সাকিবের উচিত ছিল তামিমকে আগলে রাখা : মিশা সওদাগর
মিশা সওদাগর || রাইজিংবিডি.কম
এই নিবন্ধের শুরুতে আমি যে কথাটি বলতে চাই- ক্রিকেটে যাদের অর্জন রয়েছে তাদের কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আমরা যদি বলি- টেস্টে এনামুল, স্পিনার তাইজুল; আমাদের দেখা সবচেয়ে ভালো ক্যাপ্টেন মাশরাফি; তারও আগে যদি যাই রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলট, হাবিবুল বাশারসহ অন্যদের অবদান ভোলা যাবে না।
তারও আগে যদি আমরা যাই নান্নু, আকরাম, আতহার, লিপু ভাই, হিরা ভাই এদের অবদান অস্বীকার করতে পারব না। দেশের ক্রিকেট সমৃদ্ধ করার পেছনে এদের প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। এর সঙ্গে যারা পরিচালনা বা নির্বাচকমণ্ডলী ছিলেন- সাবের হোসেন চৌধুরীসহ স্বাধীনতার পর থেকে যারা ক্রিকেটকে আজকের পর্যায় নিতে নিরলস কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকের অবদান অনস্বীকার্য।
শুধু তাই নয়, সরকারের এখানে সহযোগিতা রয়েছে। সরকার দেশের খেলাধুলা সমৃদ্ধ করতে বিকেএসপি করেছে। সংস্কৃতির যে অঙ্গনগুলো রয়েছে এর মধ্যে একমাত্র ক্রিকেটই বিশ্ব দরবারে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদানে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা।
আজকে যদি আমাদের ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করতে হয় তবে শুরুর সেসব দিন নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। আমাদের লোকাল ছেলেগুলোই তো ইন্টারন্যাশনালি তাদের দক্ষতা দেখাতে শুরু করল। অপি সেঞ্চুরি পেল, আশরাফুল অস্ট্রেলিয়ার বিপরীতে অসাধারণ ইনিংস খেলল। আমরা সেই ম্যাচে জয়ী হলাম। আমরা বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারালাম। ফলে সেইসব দিন; যে দিনগুলো আজকে আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে সেই দিনগুলো আমরা যেন সমালোচনার আগে ভুলে না-যাই। আজ যদি চলচ্চিত্রে খান আতা, জহির রায়হানকে অস্বীকার করি তাহলে তো চলচ্চিত্রকেই অস্বীকার করা হবে। এটাও ঠিক তেমনি।
হ্যাঁ, এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। কথা হলো, চলতি বিশ্বকাপে কেন আমরা দক্ষতা অনুযায়ী ভালো খেলতে পারলাম না। দলে ইগো সমস্যা থাকতেই পারে। একটা দলে দুইটা স্টার কেন তিনটা স্টারও থাকতে পারে। ব্যাপার হচ্ছে এই যে সুপার স্টারদের যারা পরিচালিত করবে তাদের এমন ব্যক্তিত্ব চাই যে, ব্যক্তিত্ব তাদের মনে করিয়ে দেবে- তুমি যত ভালো স্টুডেন্টই হও না কেন আমরা তোমাদের শিক্ষক। তোমাকে রেগুলার ক্লাসে আসতে হবে। টিচারের কথা শুনতে হবে।
১১ জন মাঠে খেলে। এই প্লেয়ারদের তৈরি করতে স্টাফ লাগে, মেইন কোচ লাগে, বোলিং কোচ লাগে, ফিল্ডিং কোচ লাগে, ম্যানেজার লাগে। সাবাইকে এক সুতায় গাঁথতে হবে। এদের যদি আমরা কন্ট্রোল করতে না পারি তা হলে আমাদের ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থ। সুতরাং তাদের অসম্ভব ব্যক্তিত্ববান হতে হবে।
আমরা যদি তামিমের স্টেটমেন্ট ধরে নেই- কোনো এক কর্মকর্তা তাকে রাতে ফোন করে বললেন যে, তোমার যেহেতু শরীর খারাপ তুমি ৫-৬ এ নামবে। আমার প্রশ্ন হলো- কেন রাতের আঁধারে তাকে ফোন করবে? তাকে সম্মানের সঙ্গে ডেকে নিয়েও তো কথাটি বলা যেত। যে লোকটি বিশ্বের বড় বড় বোলারদের ফেস করেছেন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে যার বেশ ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে; যিনি সিনিয়র প্লেয়ার তাকে তো রাতে ফোন দিয়ে নয়, দিনে ডেকে মুখোমুখি বসে কথা বলা উচিত ছিল।
সাকিবের সঙ্গে তামিমের যে অসহিষ্ণু সম্পর্ক; অন্তত মিডিয়ার কল্যাণে যতটুকু জেনেছি, এত দিন আপনি কি করলেন? কেন এই দূরত্ব কমাতে পারলেন না? দেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে একটি লোকও কি ছিল না যে, তাদের দূরত্ব দেশের স্বার্থেই দূর করাতে পারে? ভুলে গেলে চলবে না- আমাদের দেশের মানুষের আবেগের নাম ক্রিকেট।
আমি মনে করি, এ সব কারণেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাপন সাহেব বলেছেন- ওরা দুজন দুজনে কথা বলে না… ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন- আপনি কেমন অভিভাবক? মিমাংসা করতে পারলেন না? আমি চলচ্চিত্র সমিতির উদাহরণ টেনেই বলি, ইলিয়াস কাঞ্চন ভাইকে আমি বলেছি, আপনি এখন দায়িত্ব নিয়েছেন, আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি তো পারতেন রুবেল ভাইকে ডেকে, ডিপজল ভাইকে ডেকে সুন্দরভাবে শিল্পী সমিতিটাকে পরিচালনা করতে। ঠিক একইভাবে যিনি দায়িত্বে আছেন, উদ্যোগ শুরুতে তাকেই নিতে হবে। ক্রিকেট টিমকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ক্রিকেট বোর্ড থেকে শুরু করে সবাইকে এক সুতোয় গাঁথতে হবে। কারো মধ্যে ইগো থাকলে সেটা মাঠের বাইরে থাকবে। দলে কেন এর প্রভাব পড়বে?
