বুদ্ধিজীবীদের রক্তঋণ যেন ভুলে না যাই
বুদ্ধিজীবী আর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে ধোয়া দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশ। মুক্তচিন্তা, প্রগতিমুখী সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই দেশ। আজ কতটা মুক্তচিন্তার চর্চা করছে এই প্রশ্নটি সামনে রেখে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা যাক।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যই পরিচালিত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। যুক্তিবাদের সংস্কৃতি প্রসারে বুদ্ধিজীবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এক কথায় সমাজ মানস গঠনে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ মানস গঠনে যারা দিকপাল হিসেবে কাজ করছিলেন, দেশ স্বাধীনের প্রাক্কালে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে, বাঙালি জাতিকে দিশাহীন ভবিষ্যৎ-এর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
দিনটি ১৪ ডিসেম্বর, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। একাত্তরের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ঠিক আগ মুহূর্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের শূন্যতার প্রভাব ধীরে ধীরে পরিলক্ষিত হয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে ঠিকই কিন্তু সমাজ মস্তিষ্কের অনেকাংশ রক্তাত্ব আর নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। পাক-বাহিনী এদেশের বাঙালি শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ আরও অনেককে হত্যা করে। ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমাদের হাতে নেই। তবে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে সরকার ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা করে। পুরোপুরিভাবে এই তালিকা প্রকাশ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ১৪ ডিসেম্বর দেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করার পর তাদের মৃতদেহ তিন দিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে ছিল। ক্ষতবিক্ষত সেই সব শরীরের রক্ত ও রস মিশে গিয়েছিল বাংলার মাটিতে। শহিদের শরীর পরিণত হয়েছিল শিয়াল, শকুন কিংবা কুকুরের খাবারে।
এরপরেও কি হত্যা করা গেছে তাদের চেতনা। পাকিস্তানীরা হত্যা করতে পারেনি বুদ্ধিজীবীদের চেতনা। আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ সেই চেতনার উত্তরাধিকার। এই চেতনা আমরা কোথায় ব্যবহার করবো! তাদের আদর্শ ও পথ অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন। আমাদের সমাজ মানস সেই আত্মত্যাগের অনেকখানি ভুলে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে কলুষিত করেছে।
এ বছর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ত্যাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদীচক্র এবং গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির যেকোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে।
শাসক ও শাসিতের জন্য এই হোক করণীয়। আমরা চাই, রাষ্ট্রের প্রপঞ্চগুলো ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্বের কবল থেকে সব সময় সুরক্ষিত থাকুক। দেশ ভালো থাকুক। বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তঋণ আমরা যেন ভুলে না যাই।
লেখক: কবি
/এসবি/