ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

বছরের শুরুতেই থেমে গেলো আরেক ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কণ্ঠ

সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৭, ১০ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২১:৪৯, ১০ জানুয়ারি ২০২৪
বছরের শুরুতেই থেমে গেলো আরেক ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কণ্ঠ

প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন রশিদ খান। গত কয়েক বছর ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। শুরুতে মুম্বইয়ের একটি নামী ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে সেখান থেকে কলকাতায় আসেন। এরপর মাঝে মধ্যেই অসুস্থতার কথা শোনা যেত তার। সুস্থ হচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। কিন্তু এরপর ব্রেন স্ট্রোক হওয়ায়, প্রায় মাস দু'য়েক হাসপাতালে ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার শহরের একটি বেসরকারি হাসাপাতালে বিকেল ৩.৪৫ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নভেম্বরের শেষ থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।  

উস্তাদ রশিদ খান হিন্দুস্তানি ঐতিহ্যের একজন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার অন্তর্গত ছিলেন এবং ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ইনায়েত হোসেন খানের প্রপৌত্র ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন সোমা খানকে।

বিভিন্ন সংস্করণে বলা একটি গল্পে, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী একবার মন্তব্য করেছিলেন যে রশিদ খান ছিলেন ‘ভারতীয় কণ্ঠ সঙ্গীতের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা’।  তিনি ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী , পাশাপাশি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০২২ সালে শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
রশিদ খান ১ জুলাই ১৯৬৮ সালে উত্তরপ্রদেশের বাদায়ুনের সহসওয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তার মামা ওস্তাদ নিসার হুসেন খানের (১৯০৯-১৯৯৩) কাছ থেকে। রশিদ খান ছিলেন ওস্তাদ গোলাম মুস্তফা খানের ভাতিজা। 

তিনি রশিদ খানের ভেতর সঙ্গীত প্রতিভা লক্ষ্য করা প্রথম ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন এবং কিছু সময়ের জন্য তাকে মুম্বাইতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।  যাইহোক, তিনি তার প্রধান প্রশিক্ষণ নিসার হোসেন খানের কাছ থেকে গ্রহণ করেন, প্রাথমিকভাবে বাদায়ুনে তার বাড়িতে। একজন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, নিসার হুসেন খান ভোর চারটা থেকে ভয়েস ট্রেনিং ( স্বর সাধনা ) এর উপর জোর দিতেন এবং রশিদকে ঘন্টার পর ঘন্টা স্কেলের একটি নোট অনুশীলন করাতেন।  সারাদিন শুধু একটি নোট অনুশীলন করতেই কেটে যায়। যদিও রশিদ শৈশবে এই পাঠগুলিকে ঘৃণা করতেন। ১৮ বছর বয়সে রশিদ সত্যিকার অর্থে তার সংগীত প্রশিক্ষণ উপভোগ করতে শুরু করেছিলেন। রশিদ খান এগারো বছর বয়সে তার প্রথম কনসার্টে অংশ নেন। এর পরের বছর তিনি ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে একটি আইটিসি কনসার্টে পারফর্ম করেন। 

রামপুর-সহসওয়ান গায়াকি (গানের স্টাইল) গোয়ালিয়র ঘরানার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত , যেখানে মাঝারি-ধীর গতি, একটি পূর্ণ-গলা কণ্ঠস্বর এবং জটিল ছন্দময় খেলা রয়েছে। রশিদ খান বিলম্বিত খেয়ালে ধীরগতির বিশদ বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি সরগাম এবং সরগম ট্যাঙ্কারি (স্কেলের খেলা) ব্যবহারে ব্যতিক্রমী দক্ষতার বিকাশ করেছেন। তিনি আমির খান এবং ভীমসেন জোশীর স্টাইল দ্বারা প্রভাবিত ।

রশিদ খান তার গুরুর মতো তারানাতেও একজন ওস্তাদ কিন্তু সেগুলিকে নিজের ঢঙে গেয়েছেন, যন্ত্রের স্ট্রোক-ভিত্তিক শৈলীর চেয়ে খেয়াল শৈলী পছন্দ করেছেন যার জন্য নিসার হোসেন বিখ্যাত ছিলেন। যন্ত্রের সুরের অনুকরণ নেই।

তার রেন্ডারিংগুলি তার সুরেলা বিশদ বর্ণনায় আবেগের আধিক্যের জন্য আলাদা। তিনি বলেছেন: ‘আবেগজনক বিষয়বস্তু আলাপে হতে পারে, কখনও কখনও বন্দীশ গাওয়ার সময়, বা গানের অর্থ প্রকাশ করার সময়।’ এটি তার শৈলীতে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসেন। 

