ঢাকা     রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৯ ১৪৩১

টাঙ্গাইল তুমি কার: একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়া

লীনা পারভীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:১৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
টাঙ্গাইল তুমি কার: একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়া

টাঙ্গাইল শাড়ির GI (Geographical Indication) বা ভৌগোলিক নির্দেশক নিয়ে ভারত, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তোলপাড় আলোচনা চলছে। আমি কোনো ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞ বা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক বা ইতিহাসবিদ কিছুই নই। একজন সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বিষয়টিকে দেখার বা বুঝার চেষ্টা করেই এই লেখার অবতারণা।

ঘটনাটা হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘টাঙ্গাইল শাড়ির’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা ইংরেজিতে যাকে বলে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন সেটা দাবি করেছে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেই স্বত্ব পেয়েও গেছে বলে অতি সম্প্রতি জানা গেছে। আলোচনায় ঢোকার আগে বুঝে নিই, কী এই জিআই (GI) বা কী এর গুরুত্ব?

ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হচ্ছে কোনো সামগ্ৰীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নিৰ্দিষ্ট সামগ্ৰীর ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস (যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর) অনুসারে নিৰ্ধারণ করা হয়। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্ৰী নিৰ্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নিৰ্দিষ্ট প্ৰস্তুত প্ৰণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে। (গুগল থেকে নেওয়া)

আরো পড়ুন:

কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? আমি সহজে যেটা বুঝেছি সেটা একটা উদাহরণ নিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছি। উদাহরণটা মিলবে কি-না জানি না। তবে আবেগটা ধরতে পারলেই চলবে। ধরেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেটের অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ভারতের ভাগে চলে গেছে। ব্রিটিশরা অনেকটা গায়ের জোরেই শক্তিশালী ভারতের দিকে সকল প্রকার প্রাকৃতিক ঝর্ণা বা নদের অংশ মানচিত্রের সীমারেখার ক্যারিকেচারের মাধ্যমে উপহার দিয়ে গেছে। এর ফলে এখন কী হচ্ছে? আমাদের জাফলং বা যাদুকাটা নদীর সেসব ঝর্ণার সৌন্দর্য দূর থেকেই দেখতে হচ্ছে। পানির ছোঁয়া পেতে গেলে হিসাব রাখতে হয়, আমরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলির মুখে পড়বো কি-না। অতএব, নাগরিক হিসেবে আফসোস করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।

ঠিক তেমনি, আমাদের এই দেশের আনাচে-কানাচে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যার সাথে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সরাসরি যুক্ত। এই যেমন টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী অংশে অবস্থিত। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার একটি হচ্ছে টাঙ্গাইল। এ জেলা ঢাকা বিভাগের মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় আবার জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম। শতাব্দী প্রাচীন ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ সেই জেলারই একটি ঐতিহ্য। আর এই শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি হাতে বোনা হয়। আধুনিক মেশিনের কারুকার্য এটার বৈশিষ্ট্য নয়। ঊনবিংশ শতকের দিকে সেই এলাকার একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস আর জেলার নামানুসারেই বিষয়টা এখনও পরিচিত।

ইতিহাসের ফের, সাম্প্রদায়িক কারণে আমাদের ঐতিহ্য আজ বিভাজিত। দেশভাগ বা দেশভাগের পরবর্তী বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় বা নিম্নবর্গের হিন্দুরা অবহেলিত বা বঞ্চিত হওয়ার কারণে ভারতে পাচার হয়ে যায়। সেখানে গিয়েও সেইসব কারিগরেরা আবার শুরু করে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ‘টাঙ্গাইল শাড়ির’ বুনন। কিন্তু ভারতের সীমানায়, তাদের ভৌগোলিক সীমারেখায় বুনন করা শাড়ি কেমন করে টাঙ্গাইল শাড়ি হয়, সেই যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কী প্রমাণ দিলেন তারা জিআই কর্তৃপক্ষের কাছে, যা ভৌগোলিক সীমারেখায় টাঙ্গাইলকে ভারতের মধ্যে দেখালো?

