ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিং

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৮, ৯ অক্টোবর ২০২৩  
প্রসঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিং

রূপকল্প-২০২১ এর মাধ্যমে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন করে। আর ডিজিটাল ব্যবস্থার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ ডিজিটাল অর্থনীতির বিনির্মাণের মাধ্যমেই সম্ভব হবে। বিগত সময়ে মানুষের মনে এ প্রতীতি জন্মেছে যে, সরকার ডিজিটাল পরিষেবার মাধ্যমে দৈনন্দিন সেবা প্রদান করতে সক্ষম। মাননীয় অর্থমন্ত্রী গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর যে ঘোষণা দেন তা এ অর্থবছরেই চালু হবে মর্মে আশা করা হচ্ছে। 

সরকার ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে ক্যাশলেস বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং একটি ব্যাংকের গ্রাহকদের ইলেক্ট্রনিক অথবা অনলাইন প্লাটফর্ম-এর মাধ্যমে ব্যাংকিং পণ্য এবং পরিষেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ব্যাংকিং লেনদেন ক্যাশলেস করার যে প্রয়াস তা ‘স্মার্ট ইকোনমি’ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার আইনি কাঠামো, প্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংকিং এ বর্তমান সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ‘ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন বিষয়ক গাইডলাইন্স’ প্রণয়ন করেছে। 

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। তাই অন্তত একটি প্রধান কারণে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা আবশ্যক। রাজস্ব ফাঁকির সকল পথ বন্ধ করে রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে ঘাটতি মোকাবিলা করায় ডিজিটাল ব্যাংকিংই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশল। এটি প্রণিধানযোগ্য, সরকারি যে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা মানুষ শতভাগ বিশ্বাস করে। তাই দিনশেষে সব ঠিক থাকলে ডিজিটাল ব্যাংকিং সফল হবে বলেই আশা করছি। 

আলোচনার শুরুতে ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর স্বরূপ কেমন হবে বিবৃত করছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে ডিজিটাল ব্যাংকের একটি প্রধান কার্যালয় থাকবে যা হবে স্থাপনাবিহীন। ফলে এর কোনো ব্রাঞ্চ বা এটিএম বুথ থাকবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা প্রদান করবে না। এর নিজস্ব কোনো উপশাখা, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না। স্বাভাবিকভাবে, এদের সব সেবা হবে অ্যাপভিত্তিক যা মোবাইল ফোন বা অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে। ফলে গ্রাহকগণ ২৪/৭ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, ছজ বা অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে সেবা দিতে পারলেও সরাসরি প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার করতে পারবে না। এসব ব্যাংকগুলো প্রবাসী কর্মীদের প্রবাস আয় সংগ্রহ করতে পারলেও বৈদেশিক মুদ্রায় বাণিজ্য অর্থায়নে যুক্ত হতে পারবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রথাগত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোনো একটি ব্যাংক খুলতে গেলে ৫০০ কোটি টাকা মূলধনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংক খোলার জন্য নূন্যতম ১২৫ কোটি টাকা মূলধন লাগবে। মূলধন কম লাগবে বলে প্রথাগত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ডিজিটাল ব্যাংকের অংশীদারিত্ব পাওয়া সহজ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেবার ৫ বছরের মধ্যে এ ব্যাংককে দেশের বাজারে প্রাথমিক শেয়ার বাজারে আইপিও ছাড়তে হবে। ফলে এসব ব্যাংকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বলে প্রতীয়মান হয়। আইপিওর পরিমাণ হতে হবে স্পন্সরের প্রাথমিক অবদানের ন্যূনতম পরিমাণের সমান। এ ছাড়া, পরিচালক হতে লাগবে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রচলিত ব্যাংকের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে। এ ছাড়া, সময়ে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত অ্যাডভান্স-টু-ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বজায় রাখতে হবে। 

প্রাসঙ্গিকভাবে, ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণখেলাপি হয়েছেন বা ছিলেন এমন কেউ বা তার পরিবারের কোনো সদস্য ডিজিটাল ব্যাংকের স্পন্সর হওয়ার আবেদন করতে পারবেন না। এ ছাড়া, ঋণখেলাপি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকলে সেসব ব্যক্তিও এর জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। ক্ষুদ্র পরিসরে ঋণ দিতে পারলেও বড় এবং মাঝারি শিল্পেও ঋণ দেওয়ার বিধান নাই। তবে ভবিষ্যতে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফলতা নিশ্চয়ই সব রকমের ঋণ প্রদানের বিষয় বিবেচনায় নেবে। 

