বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে আছেন
বাঙালির পরাধীনতার ও ব্যর্থতার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। অনেক বাঙালি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। সেই রাষ্ট্রের ভাষা হবে বাংলা, শাসক হবে বাঙালি। তবে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে একজন কয়েক হাজার বছরের বাঙালির অন্তরের অন্তঃস্থলে ঘুমিয়ে থাকা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তিনিই ঘুমিয়ে থাকা বাঙালিকে জাগিয়ে তুলে ছিলেন, করেছিলেন উজ্জীবিত। একজন বাঙালি অন্য কোটি কোটি বাঙালিকে মন্ত্র শিখিয়েছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’; ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ’; ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের রক্ত ঝরানো যুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি পায় নিজের ঠিকানা, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ‘বাংলাদেশ’। এই রূপকার আর কেউ নন, তিনি হাজার বছরের সেরা ও ক্যারিশম্যাটিক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যেমন প্রতিটি বাঙালির মনের ভাষা বুঝতেন, তার হৃদয়ে ছিল শুধু বাংলা আর বাঙালি।
এদেশের কৃষক মজুর থেকে শুরু করে অনেক বাঙালি মনীষী, দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী বহু সংগ্রাম করেছেন। পলাশীর যুদ্ধ থেকে তেভাগা, স্বদেশীসহ নানা আন্দোলন, বিদ্রোহ। কিন্তু বাঙালি কোনওবারই সফল হয়নি। ক্রিকেট খেলার মত মনে হয়, যেন ব্যাটে-বলে সংযোগ হয়নি। কোথাও যেন বাঙালির একটা অভাব ছিল। সেটা ছিল বাঙালিকে জাগিয়ে তোলা, ঐক্যবদ্ধ করার মত একজন লোকের অভাব।
এর আগে কেউ যদি বাঙালিদের উজ্জীবিত করতে পারত তাহলে ১৭৫৭ সালেই আমরা ইংরেজদের পরাজিত করতে পারতাম। সবার হয়ত জানা আছে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারীদের কারণে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩২০০ সৈন্যের কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজারের চৌকস বাহিনীর অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। সেদিন আমাদের শক্তি ছিল, কিন্তু দেশপ্রেম শেখানোর মত নেতা ছিলেন না। বিজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ ও তার বাহিনী যেদিন রাজধানী মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন, সেদিন রাজধানীতে যত মানুষ জড়ো হয়েছিল, তারা যদি ঢিলও ছুঁড়ত; এমনকি শোরগোল বা চিল্লাচিল্লি করত, তাহলে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে যেত।
এসব কথা স্বীকার করে পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘সেদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি।’
পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নবাব সিরাজউদ্দৌলা দ্রুত রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন এবং সবাইকে দেশ রক্ষার আহ্বান করেছিলেন। তবুও সেদিন সাধারণ সৈন্য, দরবারের কর্মচারী ও সাধারণ জনগণ— কেউই স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পারেনি।
পলাশী যুদ্ধের পর আরও কয়েক বছর সময় পাওয়া গিয়েছিল এবং আরও কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। তখনও সাধারণ জনগণকে জাগিয়ে তোলা যায়নি। আমাদের যদি শুধু একজন উজ্জীবিত করার লোক থাকতো, তাহলে পলাশীর প্রান্তরে পৌঁছানোর আগেই ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করা যেত। ইংরেজ বাহিনী কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে যাত্রা করার পর পথে অনেক জায়গায় নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথরোধ করেনি।
আরও একবার সুযোগ এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এই সময়ই বাংলাকে অখণ্ড রেখেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ এসেছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সম্মতি দিয়েছিলেন। আর সবাই যদি মেনে নেয়, তাহলে ইংরেজদেরও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের কারণে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। জেনে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্র ছিলেন। তখনও বাঙালির নেতা হয়ে ওঠেননি।
বাঙালির জেগে ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ বা উপযুক্ত সময় আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সক্ষমতা অর্জন এক রাতে ঘটেনি। এর পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ জীবন-সাধনা। ছাত্রজীবন থেকে তিল তিল করে কর্মের মাধ্যমে বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসে আর কোনও বাঙালি তো এমন করে কোনোদিন বলেননি ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’।