রশিদ খান খাঁটি হিন্দুস্তানি সঙ্গীতকে হালকা বাদ্যযন্ত্রের ঘরানার সাথে মিলিয়ে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, যেমন সুফি ফিউশন রেকর্ডিং নয়না পিয়া সে ( আমির খুসরোর গান )। তিনি সেতারবাদক শহীদ পারভেজ এবং অন্যান্যদের সাথে যুগলবন্দীও করেছেন ।

উস্তাদ রাশিদ খান সম্পর্কে ঋতুপর্ণ ঘোষ একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’। প্রথম বার তার গান শুনে ভীমসেন জোশী বলেছিলেন, ‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার ভবিষ্যৎ পেয়ে গিয়েছে।’ সেই ‘ভবিষ্যৎ’ই অকালে অতীত হয়ে গেলেন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।

ঐশ্বর্যমণ্ডিত কণ্ঠের জাদুতে যিনি মাত করেছেন শ্রোতার হৃদয়, তার প্রয়াণকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে অপরিমেয় ক্ষতি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। উস্তাদ রাশিদ খানের প্রয়াণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই ‘সোনার কণ্ঠ’ এখন অতীতকাল, ঘটমান বর্তমান নয়। গান শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তার সহশিল্পী আর শ্রোতারা? তারাও তো সেই কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে যেতেন লহমায়।

গানবাজনার একটা দিক যদি হয় ‘রিয়াজ’ অর্থাৎ অনুশীলন, তবে অন্য দিক হল আবেগ। এক সাক্ষাৎকারে রাশিদ এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনের যে ছোট ছোট দুঃখ, অপ্রাপ্তি— সেই সব রং আমি গানের মধ্যে আনার চেষ্টা করি।’ সেই চেষ্টা করেছেন বলেই হয়তো তিনি গলা মেললেই শ্রোতারা বলে উঠতেন ‘আহা!’ তিনি গলা মেললে তৈরি হত কিছু অলৌকিক মুহূর্ত। যে কারণে হয়তো ঋতুপর্ণ তার ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ছবির শেষ দৃশ্যে রাশিদের কণ্ঠ ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন। কী ছিল সেই দৃশ্যে? স্মৃতিভার ফিরে ফিরে আসছে মৃত্যুপথযাত্রী অমিতাভ বচ্চনের। কিছু মনে পড়ছে, কিছু পড়ছে না। আবহে সেই ঐশ্বরিক কণ্ঠে মিশ্র পিলু-মিশ্র বরোয়াঁ রাগে উত্তুঙ্গ আলাপ। যে আলাপ শেষে শুরু হবে রাশিদের কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…’।

ছোটবেলায় আর পাঁচজন শিশুর থেকে আলাদা ছিলেন না রাশিদ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় রিয়াজ করতে চাইতেন না। বেশি ক্ষণ রিয়াজ করলে ‘বোর’ হয়ে যেতেন। মনে হত, গানবাজনা ছেড়ে দিই। অনেকে বলতেন, ‘গলা ভাল, গান করো।’ কিন্তু তার ইচ্ছে হত না। দাদু নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। খুব রাগী। তার সঙ্গে কথাই বলা যেত না। রিয়াজে একটু ভুলচুক হলে সোজা চড়-থাপ্পড়! মূলত তার ভয়েই রোজ নিয়ম করে রিয়াজ করতে হত। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে কথা অকপটে স্বীকার করেছিলেন রাশিদ।

