একটি ডাকে জেগে ওঠার ৭ই মার্চ
১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিল ছয়-দফার ভিত্তিতে। কারণ ছয়-দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। ভোটে জনগণ ছয়-দফার পক্ষে সমর্থন দেয়। জনগণ স্পষ্ট করেছিল তারা স্বাধিকার চায়। বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৬৪ সাল থেকেই স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন করে এসেছেন। স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধু একা একাই এগিয়েছেন। এখানে শেখ মুজিবুর রহমান অন্য বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দল থেকে সমর্থন পাননি। এমনকি আওয়ামী লীগ থেকেই কিছু জাঁদরেল নেতা দল ছেড়ে বেরিয়ে আলাদা পার্টি করলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন আতাউর রহমান (১৯৬৯ সালে জাতীয় লীগ নামে একটি দল গঠন করেন), আব্দুস সালাম ও অন্য নেতারা। শাহ আজিজুর রহমানও বেরিয়ে গেলেন। তখনই বঙ্গবন্ধু বুঝলেন, পথটা তাঁকে একাই চলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’এই গানটির মতো তাঁকে একা চলতে হবে। গানটি বঙ্গবন্ধুরও খুব প্রিয় ছিল। গানটি মহাত্মা গান্ধীও পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু সেই একলা চলো নীতি অবলম্বন করলেন।
১৯৭১ সালে নিবন্ধকার নবম শ্রেণীর ছাত্র, বয়স ১৩ বছরের কিছু কম। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুলে ক্লাস হয়েছে। ১ মার্চের পর সব ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। ৭ই মার্চের জনসভার প্রচার-প্রচারণা আগে থেকেই জোরেশোরে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন- এ বিষয়টি সবাই মুখে মুখে জেনেছেন। দেশবাসী এই ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। জনগণ মনে করেছিল বঙ্গবন্ধু এ ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দেবেন। যে সিদ্ধান্তে বাঙালি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন সত্তা লাভ করবে। এর আগে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা শাসক ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। তখন সারা বাংলাদেশ গর্জে ওঠে। এই গর্জে ওঠাটা কেউ আলোড়িত করেছে বলে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে জনগণ ঘর থেকে রাজপথে নেমে আসে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কর্মসূচি দ্রুত বদলে গেল। স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছিল, সেই খেলা বাতিল। সারাদেশের মানুষের মনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা। মানুষের সামনে সেদিন স্পষ্ট হলো, পাকিস্তানিরা চায় না বাঙালিরা কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতায় আসুক। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও এই খবর বেতার মারফত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান যে বক্তব্য রাখলেন এবং যে ঘোষণা দিলেন, তা ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু স্বাধিকারের জন্য কোনো জোট করলেন না। ছয়-দফার পক্ষে তিনি এককভাবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে লড়াই করলেন। বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন- ‘আপনি যখন স্বাধিকারের দাবি করছেন, তখন তো আপনি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারতেন। আপনি কেন জোট করলেন না?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, ‘জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে আমি আগ্রহী নই। কারণ অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।’
এটা তো সত্যি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারেনি। পরবর্তীকালে যেসব ফোরাম হয়েছিল, সেগুলো টিকতে পারেনি। তিনি এ কথা বললেন যে, জোট করে ক্ষমতায় এলে অন্য দলের দাবিদাওয়া পূরণ করতে গিয়েই মূল কর্মসূচি পালন করা যায় না। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই বঙ্গবন্ধু কোনো জোট করতে চাননি। এটা বাস্তব সত্যি যে, সেসময় অনেক রাজনৈতিক দলই বঙ্গবন্ধুর সহগামী হতে চায়নি এবং অধিকাংশই ছয়-দফার বিরোধিতা করেছিল। ভাসানী ন্যাপ, ওয়ালী ন্যাপ ছয়-দফার সারাসরি বিরোধিতা করেছিল। তারা সভা-সমাবেশে বলত, ‘ছয়-দফা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর প্রণীত দলিল।’
