ঢাকা     শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

ধূমপান ছাড়ুন, চাইলেই পারবেন

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৮, ৩১ মে ২০২৩   আপডেট: ১৬:০৮, ৩১ মে ২০২৩
ধূমপান ছাড়ুন, চাইলেই পারবেন

সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার আজ তিন বছরপূর্তি। ২০২০ সালের এই দিনে সিগারেট ছেড়েছি। সেদিন ছিল ৩১ মে। কাকতালীয়ভাবে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। তবে এই দিনটি উপলক্ষ করে কিন্তু সিগারেট ছাড়িনি। কেন ছেড়েছি, সে গল্পটা বলি।

তার আগে বলি, সিগারেট ছাড়ার জন্য আপনার ইচ্ছে শক্তিটাই প্রথম এবং প্রধান কারণ হতে পারে। প্রবল ইচ্ছে থাকলে আপনিও আমার মত ছেড়ে দিতে পারেন সিগারেটের নেশা। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের নেশা ছিল আমার। যা মিশে ছিল রক্তে। অথচ গত দুই বছর থেকে সহ্যই করতে পারছি না সিগারেটের গন্ধ। 

জীবনের প্রথম সিগারেট ছিল স্টার। এরপর ক্যাপস্টান। ধারাবাহিকতায় গোল্ডলিফ। কদিন বাদে ট্রিপল ফাইভ। বেশ কয়েক বছর পরে বেনসন। তারপর বেনসন লাইট। বছর দু’য়েক ইজি লাইট। সেটা ছেড়ে মার্লবোরো লাইট এবং সবশেষ সিগারেটের ব্র্যান্ড ছিল বেনসন প্লাটিনাম।

এবার কীভাবে সিগারেট ছাড়লাম, সে গল্প বলি। ২০২০ সালের রোজার ঈদের পরের ঘটনা। সেদিন একটা লাইভ প্রোগ্রামে অংশ নিই। সেটা শেষে খাওয়া-দাওয়া সেরে ডিভানে হেলান দিয়ে টিভি দেখছিলাম। রাত প্রায় একটার মতো বাজে। হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কিন্তু মাথা ঘোরার পাশাপাশি ঘর, ঘরের আসবাবপত্রও ঘুরতে থাকে। সাথে আমাকে নিয়ে। রোলার কোস্টারের মতো! অথবা বিল্ডিং বানানোর সময় মিকচার মেশিনে যেভাবে পাথর, বালি, পানি, সিমেন্ট ঘুঁটা দেওয়া হয়- সেরকম। আসলে যত উপমাই দিই, ঠিক বোঝাতে পারব না!

শরীরের এই ‘অজ্ঞাত ঘূর্ণি’র কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছয়-সাত বার বমি করি। শরীর একেবারে নেতিয়ে পড়ে। এর মধ্যে বড় ছেলেকে দিয়ে ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করাই। উপসর্গ শুনে উনি বিপি আর সুগার মাপতে বলেন। কিন্তু মাপব কী করে! বাসায় তো সেসব মাপার মেশিন নেই! শোনার পর তিনি বমি আর মাথা ঘোরানো বন্ধের জন্য দুটো ট্যাবলেটের নাম বলেন। পাশের কোনও হাসপাতাল থেকে লোক এনে দ্রুত বিপি আর সুগার মেপে তাকে জানাতে বলেন। মাপামাপির সে রেজাল্ট তাকে জানালে পরে তিনি ওষুধ দেবেন।

বাবার এ অবস্থা দেখে ছেলে রোদ্দুর করোনাকালে, রাত দেড়টায় একা বাইরে বেরিয়ে যায়। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে আসে। ওষুধ খাইয়ে দেয় আমাকে। ওষুধ খাওয়ার পর আবারও বমি করি। ওষুধগুলো বমির সঙ্গে বেরিয়ে যায়। মাথা আর পুরো শরীর তখনও ঘুরছে। ছেলে আবারও বেরিয়ে পড়ে। বুদ্ধি করে লোক না এনে, হাসপাতাল থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। সঙ্গে ড্রাইভারসহ দুজন লোক। তারপর তিন জন মিলে ধরাধরি করে আমাকে নামায়। পাঁচ তলা থেকে বিছানার চাদরে পেঁচিয়ে। আমি নিজেকে ছেড়ে দিই ওদের হাতে।