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের যে লক্ষ্য তা বাস্তবায়নের জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং অন্যতম উপায়। প্রচলিত ব্যাংক সময়নির্ভর এবং ঋণ নেওয়া, আমানত খোলা ইত্যাদি সেবার জন্য গ্রাহককে সশরীরে যেতে হয়। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় ডিজিটাল ব্যাংকিং আকর্ষণীয়। এ ছাড়া, ব্রাঞ্চ ব্যাংকিংয়ের খরচ মেটানোর কারণে অনেক সময় ব্যাংকের বার্ষিক লভ্যাংশ কমে যায়। সিঙ্গাপুর, ফিলিপিনসহ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলছে। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেও ডিজিটাল ব্যাংকিং শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ভার্চুয়াল মদ্রার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভার্চুয়াল মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল মুদ্রার সংস্করণ চালু করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। 

ডিজিটাল ব্যাংকিং যতটা আশার সঞ্চার করছে ঠিক ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ। এর বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবার জন্য সমান এবং স্বচ্ছ হবে কি না, সেটি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার অভাব কিংবা প্রযুক্তির অপ্রতুলতার কারণে অনেকের কাছে এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের সেবা নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, সেবা প্রদানকারী ও গ্রহীতার অনেকেই এখনও নগদ লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন যা এ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চতুর্থত, সকল আয়ের মানুষকে এ সেবার আওতায় আনা যাবে কি না, সেটিও মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। পঞ্চমত, সাইবার সিকিউরিটির সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। বলতে দ্বিধা নাই, ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া, প্রত্যন্ত এলাকার (হাওর অঞ্চল, পার্বত্য জেলা, নিম্নাঞ্চল ইত্যাদি) দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। 

একটি উদাহরণ দিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল চ্যালেঞ্জ বর্ণনা করতে চাই। ধরুন, ব্যক্তি ‘ক’ ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোনো ফার্নিচারের দোকান থেকে কেনাকাটা করলেন। দোকানী সে টাকা থেকে ১ হাজার টাকা তার নিকট জমা রেখে ৯ হাজার টাকা কোনো হাসপাতালের বিল পরিশোধ করলেন। সেখান থেকে আরও ২ হাজার টাকা রেখে হাসপাতালের মালিক ৭ হাজার টাকা দিয়ে তার ইলেক্ট্রিক বিল প্রদান করলেন। সবশেষে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এ টাকা গ্রহণ করে তবে সমস্যা নাই। যদি তিনি ইলেক্ট্রিক বিল না দিয়ে ৭ হাজার টাকা দিয়ে ওষুধ ক্রয় করেন এবং পরে ওষুধ বিক্রেতা ঐ টাকা হতে কিছু টাকা দিয়ে কাঁচামরিচ কিনতে যান তবে কাঁচামরিচ বিক্রেতা ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর সঙ্গে সংযুক্ত কি না সে প্রশ্ন চলে আসবে? যদি না থাকেন তবে ক্যাশলেস লেনদেন সম্ভব হবে না। যেহেতু আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক তাই ডিজিটাল ব্যাংকিং কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। 

তবে আশার বিষয়, মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের সাথে আমরা যেভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি তাতে ডিজিটাল ব্যাংকিং শুরুতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও নিকট ভবিষ্যতে অর্থনীতির সঙ্গে মানিয়ে নেবে। সমসাময়িক সময়ে ‘বিকাশ’ এর মাধ্যমে লেনদেন আমাদের সবচেয়ে বড় ‘উদ্ভাবন’। পরিসংখ্যান বলছে, বিকাশ, নগদ ও রকেটের গ্রাহক সংখ্যা যথাক্রমে ৫ কোটি, ৪ কোটি ও ৩ কোটি যার মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। ৬০ লাখেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং গ্রাহক রয়েছেন। তাছাড়া, ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছেন। প্রতি বছর এসব সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। সময়ের সাথে সাথে শ্রমনির্ভর অতি ক্ষুদ্র ভাসমান উদ্যোক্তা, প্রান্তিক পেশায় নিয়োজিত মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ এসব ডিজিটাল পরিষেবার মধ্যে যুক্ত হচ্ছেন যা ডিজিটাল ব্যাংকিং এর সফলতার মূল চালিকাশক্তি। প্রাথমিকভাবে, বর্তমানে ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্থ তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর জনগোষ্ঠীর হাত ধরে ডিজিটাল ব্যাংকিং শুরু হোক যা সময়ের পরিক্রমায় সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এ ছাড়া, সময়ের আবর্তনে এর সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত করতে হবে। যেমন, বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন, বৃহৎ শিল্পে ঋণ প্রদান ইত্যাদি বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। 

সবচেয়ে আশাপ্রদ যে বিষয় তা হলো, আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষ সরকারকে শতভাগ বিশ্বাস করে। যেহেতু, পুরো প্রক্রিয়াটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় (বাংলাদেশ ব্যাংক) সংঘটিত হবে তাই এটি কার্যত অসফল হবে না। যদিও শতভাগ ক্যাশলেস হয়ে স্মার্ট ইকোনমির রূপান্তর ঘটতে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতেই হবে। তবে আমাদের আশাবাদী হতে আপত্তি কোথায়? 


লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়