১ মার্চের পরেই আমাদের সংবাদপত্রগুলোর অবস্থানে গুণগত পরিবর্তন আসে। প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তনটা ১ মার্চের পর থেকেই পুরোপুরি নয়, শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর থেকেই। তখনকার সংবাদপত্রগুলোয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। আমরা দেখলাম সরকারের ট্রাস্টের পত্রিকা ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এগুলোর পলিসিতেও বেশ বড়ো পরিবর্তন এসেছে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সরকারের ট্রাস্টের পত্রিকা হলেও তারা বাঙালির অধিকার আন্দোলনের সংবাদগুলো যথাযথভাবেই ছেপেছে। তবে ‘মর্নিং নিউজ’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব বিরূপ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৯ সালে ‘মর্নিং নিউজ’র কার্যালয় জনগণ একবার পুড়িয়ে দিয়েছিল। তবে ‘দৈনিক পাকিস্তান’র ক্ষেত্রে তা হয়নি। তারা মোটামুটি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোকে সামনে এনেছে। পাকিস্তান সরকারের বক্তব্যও ছেপেছে আবার বাঙালির অধিকারের বিষয়ের যে ঘটনাগুলো ছিল, সেগুলোও ছেপেছে। আবার পাকিস্তানি প্রভাবশালী অন্য ব্যক্তিদের পত্রিকাগুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাই ‘পূর্বদেশ’, ‘অবজারভার’ এই পত্রিকাগুলোও বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তখন থেকেই সমর্থন করা শুরু করেছে। বিশেষত বাংলা সংবাদপত্র ‘পূর্বদেশ’ তখন থেকেই প্রচুর ফিচার নিউজ করেছে। তুলনায় মুজাফফর ন্যাপের পত্রিকা বা ওয়ালী ন্যাপের কাগজ ‘দৈনিক সংবাদ’র অবস্থান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ছিল না।
আসুন শুরু করি ‘সংবাদ’ দিয়ে। আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর সংবাদপত্রটি ছাপেনি। এখানে মূল কারণ ছিল, ‘সংবাদ’ তখন মুজাফফর ন্যাপ-ওয়ালী ন্যাপের মুখপত্র। আবার ১৯৭০-এর নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছিল। বহু জায়গায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করেছিল। পত্রিকাটি সে অবস্থান থেকে সরে আসার সময়টি তত দিনেও পায়নি। যে কারণে ‘সংবাদ’র ভূমিকাটা সেরকম দেখতে পাইনি আমরা। আবার ৭ই মার্চের পরে ‘সংবাদ’র মাধ্যেও গুণগত পরিবর্তন এসে গেল। কারণ তখন শেখ মুজিবের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি ওয়ালী ন্যাপের সমর্থন তৈরি হতে থাকে। যেসব পত্রিকা ফেব্রুয়ারিতেও একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছিল, তারাও ১ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে পুরো জাতির জেগে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়। অনেক সংবাদপত্রই জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ২ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং অবাঙালিরা বিভিন্ন স্থানে বাঙালির ওপর হামলা চালায়। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বহু বাঙালিকে হত্যা করা হয়। ঢাকা, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় চলে এই হত্যাকাণ্ড। বিক্ষোভ মিছিলে আর্মিরা গুলি চালিয়েছে, মানুষ মারা গেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে সেসব শহীদের কথা বলেছিলেন।
৭ই মার্চের ভাষণের আগে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের ভাষাও পালটে গেল। ৩ বা ৪ মার্চ থেকে দেখা গেল, পত্রিকার পাতায় ব্যাংকের যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো, সেই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বাঙালি স্বাধিকার, বাঙালির অধিকার, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, শেখ মুজিব- এসব প্রসঙ্গ চলে আসে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কবিতাও বিজ্ঞাপনে উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল পুণ্য হউক’- এই কবিতা দিয়েও অনেক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি দেখা গেল বাংলাদেশে পাকিস্তান ওরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব শাখা রয়েছে, তারাও তাদের বিজ্ঞাপনগুলোয় বাঙালির জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকীয় ভাষাও পালটে যায়। সম্পাদকীয়তে বাঙালির করণীয়, শেখ মুজিবের নির্দেশ, শেখ মুজিবের করণীয় ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে এসেছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্দেশনাবলি গুরুত্বের সঙ্গে প্রথম পৃষ্ঠায়ই ছাপা হয়েছে। আবার যারা উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তা শাসকের বিরোধিতা করেছেন। কী কারণে এবং কেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো, সে বিষয়ে লেখালেখি হয়েছে। যে ‘আজাদ’ পত্রিকা মুসলীগ লীগের পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল এবং বিভিন্ন সময়ে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করেছে, সেই ‘আজাদ’ পত্রিকা ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়।
সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানের পত্রিকা ‘পয়গম’। যেটি ১৯৬৯ সাল থেকেই চরিত্র কিছুটা পালটাচ্ছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭১-এর ওই সময়টায় ‘পয়গম’ পত্রিকার চেহারাও পালটে যায়। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘সংগ্রাম’, যাতে জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিগুলো বড়ো করে ছাপা হতো। শেখ মুজিবের সংবাদও থাকত, আবার পাকিস্তানি জান্তা শাসকদের সংবাদও থাকত। তারা একটা ব্যালেন্স করার চেষ্টা করত। তারা দেখছে, বাঙালির জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটছে এবং স্বাধিকার আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। জামায়াত এই আন্দোলনের ঘোরবিরোধী হলেও প্রকাশ্যে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেনি। বিশেষ করে জামায়াতের যে বিবৃতিগুলো ছিল সে সময়, অবিলম্বে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলা হয়েছে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা সেটা দিয়েছে। এমনকি নুরুল আমিন যিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনে পিডিএফ (পাকিস্তানি ডেমোক্রেটিক পার্টি) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিও শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলেছিলেন। যদিও পরে তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে। যখন জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়েছে, তখন সংবাদপত্রগুলো গণবিরোধী ভূমিকা নিতে সাহস করেনি। মওলানা ভাসানী ‘ভোটের আগে ভাত চাই, ব্যালট বাক্সে লাথি মারো’ বলে পাকিস্তানি শাসক জান্তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তার দলের প্রার্থী ঘাটতির কারণে ক্যান্ডিডেট দিতে পারেননি, সেই তিনি একাত্তরে এসে পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে বললেন- শেখ মুজিবের হাতে দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। ২ থেকে ৬ মার্চ প্রায় সব পত্রিকা, সম্পাদকীয়র ভাষা ছিল শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
উত্তাল সেই সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তারা রাজপথে মিছিল করছে। সারাদেশে একটা উত্তাল অবস্থা। এর পাশাপাশি ক্রমশ পেশাজীবীরাও রাস্তায় নেমে আসেন। সেনাবাহিনীদের সাবেকদের একটি সংগঠন, তারাও রাস্তায় এসে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি তুলতে থাকে। পরবর্তীকালে দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) তারাও শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে এবং শেখ মুজিবের নির্দেশকে বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রগুলোর বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনবিরোধী অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
৭ই মার্চের জনসভার বিষয়ে সব সংবাদপত্র ও ঢাকা বেতার থেকে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেই খবরগুলোয় বলা হয়েছিল, আগামীকাল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিকেল ৩টায় রেসকোর্স ময়দান থেকে ভাষণ দেবেন, সেই ভাষণ রেডিয়োতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সারাদেশের মানুষ ভাষণ শোনার জন্য উদ্গ্রীব। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন যারা সমাবেশে সরাসরি ভাষণ শুনতে আসতে পারেননি, তারাও রেডিয়োতে ভাষণ শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রেডিয়োতে ঘোষণা আসছিল যে ভাষণ প্রচার করা হবে। কিন্তু যখন ভাষণ শুরু হলো, তখন দেশের মানুষ হতবাক হয়ে গেল। রেডিয়ো ডেড সাইলেন্ট। কোনো সাড়াশব্দ নেই। এতে করে মফস্বল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়ে গিয়েছিল। তাদের চিন্তা ছিল, কী হলো? রেডিয়ো বন্ধ কেন? তাহলে কি জনসভা হচ্ছে না? বঙ্গবন্ধুর উপর কি আক্রমণ হলো?