১৯৭৮ সালে নিসার হোসেন খাঁ-সাহিব চলে আসেন কলকাতায়। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (এসআরএ)-র গুরু হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সঙ্গে আসেন রাশিদও। তিনি পরীক্ষা দেন এবং ‘স্কলার’ হিসাবে দাদুর কাছে শিক্ষা শুরু করেন। সে সময়ে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এ কানন, মালবিকা কানন, বিজয় কিচলু, ভিজি যোগ এবং দীপালি নাগের মতো ব্যক্তিত্ব। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কুমারপ্রসাদকে বলেছেন রাশিদ, প্রথম শেখা রাগ ভৈরব। কয়েক মাস শুধু ‘সা’ বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন দাদু। তার পর কয়েক মাস ধরে চলত খরজে রিয়াজ। অতঃপর দ্রুতলয়ে বিভিন্ন বন্দিশ শেখাতেন নিসার হোসেন। বিলম্বিত শেখা তখনও শুরু হয়নি। এসআরএ-তে আসার পর গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভালবাসতে শেখেন রাশিদ। দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ মোটেও সহজ ছিল না। সে সময়ে তার পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এ কানন, মালবিকা কানন, বিজয় কিচলু, ভিজি যোগ এবং দীপালি নাগের মতো ব্যক্তিত্ব। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কুমারপ্রসাদকে বলেছেন রাশিদ, প্রথম শেখা রাগ ভৈরব। কয়েক মাস শুধু ‘সা’ বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন দাদু। তার পর কয়েক মাস ধরে চলত খরজে রিয়াজ। অতঃপর দ্রুতলয়ে বিভিন্ন বন্দিশ শেখাতেন নিসার হোসেন। বিলম্বিত শেখা তখনও শুরু হয়নি। এসআরএ-তে আসার পর গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভালবাসতে শেখেন রাশিদ। দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ মোটেও সহজ ছিল না।

তাকে যে শিল্পী হতেই হবে, তার নেপথ্যে অবশ্য ছিল অন্য এক কাহিনি। এক সাক্ষাৎকারে রাশিদ বলেছিলেন সেই গল্পও। এক বার কলকাতার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে ভীমসেন জোশীর গান ছিল। রাশিদ ভেবেছিলেন, খুব কাছ থেকে ভীমসেনের গান শুনবেন। মঞ্চের পাশে এক জায়গায় বসেছিলেন। সে সময় এক উদ্যোক্তা তাকে সেখান থেকে উঠে যেতে বলেন। সেই ঘটনা রাশিদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ভেবেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আমি এক দিন এমন জায়গায় পৌঁছব যে, তোমাদের দৌড়তে হবে আমার পিছনে!’ খুব অল্প দিনেই রাশিদ সেই স্থান অর্জন করেছিলেন। এক বার ডোভার লেন থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এসেছেন উদ্যোক্তারা। যে দিন ডোভার লেনে অনুষ্ঠান, তার আগেই প্যারিসে রাশিদের অনুষ্ঠান। রাশিদ সেই অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি প্যারিস থেকে আমাকে উড়িয়ে আনতে পারেন, তাহলে আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গাইব।’

রাশিদের নিজের ঘরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘বোলতান’। যা রাশিদের গায়কিতে শেষ দিন পর্যন্ত ধরা দিত। সেই সঙ্গে ছোট ছোট সরগম করে বন্দিশের মুখড়াতে ফেরার যে শৈলী, তা-ও রপ্ত করেছিলেন। ফলে তার গানে যেমন নিসার হোসেন খাঁ-সাহিবের বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ করে স্বকীয় ছাপ আনার চেষ্টা করতেন তিনি। সেই সঙ্গে তার গানে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’। যা তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। কারণ, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব তারানা গায়নকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জানা যায় যে পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল রাশিদের। পুণেতে রাশিদের অনুষ্ঠান থাকলে ভীমসেন উপস্থিত থাকতেনই। পুণেতে রাশিদ আসছেন শুনলে এক ‘কমন ফ্রেন্ড’কে নির্দেশ দিতেন রাশিদকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তেমনই এক বার গিয়েছেন সন্ধ্যার পর। ভীমসেনের বাড়িতে আট-দশ জন শ্রোতা এসেছেন। রাশিদ গান করেছেন। গানের পর রাশিদকে ১০ হাজার টাকা ‘নজরানা’ দেন ভীমসেন। রাশিদ তো কিছুতেই নেবেন না। ভীমসেন বলেছিলেন, ‘কখনওই নজরানা ছাড়া গান গাইবে না!’

মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইলেও ফিউশন, বলিউড এবং টলিউডের ছবিতে বহু গান করেছেন রাশিদ। তার মধ্যে ‘যব উই মেট’-এর ‘আওগে যব তুম ও সাজনা’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

গজলের অ্যালবাম করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। তার কণ্ঠে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ঠুংরি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনতে চেয়ে অনুরোধ আসত শ্রোতাদের।

শিল্পীর প্রয়াণ হয়। কিন্তু শিল্পের তো হয় না। ফলে দেশ-বিদেশের অজস্র ভক্তের কাছে অনুরণিত হবে, হতেই থাকবে ‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’-র ‘ঐশ্বরিক’ কণ্ঠ।

/স্বরলিপি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়