এই বিশ্বকাপেই বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মাকে দেখছি। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথাও শুনেছি। কিন্তু মাঠে তো তার প্রভাব দেখছি না। দলের জন্য প্রত্যেকে নিবেদিত প্রাণ। যত মতভেদ থাকুক, দলীয় সিদ্ধান্ত তারা প্রত্যেকে সম্মান করে।
অনিল কুম্বলের ক্যারিয়ার একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নতুন স্পিনার পাইপ লাইনে রেডি। অস্ট্রেলিয়া টেস্টের আগে নির্বাচকমণ্ডলী জানিয়ে দিলেন কুম্বলে দলের বাইরে থাকবেন। তখন সৌরভ গাঙ্গুলি অধিনায়ক। তিনি চার ঘণ্টা নির্বাচকদের সঙ্গে বারগেনিং করলেন। বললেন, কুম্বলে এত দিন সার্ভিস দিয়েছে, এখন ড্রপ দিলে ওর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। গাঙ্গুলির চাপাচাপিতে সেই টেস্টে কুম্বলে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। তাহলে তামিমকে কেন বাদ পড়তে হলো? তামিম যদি থাকতো, জুনিয়র তামিম অনেক ভালো করতো, তখন ও রিস্ক নিয়ে খেলার সাহস পেত। যেভাবে সৌরভ কুম্বলেকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল, সাকিবের উচিত ছিল সেভাবে তামিমকে আগলে রাখা।
আমি ভেবে অবাক হই- সাকিব কীভাবে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে এভাবে ইন্টারভিউ দিল! এটা খেলোয়াড়সুলভ আচরণ হলো না। ক্যাপ্টেন হিসেবে তো নয়ই। ওমর সানী আমাকে নিয়ে ফেইসবুকে অনেক কথা বলেছেন। আমি কিন্তু বলিনি। সাকিব তো বলবে- আমার তামিম ইকবালকে দরকার। ম্যানেজার নাফিস কেন একদিন আগে চেঞ্জ হবে? ওদের তিন পুরুষ ক্রিকেট খেলছে। ওদের অবদান ভুলে যাব?
আমি মনে করি, তামিমকে বিশ্বকাপে সঙ্গে রাখলে আজকে এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না। আবারও চলচ্চিত্রের উদাহরণ দিয়ে বলি, কোনো সিনেমায় যখন আমি হুমায়ূন ফরীদি ভাই আছে জানতাম, তখন আমি মনে করতাম- আরে! ফরীদি ভাইয়ের মতো অভিনেতা আছেন, তিনি সিনেমা টেনে নিয়ে যাবেন। তামিম থাকলে দলের কনফিডেন্স অবশ্যই বাড়ত। খেলাগুলো স্মরণ করুন- সাকিবকে মাঠে এত নার্ভাস আমি জীবনেও দেখিনি!
আমি চাই এই বিশ্বকাপ আমাদের আবেগের যে জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা ভুলে যেতে। ধরে নেই, তামিম ভুল করছে; তামিমকে বুঝাতে হবে। যত বাড়বে বিভক্তি ততই কমবে শক্তি। আমরা ভাগ হবো কেন? একত্রিত থাকব। তামিমের সঙ্গ যা ঘটেছে সেটা আর কারো সঙ্গে যেন না ঘটে। এতে দিন শেষে দেশের ক্ষতি।
সব শেষে বলতে চাই- বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে কোনোভাবেই ক্যাপ্টেন হিসেবে দেখতে চাই না। কারণ এটা তার জন্য বাড়তি চাপ। এই বাড়তি চাপ নেয়ার দরকার নেই। শচীন টেন্ডুলকারকে কিন্তু দেয়া হয়েছিল দায়িত্ব। তিনি তখন পারফর্মেন্স সবচেয়ে খারাপ করছিলেন। আমি চাই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ ক্যাপ্টেন হোক। বড় স্টারের প্রয়োজন নেই। ক্যাপ্টেনের মূল কাজ দল পরিচালনা করা। সাকিবের এই বাড়তি চাপ তার মেধা নষ্ট করছে। ফলে আমি চাই খুব দ্রুত ক্যাপ্টেনশিপ থেকে সাকিবকে সরিয়ে নেয়া হোক।
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। আর সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অর্জন এই মুহূর্তে ক্রিকেট। এই ক্রিকেটকে কোনোভাবেই আবেগতাড়িত করা যাবে না। বিবেক দিয়ে বুঝে ক্রিকেটকে চালিত করতে হবে।
অনুলিখন : রাহাত সাইফুল
তারা//