমেইল, ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, লিংকডইন, ইত্যাদি জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফেইসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে তথ্য আদান-প্রদান হয় সেটি কতটুকু সত্যি সে জন্য গবেষণা করে নিতে হয় যা সমাজ এগিয়ে চলার পথে অন্তরায়।

ইউটিউবে প্রচুর কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে যেখানে লেখা আছে: ‘শেষ পর্যন্ত টেনে দেখুন’, ‘না দখলে চরম মিস’ ইত্যাদি নানা রকমের মিথ্যাচার। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের কপিলাকে নিয়ে ট্রল হচ্ছে যা মানুষকে সাময়িক আনন্দ দিলেও সমাজ বিনির্মাণে কোনো অবদান রাখছে না। এছাড়া, একজনের উক্তি খুব সহজেই আরেকজনের নামে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধ্রুপদী উদাহরণ মনে হয়, এ পি জে আব্দুল কালাম। এসব মিথ্যাচার আখেরে কাউকে না কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মানতে হবে, যদি সমাজে এক সিঁকি পরিমাণ ভালো কিছু উৎপাদিত হয় তবে তা spillover effect এর মাধ্যমে অন্যদের উপকার করে। বিপরীত হলে ক্ষতি করবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অসামাজিক বলছি এ কারণে যে আমরা অনেকেই শুধু ভার্চুয়াল এ জগতে বিচরণ করতে উচ্ছ্বসিত বোধ করছি; কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টা। ধরুন, কেউ রাস্তায় আহত হলে কিংবা কোথাও আগুন লাগলে আমরা ভিডিও বা স্টিল ছবি তুলতে যতখানি ব্যস্ত ও আন্তরিকভাবে দুর্ঘটনা কবলিতদের সাহায্য করতে ততটা নই। তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম রয়েছে। আসলে সময়ের পরিক্রমায় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের সুকুমার বৃত্তি লোপ পাচ্ছে। সমাজ কাঠামোতেও দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নৃ-বিজ্ঞানী ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, ‘সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে নিহিত থাকে সামাজিক সম্পর্কের কাঠামোর পরিবর্তন’। 

কেউ একজন আহত হলে অনেকক্ষেত্রে আমরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছি না। এটাই নেতিবাচক সামাজিক মূলধন। এ নেতিবাচক মূলধন একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর নেপথ্যে অন্তত দুটি স্পষ্ট কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের জয়জয়কার (যদিও এর বিকল্প তৈরি করা যাচ্ছে না) যা মানুষকে অনেক বেশি স্বার্থপর ও লোভী হিসেবে গড়ে তুলছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হচ্ছে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে। শিক্ষার একটা বড় মাপকাঠি সহিষ্ণুতা অর্জন। নিজেকে দিয়ে তা পরিমাপ করা যেতে পারে যে কতটুকু সহিষ্ণুতা অর্জন করতে পেরেছি। ভুলে গেলে চলবে না, একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে অন্তত দুই প্রজন্মের পিছনে বিনিয়োগ করতে হয়। 

একথা অনস্বীকার্য, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে ধনাত্মক সামাজিক মূলধন সৃষ্টি করতে হলে বিনিয়োগ লাগবে, ঋণাত্মক হতে হলে লাগবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষকে সম্মান করা শিখতে হলে শিক্ষার দরকার, অসম্মান করতে হলে প্রয়োজন নাই। 

পুঁজিবাদের প্রভাব দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। টাকার কাছে মানুষ গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে,! ৫০-৬০ এর দশকে একটি সমাজে যিনি ঘুষ খেতেন তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হতো আর কালের বিবর্তনে এখন যিনি খান না তাকে আমরা বেমানান (odd man) হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সমাজে চৌর্যবৃত্তি বেড়েছে, শিক্ষিত থেকে নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত। মসজিদে জুতা চুরি ঠেকাতে হলে একটি জুতা নিচতলায় আরেকটি উপরতলায় রাখাকে কৌশল হিসেবে কাজে লাগাতে হচ্ছে! কারণ চোর দুটি আলাদা করে খুঁজে পাবে না। মসজিদ-মন্দিরে বছরব্যাপী যে আলোচনা হয় তা হয়তো আমাদের ব্যক্তি জীবনে কোনো কাজে আসছে না। ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে না। তবে সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়নকেন্দ্রিক ইতিবাচক সামাজিক মূলধন সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনকেও একইভাবে এগিয়ে অবদান রাখতে হবে।

সার্বিক উন্নয়নের জন্য মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। খুব চরম বিবেচনায়, তার নিজের ক্ষতি হলেও। তবে বাস্তবতা এখন ঠিক বিপরীত। অন্যের ক্ষতি হলে হোক, আমি আমার ষোলো আনাই চাইছি। কিন্তু এভাবে ভালো থাকার আদৌ সুযোগ নেই। সবাই মিলে, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হয়। সামাজিক মূলধন যে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে সে সমাজের এগিয়ে চলার গতি সবচেয়ে বেশি এবং তা অনেক বেশি টেকসই হয়।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক 
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়