প্রশান্ত পাড়ে বঙ্গবন্ধু
মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি কখনো এ দেশে এসেছিলেন কি না সেটা বড় ব্যাপার নয়। বিষয়টি হলো তিনি আছেন। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথও আসেননি। কিন্তু গানে কবিতায় জীবনে কী উজ্জ্বলভাবে আছেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী, তাঁর সঙ্গেও দেখা হয় আমার। বাড়ির পাশে প্যারামেটা শহর। কাজে-অকাজে ওখানে যাবার পথের ছোট্ট এক পার্কে লাঠি হাতে মাথা ঝুঁকে চলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন গান্ধী। মনে হয় যেন এখনই কথা বলে উঠবেন। রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যও আছে এই শহরে। আর বঙ্গবন্ধু?
যত দিন যাচ্ছে যত সময় যাচ্ছে আমাদের বসতির বয়স বাড়ছে। তত তিনি আমাদের সঙ্গে থাকছেন। আপনারা কি ভাবেন জানি না আমার মন খারাপ বা কোনো ধরনের বিপন্ন বোধ করলে অল্প একটু দূরেই তাঁর কাছে যাওয়া যায়। দুঃখ কাটিয়ে মনে প্রেরণা আর শক্তি নিয়ে ফিরতে পারি। পাঁচ মিনিট ড্রাইভ করে গেলেই চোখের চশমায় বিষণ্ণ অথচ জ্বলজ্বল করছেন শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের সরকারি দল তাদের প্রবল প্রতাপ বা দেশে-বিদেশে অসংখ্য দল আর সমর্থকদের কথা থাক। আমরা যারা আকৈশোর এই মানুষটির জন্য কেঁদেছি তাঁর অপমানে দগ্ধ হয়েছি, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়েছি, আমাদের কাছে তিনি এক বটবৃক্ষ। মন খারাপ বা শক্তিহীন মনে হলে অপমানিত হলে তাঁর কাছে গেলেই মনে পড়ে- এতো অত্যাচার, এতো জুলুমের পরও কেমন শক্তিমান ছিলেন তিনি!
কোথায় হাজার হাজার মাইল দূরের একখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান। তার জনগণের দুঃখ দুর্দশা আর স্বাধীনতার সংগ্রামকে ইন্টারনেট টেলিফোন মোবাইলহীন যুগে এই মানুষটি প্রশান্তপাড়েও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যে কারণে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশ সরকার ৪৪ জন ভারতীয়সহ মোট ৬৮ জন বিদেশী নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অফ লিবারেশান ওয়ার’ সন্মাননা প্রদান করে। সেই তালিকায় একজন অস্ট্রেলিয়ানও ছিলেন, যার নাম হার্ব ফিথ। হার্ব ফিথ মোনাশ ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে মোনাশে তার নামে একটি ফাউন্ডেশন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে হার্ব ফিথের এই মরণোত্তর সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছেলে ডেভিড ফিথ, যা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বাঙালি জাতির তরফ থেকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনরূপে’ প্রদান করা হয়। ডেভিড ফিথ তার এই ঢাকা সফরকে নিয়ে একটি দীর্ঘ রিপোর্ট লিখেছেন, যা মোনাশ ইউনিভার্সিটির হার্ব ফিথ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। এই রিপোর্টে ডেভিড মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে তার বাবার যাবতীয় কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন, যা অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা থাকার কারণে এইদেশ আমাদের স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে দেরি করেনি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে ধন্যবাদ জানাই। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটলামের বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরকালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুইটলাম শান্তি, বহুত্ববাদ এবং মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অভিন্ন অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে দু’দেশের জনগণের মধ্যে একটি স্থায়ী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা ও পরবর্তীতে কয়েক দশক ধরে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তার জন্যও তিনি অস্ট্রেলিয়াকে ধন্যবাদ জানান। আলম আরো বলেন, দু’দেশের জনগণের কল্যাণ এবং অর্থনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে একটি প্রধান অংশীদার হিসেবে পেতে আগ্রহী।
আজ সে সম্পর্ক মজবুত। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য বেড়েছে। শক্ত ভিত্তি পেয়েছে নাগরিক ও মানবিক যোগাযোগ। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য আমরা নিউ সাউথ ওয়েলস তথা সিডনি'র পার্লামেন্ট ভবনে সমবেত হয়েছিলাম। সেদিন সেখানে অতিথি হিসেবে ছিলেন এই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বব কার। ডাকাসাইটে এই নেতা যিনি কি না সরকারের বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন তার ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বই থেকে তাঁর কথা কোট করে বললেন, এই সব অভিজ্ঞতা ও বাণী তিনি অনুসরণ করেন। তার মতে বঙ্গবন্ধুর অনেক কোটেশন তাঁর রাজনৈতিক জীবন গতিময় করেছে।
আপনাদের অনেকেই জানেন, এ দেশের মাটিতে শায়িত একজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ডাচ অষ্ট্রেলিয়ান ওডারল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলার চেষ্ট করেছিলাম আমি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর বেজায় অভিমানী এক মানুষ। হবারই কথা। তখন দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কোণঠাসা আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিষিদ্ধ। এই বাস্তবতা ওডারল্যান্ড মানবেন কোন আনন্দে? তিনি যখন ঢাকার বাটা কোম্পানির সিইও তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন। পঁচাত্তরের ঘটনার পর তার বাটা কোম্পানির এক কর্মচারী উল্লাস প্রকাশ করায় সে কর্মচারীকে তিনি কাজ থেকে বিতাড়িত করতে কসুর করেননি। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল এই মানুষটি যে দেশের মাটিতে শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন সে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আজকাল সরকারি দলের কারণে মুজিব কোটধারীদের সংখ্যা হাতে গোনা যায় না। একটা সময় যখন রাজনীতি বৈরী ছিল, বৈরী ছিল পরিবেশ, তখন আমরা এমন প্লাবন দেখিনি। এতো বাড়াবাড়িও ছিল না। তখন আমাদের যৌবনে শক্তি ছিল হারিয়ে যাওয়া সেই বঙ্গবন্ধু যিনি না থেকেও প্রবলভাবে বিদ্যমান। আজকের বাস্তবতায় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের যোগসূত্র এবং দেশ বিদেশে আমাদের একক পরিচয়ের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি না থাকলে বাংলাদেশই হতো না। আমি মাঝে মাঝেই তাঁর দেখা পাই।
কোনো একটি অনুষ্ঠানে বা খেলার মাঠে আমরা সবাই মিলে যখন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাই তখন চোখের কোণায় যে অশ্রু চিকচিক করে তার ফোঁটার নাম শেখ মুজিব। আনন্দে উৎফুল্ল বাঙালি যখন প্রবাসে ‘জয় বাংলা’ বলে তখনও তার নাম বঙ্গবন্ধু। আমি বলি, আমার দুটি পাসপোর্ট। একটি দৃশ্যমান অন্যটি অদৃশ্য। এই পাসপোর্টের নাম আমার নেতা শেখ মুজিব।
সিডনি
তারা//