আলোচনা যেহেতু শুরু হয়েছে, নিশ্চয়ই বিষয়টা কোথাও না কোথাও গিয়ে সুরাহা হবে বা হওয়া উচিত। বিষয়টা যতটুকু বুঝেছি তার থেকে এইটুকু অন্তত আমার বুঝা হয়েছে যে, এই যে টাঙ্গাইল জেলাকে ভারত যে ছিনিয়ে নিল, তার পুরো কৃতিত্ব ভারতের একার নয়। সিংহভাগ বাংলাদেশি নীতিনির্ধারক কর্তৃপক্ষের দায় চলে এসেছে। যতটুকু জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ফাইল রেড়ি করে অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন। হয়ত তারা ভেবেছিলেন, এ আর এমন গুরুত্বপূর্ণ কী বিষয়। একটা সময় পাঠালেই হয়ে যাবে। টাঙ্গাইল তো আমাদেরই আছে। কিন্তু উনাদের সম্ভবত ধারণাতেই আসেনি যে, ভারত আমাদের চাইতে শতবছর এগিয়ে রয়েছে চিন্তা ও চেতনায়। আর ভারত সরকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয় আমাদের চাইতে হাজার গুন চৌকস আর কৌশলী। আর আমরা কোথায় পড়ে আছি? আমাদের জামদানি ভাগ করে নিয়ে নিল ভারত। আমাদের সুন্দরবনের মধু নিয়ে নিল ভারত। আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না। এই যে পারলাম না, কেন পারলাম না- এই আলোচনাটুকু অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।

এভাবে করতে গেলে তো কদিন পর আমাদের যে সারা দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ আছে, সেগুলোও হারিয়ে যাবে বা ভারতের মত অন্য কোনো দেশ এসে ছিনতাই করে নিয়ে নিতে পারে। বলা যায় না, কবে আবার প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলো ব্রিটিশরা দাবি করে বসে যেহেতু তাদের ১০০ বছরের শাসন চলেছিল এই উপমহাদেশে।

আমাদের একটা আস্ত মন্ত্রণালয় আছে, তার নিচের বিভাগ আছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। এত বড় বহরের কাজ কী? তাদের কোনো রিপোর্টিং সিস্টেম কি আছে আদৌ? তাদের কাজ কে মনিটরিং করছে? এই যে টাঙ্গাইলের শাড়ি হাতছাড়া হয়ে গেল, এর পিছনে গাফিলতি কার সেটা কি কেউ খুঁজে বের করবে? এই আলাপ কোথায়?

আমি জানি না, আমাদের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে কি-না। GI একটি জাতির নিজস্ব পরিচয়কে চিরস্থায়ী করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয় বলেই আমার কাছে মনে হয়। এমনিতেই আত্মসংকটে ভোগা জাতি আমরা। তার মধ্যে যদি এভাবে নিজের ঘরের সম্পদ পরের হাতে চলে যায় তাহলে তো পরগাছা উপাধি পেতে আর বেশি সময় লাগবে না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনাও কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। তাই সরকারের কাছে দাবি রইলো, অতিসত্বর টাঙ্গাইলের শাড়ির বিষয়টি আপিল করার কোনো উপায় খুঁজে বের করে মীমাংসা করা হোক। আমরা নাগরিক জানতে চাই, কেন এমন হলো। আমাদের ঐতিহ্য আমাদেরই থাকবে। পাশাপাশি আরও যেসব ঐতিহ্য স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য, সেগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় এনে একটি সঠিক প্রসেস ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে পরিচয়ের ব্যবস্থা করা হোক।

 
লেখক: কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

আরও পড়ুন : টাঙ্গাইলের শাড়ি এবং এর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার

ঢাকা/এনএইচ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়