ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

পর্যাপ্ত ‘সমন্বিত বনায়ন’ হোক আমাদের লক্ষ্য

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪০, ৬ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৬:৪৩, ৬ জুন ২০২৩
পর্যাপ্ত ‘সমন্বিত বনায়ন’ হোক আমাদের লক্ষ্য

প্রতি বছরের মতো এবছরও বেশ ঘটা করে ‘পরিবেশ দিবস’ পালন করা হলো। এদিকে প্রকৃতিতে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। ভারসাম্য হরিয়েছে প্রকৃতি। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। এর কম হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। মোট বনভূমির পরিমাণ যত কম থাকে সেই দেশে পরিবেশগত সমস্যা তত প্রকট হতে বাধ্য।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট–২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ১৪.০১ শতাংশ- যা পর্যাপ্ত নয়। এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, পৃথিবীর বরফ দ্রুত হারে গলছে। শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় এই সময়ে বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা ১.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আরেক কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিগত ৩০ বছর ধরে উপকূলবর্তী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৩.৮ থেকে ৫.৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। 

এদিকে ক্রমাগত উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে এবং আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পরিবেশ এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে উষ্ণায়ন সমস্যা এপ্রিল, মে, জুন এবং জুলাই মাসে বেড়ে যায়। আমরা নিজেরাই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার ধারে থাকা অনেক পুরোনো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় গাছ কেটে নানা কারণ উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট কমিটি। এই যে গাছ কেটে ফেলা হলো, বেশিরভাগ সময় নতুন করে আর কোনো গাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে না। এর কোনো জবাবদিহিতাও নেই!

আবার পাহাড়ের বর্তমান দৃশ্যের দিকে যদি নজর দেই, দেখবো যে সেখানেও বনভূমি কেটে উজাড় করা হয়েছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে, ফলে পাহাড় ঘিরে থাকা বনভূমিও কাটা পড়ছে। কক্সবাজার, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়গুলোতে দেখেছি- বনভূমি কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। পাহাড়গুলো দেখতে ন্যাড়ার মতো লাগে!

অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে ভাওয়াল বনভূমি বিনষ্ট হয়েছে। শৈশবে যেসব জায়গায় শাল, গজারির বন দেখেছি সেসব জায়গায় এখন মিল ফ্যাক্টরি দাঁড়িয়ে আছে। বসতবাড়িতে বনায়নের যে ঐতিহ্য ছিল সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ বসতভিটায়, পুকুরের চালায় বিভিন্ন রকমের দেশি ফলের গাছ লাগাত। আম, কাঁঠাল, লিচু এগুলো যেমন ছিল, আরও দেখা যেত বড়ই, আতাফল, জাম, তেঁতুল গাছসহ নানা রকম গাছ। এখন বলতে গেলে তেঁতুল, আতাফল, জামগাছ বিলুপ্তির পথে। এ কারণে, নতুন প্রজন্মের এসব ফলের সঙ্গে পরিচয় থাকছে না। বসতবাড়িতে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘ভালো কাঠ হবে’ এ কথা ভেবে গাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে। 

এনজিওগুলো বাংলাদেশে যে কার্যক্রম শুরু করেছিল সেটাও আগের মতো নেই। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি। এ কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক সাহায্য, সহযোগিতাও কমে এসেছে। ফলে এনজিওর কার্যক্রম কমে গেছে। কিন্তু সামাজিক বনায়নে এনজিওর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাদের কার্যক্রম কমে আসায় বনায়ন ব্যাহত হয়েছে।

জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে কারণে- অকারণে গাছ কাটা হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে যেটুকু বনায়ন হচ্ছে, সচেতনতার অভাবে সেটুকুও ভুল বনায়ন হচ্ছে। ফলদ গাছের চারা কম রোপণ করা হচ্ছে। ফলে পশুপাখির খাবারের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফুড সাইকেল ভেঙে পড়েছে। কাঠবিড়ালি কিংবা বানর এগুলো আর আগের মতো টিকে থাকতে পারছে না। যেসব পশুপাখি ফল খেয়ে জীবন ধারণ করতো, এরই মধ্যে অনেক পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পরিবেশ এক অখণ্ড বিষয়। বিশ্বের যেকোন জায়গায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে এর ভূক্তভোগী হতে হয় সবাইকে। এই মুহূর্তে বিশ্বের মানুষ উষ্ণায়নের সমস্যা মোকাবিলা করছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলার পুরো বিষয়টি জটিল। এটি পুরোপুরিভাবে আমাদের হাতে নেই। বিশ্ব উষ্ণায়নের সব চেয়ে দায়ী উন্নত দেশগুলো। তারাই সবচেয়ে বেশি কার্বণ নিঃসরণ করে। সেসব দেশের কারণেই উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে আমাদের মতো দেশগুলো। যেসব দেশের ভৌগলিক অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায়। 

বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও বাড়লে আমদের কক্সবাজার বা আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা তলিয়ে যাবে। তার কিছু নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সমুদ্রতীরবর্তী যেসব জায়গায় আগে জোয়ারের পানি ঢুকতো না সেসব জায়গায় জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করেছে । যেমন চট্টগ্রাম শহরে এখন জোয়ারের পানি ঢুকে যায়। তার মানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগের তুলনায় বেড়েছে। 

এ কারণে পরিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যও বিনষ্ট হয়েছে। এখন বাংলাদেশ নামেই ষড়ঋতুর দেশ! অথচ অনেক গরম আর একটু একটু শীত এই হচ্ছে আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যের প্রকৃত অবস্থা। ষড়ঋতুর সেই বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য যদি আমরা ফিরে পেতে চাই, আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত যেসব দেশ উচ্চ কার্বন নিঃসরণ করছে, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। যেন তারা কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনে। একইসঙ্গে এই সব দেশের কারণে আমরা পরিবেশগত দিক দিয়ে যেসব ক্ষতির মুখে পড়েছি সেসব দিক চিহ্নিত করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি তুলতে হবে। 

এছাড়া আমরা আমাদের যে যার জায়গা থেকে পর্যাপ্ত ও সঠিক বনায়নের উদ্যোগ নিতে পারি। এক কথায় দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ সঠিক বনায়ন, (অধিক হারে ফলদ গাছ রোপণ, ঔষধী গাছ) করার লক্ষ্যে জাতীয়, ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ করে যেতে পারি। ফলদ গাছের সংখ্যা বাড়লে প্রাণীকুলের ফুড সাইকেল ঠিক থাকবে। পর্যাপ্ত বনায়ন পরিবেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দেবে।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়