ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

উড়ে এসে জুড়ে বসার আগে আরেকবার ভাবুন

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৪, ২০ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৮:৫৫, ২০ নভেম্বর ২০২৩
উড়ে এসে জুড়ে বসার আগে আরেকবার ভাবুন

এ ধরনের লেখা লিখতে চাই না, কিন্তু না-লিখেও পারি না। খবরে দেখছি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ওয়ান ডে অধিনায়ক এবং বিশ্ব ক্রিকেটের এক নম্বর অলরাউন্ডার) সাকিব আল হাসান ও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী মাহিয়া মাহি নমিনেশন ফরম তুলেছেন। সাকিব ঢাকার একটি আসন ও মাগুরার দুটি আসনের, মাহি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নমিনেশন ফরম কিনেছেন। 

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমের মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী সাকিব দিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। মাহি দিয়েছেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। অবশ্য তাদের কাছে এটি সামান্য টাকা বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন তারা সংসদ সদস্য হতে চাচ্ছেন?

আমার শিক্ষক বাবা বলতেন, জাল্যের কাজ জাল্যেরই করা ভালো। অর্থাৎ যার কাজ তারই সাজে। বলতে চাই, সাকিব-মাহিরা যদি সংসদে গিয়ে আইন পাসে অংশ নেন, তাহলে রাজনীতিকরা কী করবেন? যারা শিক্ষিত, যারা সৎ, যারা সাধারণ মানুষের জন্য চিন্তা করেন, যারা ছাত্র রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, যারা রাজনীতি নিয়েই কাটাচ্ছেন সময়- তারা তাহলে কী করবেন? 

সাকিবের জন্য রয়েছে বিসিবি। তিনি ক্রিকেটের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করবেন। মাহি ভাববেন সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র নিয়ে। তারা যে যার জায়গা থেকে দেশের জন্য কাজ করবেন। দেশের সংস্কৃতিতে অবদান রাখা দেশেরই কাজ। এ কাজ করতে হলে রাজনীতিতে আসতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। যে কোনো অবস্থান থেকেই দেশের কাজ করা যায়। তাছাড়া রাজনীতিতে আসতে হলে এ জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। এ জন্য সময় প্রয়োজন। নির্বাচন এলো আর হুট করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লাম বিষয়টি এতো সহজ না হওয়াই ভালো। 

অনেকে বলবেন, তাদের পরিচিতি আছে। অর্থবৈভব আছে। নির্বাচনে অংশ নিতে অসুবিধা কী? কিম্বা তাদের পরিবারের রাজনীতিতে অবদান রয়েছে। অনেকে বলবেন, এমন উদাহরণ আছে। বলবেন, সালাম মুর্শিদী, নাইমুর রহমান দুর্জয়, আরিফুর খান জয়, মাশরাফি, আসাদুজ্জামান নূর, ফারুক, কবরী, তারানা হালিম, সুবর্ণা মোস্তফা, মমতাজ প্রমুখের কথা। বাইরের দেশের পাকিস্তানের ইমরান খান, ভারতের অমিতাভ বচ্চনসহ অনেকে বিশিষ্ট তারকাদের কথা বলবেন। এ ছাড়া কলকাতাতেও এমন উদাহরণ রয়েছে যারা অভিনয়ে জনপ্রিয় থাকতে থাকতেই রাজনীতিতে এসেছেন। অথবা বলা ভালো তাদের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করা হয়েছে নির্বাচনে।  

হয়তো বলবেন, সংসদ সদস্য হলে অনেক অনেক সুবিধা। একটি বিশাল গাড়ি পাওয়া যায়। বিদেশে যাওয়া যায়। সালাম পাওয়া যায়। চামচা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধার কথা নাইবা বললাম। নজর যদি থাকে তাহলেও টাকার কুমিরও হওয়া যায়। মানুষের শরীরকে গন্ডারের শরীরও বানানো যায়। তখন কালো সানগ্লাস দিয়ে দেখা যায় না জনগণের চোখ বা শরীর।

এখন আপনি যদি এসব কারণে রাজনীতিতে আসতে চান তাহলে আর কথা থাকে না। এর উল্টোপিঠে যুক্তি না-দেয়াই ভালো। তবে কথায় আছে- বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। এই আপ্তবাক্য তো মৌসুমী রাজনীতিকদের বেলায়ও খাটে। 

সাকিব সদ্য ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে কি দিলেন? ভালো খেলোয়াড় নিঃসন্দেহে তিনি। তবে তাঁর আচরণে স্থিরতা নেই। তাকে নিয়ে সমালোচনা আছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন। এ ছাড়া তিনি এখনও ক্যারিয়ারই শেষ করেননি। সবাই জানেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সারা বছর খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জনগণের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা কতটুকু এ প্রশ্ন উহ্য রেখে গেলাম। 

এখন ধরুন, ঢাকার যে আসনটিতে বা মাগুরার যে আসন দুটোর জন্য তিনি চিন্তা করছেন, সেখানকার যারা রাজনীতিক, যারা সব সময় জনগণের কাছাকাছি থাকছেন, তাদের রাজনীতির অধিকার, অবদানের পর প্রাপ্তি নিয়েও তো ভাবতে হবে। সাকিবের প্রায় প্রতিটি ম্যাচ আমি দেখেছি কিন্তু মাহির অভিনয় আমার দেখার তেমন সুযোগ হয়নি। তারপরও ধরে নিচ্ছি, তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনয়শিল্পী। প্রশ্ন হলো, মাহি তার অভিনয়ের রাইজিং স্টেজ ছেড়ে কেন রাজনীতির মঞ্চে আসছেন? উত্তর এ রকম হতেই পারে যে, এক মাধ্যমে পরিচিত হয়ে আরেকটি বৃহত্তর মাধ্যমে গিয়ে খ্যাতিমান হওয়া, যশ-সম্মান কামানো। 