পাকিস্তানের ২২ বছরের শাসনের প্রায় ১৩ বছর বঙ্গবন্ধু জেলে কাটিয়েছেন। তাকে ফাঁসি দেওয়ার তোড়জোড় হয়েছে। জেলখানায় বহুবার তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন, তবুও বাঙালির প্রতি ভালবাসা ও মনের অপরিসীম জোরের উপর কেউ ফাটল ধরাতে পারেনি।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের ৫ আগস্ট এক দুর্নীতি মামলায় দণ্ড ঘোষণার পর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে পাঞ্জাবের ‘অ্যাটক কারাগারে’ পাঠানো হয়। কিন্তু দুই দিন না যেতেই ইমরান খান কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি জনগণকে ভিডিও-বার্তায় জানিয়েছেন, ‘আমাকে এখান থেকে দ্রুত বের কর, আমি জেলে থাকতে চাই না। জেলের কুঠুরিতে দিনের বেলা মাছি ভনভন করে আর রাত নামলেই পোকামাকড় বেরোয়’।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েও ইমরান খান কারাগারে কান্নাকাটি শুরু করেছেন। সেখানে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৩ বছর কীভাবে জেলে কাটিয়েছিলেন, সেটা শুধু অনুধাবনের বিষয়।
পাকিস্তানের শুরু থেকেই ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, বঙ্গবন্ধুর সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করে প্রথমে করাচি ও পরে লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে নেওয়া হয়। একাধিক কেন্দ্রীয় কারাগার থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে দূরবর্তী জেলা শহরের কারাগারে আটক করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাঁকে মানসিকভাবে পিষ্ট করা। লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সলাবাদ) পাকিস্তানের অন্যতম উষ্ণতম স্থান যেখানে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা মরুভূমিকেও ছাপিয়ে যায়। বন্দীদের জন্য ঐ কারাগার ছিল দুর্বিষহ ও শাস্তি স্বরূপ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, নিঃসঙ্গ সেলে কোনও পাখা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল। অত্যধিক গরমে তিনি তেঁতে ওঠে ছিলেন। এরপর তাকে মিয়ানওয়ালী কেন্দ্রীয় কারাগারের এক নির্জন কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। সে বছরের ৮ আগস্ট পত্রিকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য ছাপা হয় সেখানে তিনি বলেন, ‘আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে ওয়াদা করে কিছু বলতে পারব না তবে মুজিবকে কালকেই আমি গুলি করছি না’। এরপর ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সামরিক আদালত প্রহসন বিচারের রায় ঘোষণার পর তার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়ে ছিল। একজন জীবিত মানুষকে তার কবর খুঁড়ে দেখানো, এর থেকে বড় শাস্তি আর কী থাকতে পারে! বঙ্গবন্ধুকে যে তারা হত্যা করত, এতে কোনও সন্দেহ ছিল না। তবে মারার আগে যেন তিনি মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে যান, তারা সেই কাজটি করেছিল।
বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর দেশ স্বাধীন হলো। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করেছিলেন। নয় মাস যুদ্ধের পর রাস্তাঘাটসহ প্রায় সবকিছু অকেজো হয়ে গিয়েছিল। অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। কৃষকের ছিল না হালের গরু, ফসলের বীজ, তারওপর আবার খরা। যুদ্ধের সময় অনেকের হাতে অস্ত্র চলে গিয়েছিল। অনেকে অস্ত্র জমা না দিয়ে বিপ্লবের চেষ্টা করছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা নতুন করে সংগঠিত হয়ে দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। বিরোধী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে কীভাবে ধ্বংস করা যায়, সে চক্রান্তেও ব্যস্ত ছিল।
যুদ্ধের পর লাখো মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যার আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ থেকে বোঝা যায় তখনকার অবস্থা। বঙ্গবন্ধু শূন্য অবস্থা থেকে নয় বরং অনেক মাইনাস পরিস্থিতি থেকে রাষ্ট্রের হাল ধরে ছিলেন। তবুও তিনি সর্বক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে থাকেন। তিনি দেশকে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। কতটুকু সময়ই-বা তিনি পেয়েছিলেন। এটুকু সময়ে আমরা তাঁর কাছে কী আর আশা করতে পারি। অথচ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ ঐ সময়কে বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মডেল হিসাবে গণ্য করে।
পুনশ্চ: বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে আছেন। কেউ ইচ্ছে করলেই তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসও লেখা যাবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল মাতাল, অপরিণামদর্শী ও বর্বর মূর্খ খুনি রাতের অন্ধকার সময়ই বেছে নিয়ে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ড ঘটাল। বঙ্গবন্ধু কী প্রতিদান পেলেন? এ লজ্জা বাঙালিরা কোথায় রাখবে?
লেখক : সাংবাদিক
ঢাকা/এনএইচ