এরপর কত কী! ইসিজি, এক্সরে, বিপি দেখা, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা। ইতোমধ্যে রাত দুটো পেরিয়ে যায়। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরদিন শুক্রবার। ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ করোনাকাল। তবুও পরদিন সকাল দশটার দিকে অবাক করে দিয়ে মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সাহেব এসে আমাকে দেখেন। এর মধ্যে সব টেস্টের রেজাল্টও চলে আসে। তিনি দেখেশুনে আমাকে বলেন, ‘সব টেস্টের রিপোর্ট ভালো। দুশ্চিন্তা, ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে হয়ত এমন হয়েছে। ওষুধের পাশাপাশি দু’দিন বিশ্রাম নিন, ভালো খাবার-দাবার খান- ঠিক হয়ে যাবে।’

ভালোয় ভালোয় সেদিন গেল। রাত গেল। পরদিন আর রাতও গেল। একটু ভালো বোধ করছিলাম। রোববার ডাক্তার সাহেব এসে পনেরো দিনের ওষুধ লিখে দিয়ে রিলিজ করে দেন আমাকে। হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে আসি। বাসায় ফেরার তিন-চার দিন পর আস্তে আস্তে শরীরে ভারসাম্য ফিরে পাই। ওষুধ, পথ্য আর বিশ্রাম সমানতালে চলতে থাকে।

অসুস্থ হওয়ার দিনসাতেক পরে একদিন দুপুরে খাওয়ার পর সিগারেটের খুব তেষ্টা পায়। বাসার লোকজনকে লুকিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলি। পুরো ওয়ার্ডরোবের ভেতরে আমার সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে। কেবল সিগারেটের প্যাকেটটা নেই। যার ভেতরে দশ-বারোটা সিগারেট ছিল। নেই তো নেই-ই।  কী আর করা! লাজশরমের মাথা খেয়ে বউয়ের কাছে জানতে চাই। শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে! এমন ভাব করলো, যেন সিগারেট কী জিনিস দেখতে কেমন- তার কিছুই জানে না। অবশেষে গোয়েন্দা লাগাই আমি।  

ছোট ছেলে সমুদ্দুর কানে কানে এসে গোয়েন্দা রিপোর্ট জানায়, ‘বাবা, সিগারেটের প্যাকেট মা এখান থেকে নিয়ে গেছে।’
-নিয়ে গিয়ে কী করেছে?
-তা তো জানি না, বাবা!

এরপর আর কোনও প্রশ্ন করে লাভ নেই। যা বুঝার, বুঝে যাই।
এবার স্ত্রী মুখ খোলেন। বলেন, ‘ফেলে দিয়েছি।’

আমার কিন্তু তার কথা বিশ্বাস হয় না। তারপরও করোনা আর শারীরিক দুর্বলতার কারণে সিগারেট কিনতে পাঁচ তলা থেকে নিচে নামার সাহস পাই না। পরপর কয়েকদিন খাবার পরে সিগারেট চাই তার কাছে। কী ভাবছেন, সিগারেটের নেশার কারণে? তা পুরোপুরি ঠিক না। নেশা তো আছেই। তার ওপর ভাবুন একবার, দশ-বারোটা সিগারেট! এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? আপনারা যারা ধুমপায়ী না, তারা এ কষ্ট আর মায়া বুঝবেন না! কিন্তু আমার স্ত্রী অনঢ়, অটল। পাহাড়ের মতো। আমাকে সিগারেট দেবেই না, সম্ভবত এমন প্রতিজ্ঞা করেছে সে!

কী আর করা! রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, কষ্টে আর অভিমানে তার কাছে আর সিগারেট চাই না। ২০২০ সালের ৩১ মে হাসপাতালে যাওয়ার দিন রাতে শেষ সিগারেট টেনেছিলাম। তারপর সেই যে জেদ করে সিগারেট টানা ছেড়েছি, এখনও সেটা আর ধরিনি। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও সিগারেট আর ছুঁয়েও দেখিনি। আশপাশের অনেক বন্ধুরা টানছে। কিন্তু আমার নিজের একবারও সিগারেট টানার ইচ্ছে হয়নি। প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে কোনওদিন আর সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াব না।

আপনাদেরও অনুরোধ করছি, যারা ধরেননি ধরবেন না। আর যারা সিগারেটে অভ্যস্ত, তার ছেড়ে দিন। হিসাব করে দিন দিন কমিয়ে সিগারেট ছাড়তে পারবেন না। ছাড়তে হবে হঠাৎ করেই। প্রচণ্ড মনোবল থাকলেই সেটা আপনি পারবেন। পারতেই হবে। এই বাজে অভ্যাস আপনার সব ধরনের ক্ষতি করছে।

তো, শুরু হোক আজ থেকেই। সিগারেটকে ‘না’ বলুন, সুস্থ থাকুন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়