এ রকম নমিনেশন পত্র যারা তুলছেন, তুলবেন তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন- কেন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশ, বুদ্ধিজীবী নির্বাচন এলেই রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন। জনগণের জন্য আইন পাসে অংশ নিতে হলে, আগে গণতন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত নয় কি? এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এবং মানুষের মন বোঝার চেষ্টা করা উচিত নয় কি? বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যিক ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি গভীরভাবে জানা দরকার নয় কি? 

আপনি কি পড়েছেন ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ কিম্বা কয়বার পড়েছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’? নদী বাহিত বাংলার কতগুলো গ্রাম আপনি দেখেছেন? আপনি কি জানেন, বঙ্গবন্ধু কেন রবীন্দ্রনাথের লেখা স্বদেশ চেতনার গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীত করলেন? 

আপনাদের উপদেশ বা জ্ঞান দেয়ার জন্যেও নয়, আপনাদের ভালোবেসেই কথাগুলো বলছি। কারণ আপনার মাথায় জনগণের চিন্তা থাকতে হবে, দেশপ্রেম থাকতে হবে, ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকতে হবে। এর বাইরেও মূল কথা- মানুষের কাছাকাছি থাকতে হবে। 

এত দিন ধরেব এলাকায় যারা রাজনীতি করছেন তাদের কথাও তো আপনাদের ভাবতে হবে। না কি ভেবে বসে আছেন টাকা তো আছেই। সব ম্যানেজ করে ফেলা সম্ভব! বিষয়টি এতো সরল নয়। দলের কথা বাদ দিন, মানুষ আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে সেই কথা আগে জানার চেষ্টা করুন। 

এ কথা ঠিক রাজনীতিতে এখন দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। অর্থ-লোভ-লালসা আর ক্ষমতা নামক সোনার হরিণ হাসিল করার নগ্ন প্রতিযোগিতা চলছে। বিত্ত-বৈভবে টিকে থাকার লড়াইয়ে মত্ত অনেকে। দেখা যাচ্ছে সেই পুরনো প্রবাদ- জোর যার মুল্লুক তার। আপনার টাকা আছে তো সব আপনার। আপনার ক্ষমতা আছে তো আপনিই শেঠ। মাসলম্যানদের দৌরাত্ম্যে সমাজ ক্ষয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে নৈতিক ও আদর্শিক কাঠামো। বাংলাদেশে বিগত দেড় যুগে অবকাঠামো অনেক উন্নয়ন হয়েছে- অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নৈতিক উন্নয়ন কি হয়েছে? এই উন্নয়নের জন্যও রাজনীতিকদের চিন্তা করতে হবে। সবাইকেই করতে হবে। কারণ একটি দেশ দাঁড়িয়ে থাকে তার ভাষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার ওপর। আমরা কি সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি না? এ ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতিবান হওয়া উচিত। আমাদের আচরণ, নীতি ও নিষ্ঠার শক্তি দৃঢ় করা দরকার। 

প্রিয় সাকিব আপনার উচিত বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আপনি আমাদের ক্রিকেটের আইকন। আর মাহি, সুচিত্রা সেনের কথা ভাবুন না? অভিনয় দিয়ে জাগিয়ে তুলুন বাংলাদেশ, বিশ্ব। মনে রাখবেন রাজনীতি বড় নির্মম। রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতেই থাকুক। আর যদি রাজনীতি করবেনই বলে ঠিক করেন তাহলে আগে মানুষের কাছে যান। দলের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে অন্তত পাঁচ বছর কাজ করুন। রাজনীতির অ আ ক খ স্থানীয় দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে না বসলে শেখা খুব কঠিন। কর্মীদের সঙ্গে মিশুন। মানুষের সুখ-দুঃখ, এলাকার অভাব, অভিযোগ জানুন। সেগুলো দূর করার চেষ্টা করুন। মানুষ অন্তত জানুক আপনার পরোপকারী ইতিবাচক মানসিকতার কথা। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে তারপর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করবেন। 

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে রাজনীতি করা থেকে নিরুৎসাহিত করা নয়। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে যে কেউ চাইলে নাগরিক হিসেবে অবশ্যই সংসদ সদস্য হতে চাইতে পারেন। কিন্তু এ জন্য আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।   

এই কথাটি বলেই শেষ করি। ধরুন একটি ছেলে, স্কুলে ক্লাস ক্যাপ্টেন, তারপর কলেজে গিয়ে দেশ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভাবছে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের অধিকার বা দেশের কোনো রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলো সে। মাঠের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়ে উঠল। একইসঙ্গে পড়াশোনাও চলল। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলো। এখন এই লোকটি যদি কোনো দলের হয়ে জাতীয় নির্বাচন করতে চায় এবং পাশাপাশি আপনি অন্য সেক্টর থেকে এসে তাকে টেক্কা দিয়ে নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন নেয়ার চেষ্টা করেন তাহলে কতটা যৌক্তিক হবে? সেই লোকটি যদি আপনাকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক’ ভাবে তবে কি খুব অযৌক্তিক হবে? 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়