ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম পিতৃস্নেহ

মোহাম্মদ হানিফ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ১৮ অক্টোবর ২০২৩  
রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম পিতৃস্নেহ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন আজ। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে তাঁর জন্ম। ছোট বোন শেখ রেহানা আদর করে ‘রাসুমণি’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। তাই পরিবারের সবার আনন্দ রাসেলকে ঘিরে। বড় ভাই-বোনদের আদর সোহাগে রাসেল বড় হতে থাকে। জন্মের প্রথম দিন থেকে রাসেলের ছবি তোলা শুরু হয়। সব ভাই বোন মিলে রাসেলের জন্য আলাদা একটা অ্যালবামও করেছিলেন।

রাসেলের জন্মের দিন, প্রতিমাস, প্রতি তিন মাস, ছয় মাস অন্তর ছবি অ্যালবামে সাজানো হতো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে অন্যসব জিনিসপত্রের সাথে অ্যালবামটা লুট করে নিয়ে যায়। রাসেল বড় বোনকে ‘হাসুপা’ বলে ডাকত। বড় দুই ভাই কামাল ও জামালকে ‘ভাই’ বলতো আর ছোট বোন রেহানাকে ‘আপু’ বলত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধু তখন ৬ দফা দিলেন, তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে রাসেল তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজত।

রাসেল বঙ্গবন্ধুকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। সে তাঁর আব্বাকে কখনও ছাড়তে চাইত না। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল সেখানে নিয়ে যেতেন। বেগম মুজিব ছোট  ছেলে শেখ রাসেলের জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন রাসেলও সেদিন পরত।   দেশ স্বাধীনের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী জাপান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল ও রেহানাকে জাপান নিয়ে যান। সেবার রাসেলের জন্য বিশেষ কর্মসূচিও রাখে তৎকালীন জাপান সরকার।

বঙ্গবন্ধুও শেখ রাসেলের প্রতি ছিল অপরিসীম পিতৃস্নেহ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলের কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থে ২৪৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ 

‘কারাগারের রোজনামচা’র ২৩৪ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক-ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে,  রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, ‘আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে।’ আমি ওকে বললাম, ‘তুমি রেহানাকে মার?’ রাসেল বলল, ‘হ্যাঁ মারি।’ বললাম, ‘না আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিল, ‘মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না।’

বঙ্গবন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। বেগম মুজিব বার্ট্রান্ড রাসেলের ফিলোসফি শুনে এমনই ভক্ত হয়ে যান যে- তারা তাদের ছোট সন্তানের নাম বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে রাখেন। শেখ রাসেলের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রামে ছিলেন। টেলিফোনে রাসেলের জন্মের খবর পান তিনি। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচতলাটি হয়েছে। উত্তর-পূর্বকোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়। মনে আছে আমাদের সে কী উত্তেজনা! আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা কাকা- অপেক্ষা করে আছি। বড় ফুফু, মেজ ফুফু তখন আমাদের বাসায়। আব্বা তখন ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচার কাজে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। বাসায় আমাদের একা ফেলে মা হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাছাড়া এখনকার মতো এত ক্লিনিকের ব্যবস্থা তখন ছিল না। এসব ক্ষেত্রে ঘরে থাকারই রেওয়াজ ছিল। ডাক্তার-নার্স সব এসেছে। রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট মানুষটি আর কত জাগবে। জামালের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, তবুও জেগে আছে কষ্ট করে নতুন মানুষের আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। এদিকে ভাই না বোন! ভাইদের চিন্তা আর একটি ভাই হলে তাদের খেলার সাথী বাড়বে, বোন হলে আমাদের লাভ। আমার কথা শুনবে, সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরানো যাবে, চুল বাঁধা যাবে, সাজাবো, ফটো তুলব, অনেক রকম করে ফটো তুলব। অনেক কল্পনা মাঝে মাঝে তর্ক, সে সঙ্গে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমরা প্রতি মূহূর্ত কাটাচ্ছি। এর মধ্যে মেঝ ফুফু এসে খবর দিলেন ভাই হয়েছে। সব তর্ক ভুলে গিয়ে আমরা খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম। বড় ফুফু রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন। কি নরম তুলতুলে। চুমু খেতে গেলাম, ফুফু বকা দিলেন। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, ঘাড় পর্যন্ত একদম ভিজা। আমি ওড়না নিয়ে ওর চুল মুছতে শুরু করলাম। কামাল, জামাল সবাই ওকে ঘিরে দারুণ হইচই।‘

দেশ স্বাধীন হলেও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বন্দি বেগম মুজিবসহ পরিবারের সবাই ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর তারার সহযোগিতায় মুক্ত হন ১৭ ডিসেম্বর। সে দিন রাসেলই তাদের পতাকা হাতে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। ছোট্ট রাসেলের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যে দিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন।  সে ক্ষণিকের জন্যও আব্বাকে হাতছাড়া করতে চাইত না। সব সময় রাসেল তাঁর  আব্বার পাশে পাশে ঘুরে বেড়াতো। রাসেল প্রত্যেক দিন বিকেলে গণভবনে যেত, তাঁর প্রিয় সাইকেলটাও সঙ্গে নিত। সাইকেল চালানো তাঁর খুব প্রিয় শখ ছিল। রাসেলের মাছ ধরা খুব পছন্দ ছিল। রাসেল মাছ ধরার পর আবার ছেড়ে দিতো।

টুঙ্গিপাড়ায় একটি ক্ষুদে বাহিনী ছিলো রাসেলের। রাসেলের ক্ষুদে বাহিনীর জন্য ঢাকা থেকে জামা-কাপড় কিনে দিতে হতো। রাসেল ক্ষুদে বাহিনী সদস্যদের বাড়ির উঠানে প্যারেড করাত। তাঁর একমাত্র চাচা শেখ নাসের রাসেলকে ১ টাকার নোটের বান্ডিল দিলে, রাসেল ক্ষুদে বাহিনীর সদস্যদের লজেন্স বিস্কুট কিনে খেতে দিত এই টাকা থেকে। রাসেলের খুব ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। সে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা পছন্দ করত। বাড়ির প্রাঙ্গণ, বাড়ির সামনের রাস্তা, লেকের ধার ও ফুফুদের বাসা ছিল তাঁর বিচরণ ভূমি। ১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। রাসেল মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিন বেঁচে ছিল। আজ শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে ৫০ বছরে পা রাখতেন। 

শেখ রাসেল একটি আবেগপ্রবণ সত্তা, শিশু অধিকার রক্ষার মূর্ত প্রতীক। শেখ রাসেলের বাঁচার অধিকার হত্যাকারীরা অভয় দিয়েও রক্ষা করেনি। শেখ রাসেল বিশ্বের অধিকারহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত শিশুদের প্রতীক ও প্রতিনিধি। আজ রাসেল বেঁচে থাকলে হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি, বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতকে করতে পারতেন আরও শক্তিশালী। পরিশেষে বলবো, শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। শেখ রাসেল তোমার মৃত্যু নাই, তুমি বেঁচে আছ কোটি শিশুর অন্তরে। শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল।
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়