মোট কথা, সারাদেশে একটা অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। নানা রকম গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তান টেলিভিশন এই সমাবেশ রেকর্ড করেনি। টেলিভিশন এ সংক্রান্ত কোনো কিছু সম্প্রচারও করেনি। ভিডিয়ো করেছিল পাকিস্তান সরকারের ডিএফপি ও ঢাকার একটি রেকর্ড কোম্পানি। বেতার রেকর্ডিং করেছে; কিন্তু সরাসরি সম্প্রচার করতে পারেনি। এদিকে যখন বঙ্গবন্ধু শুনলেন তাঁর ভাষণ রেডিয়োতে প্রচার হচ্ছে না, তখন তিনি ঘোষণা দিলেন, যদি বেতার ও টিভিতে এই ভাষণ ও আমাদের খবর প্রচার না করে, তাহলে আপনারা বেতার ও টিভিতে যাবেন না। তিনি কিন্তু এ কথা জনসভায় ভাষণের মধ্যেই বলেছেন। আমরা দেখলাম এরপর বেতার-টিভি থেকে কর্মচারীরা বেরিয়ে গেলেন। তারা অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে দিলেন। এতে পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তারা চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে আবার রেডিয়ো চালু করা যায়। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হলো। পরের দিন (৮ মার্চ ১৯৭১) সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হলো। রেডিয়ো কর্মচারীরা এর মাধ্যমে কাজে ফিরলেন। এটা আমাদের জন্য বিশাল অর্জন ছিল। কারণ আমি মনে করি, ওই বিদ্রোহটাই বাংলাদেশের জন্য বড়ো ঘটনা ছিল।
ঢাকা বেতারের এই পরিবর্তন সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের আশার আলো দেখায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে- এমন ধারণা আরও জোরালো হয়। রেডিয়ো পাকিস্তান ঢাকা বেতার থেকে ‘রেডিও পাকিস্তান’ নামটা মুছে গেল। ৩ মার্চ থেকে নতুন নাম হলো ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। চট্টগ্রাম বেতারও তাই করল। অন্য আঞ্চলিক বেতারগুলোও যার যার নামে চলে গেল। পাকিস্তান নামটা থাকল না। শুধু রাত ৮টার খবর, পাকিস্তান থেকে সম্প্রচার করা হতো, সেটিই কেবল প্রচার হতো। সম্ভবত ৩ মার্চের পরে সেটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকরা রেডিয়োর ওপর আর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারল না। ইতোমধ্যে ৩ মার্চের পর থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, সংবাদপত্রগুলো কিন্তু আগেই অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে নেমে গেছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। তবে ৭ই মার্চের ভাষণের পর ৮ মার্চ ঢাকা থেকে যে পত্রিকাগুলো বের হলো, তাতে আমরা দেখি যে, অনেক পত্রিকাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। ‘সংবাদ’ শিরোনাম করেছিল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যেটা খুবই যথাযথ ছিল। আবার ‘আজাদ’ও ভালো ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল। কিন্তু ‘ইত্তেফাক’ হেডিংটা করেছিল এমন, ‘পরিষদে যাইবার পারি যদি...’।
‘ইত্তেফাক’ হয়তো বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণটিকে উপলব্ধি করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যে চার দফা দাবি দিয়েছিলেন, তারা ওখানে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, এটা ‘ইত্তেফাক’ ঠিক উপলব্ধি করেনি। অথবা করে থাকলেও তা সেভাবে প্রকাশ করেনি। তখন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। পরে তাঁর পুত্র জাহীদ রেজা নূরের কাছ থেকে আমি জেনেছি শিরোনাম কী হবে, তা নিয়ে সিরাজুদ্দীন হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ভাষণে উপস্থাপিত চার দফা দাবিকে হাইলাইট করতে। বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে সেটিই ঠিক ছিল। কিন্তু সংবাদপত্রের দিক থেকে সেটি সঠিক ছিল না। কারণ চার দফা দাবি স্বাধীনতা ঘোষণাকে ছাপিয়ে নয়। কারণ স্বাধীনতার পথে এই চার দফা দাবি দরকার ছিল। কারণ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ চাননি। চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। যেহেতু বঙ্গবন্ধু একজন গণতান্ত্রিক নেতা, তিনি গণতন্ত্রের পথে যেতেই পছন্দ করবেন। গোটা রাজনৈতিক জীবনে কোনো পিচ্ছিল পথ, গোপন পথ বা ষড়যন্ত্রের পথ বঙ্গবন্ধু অবলম্বন করেননি। ৭ই মার্চের ভাষণেও তিনি তা করতে চাননি। ভাষণে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে সব দিকনির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। এখন আমরা পর্যালোচনা করে বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধু কীভাবে গেরিলাযুদ্ধের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। যারা বোদ্ধা, তারা হয়তো বুঝেছেন, যারা নির্বোধ, তারা হয়তো ভাষণ থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি। কারণ অনেকেই বলেছিলেন, কেন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন না- আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন?
মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তার এক বইয়ে লিখেছেন, কেন সেদিন শেখ মুজিব ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করলেন না? আরেকজন আহমেদ রেজা যিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ছিলেন, পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তিনিও লিখলেন, সেদিন ৭ই মার্চ যদি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করা হতো, দেশ তখনই স্বাধীন হয়ে যেত। কিন্তু তাদের বোধে এটা কাজ করেনি, শেখ মুজিব একটি জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধি। তিনি এ রকম হত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না। আর ক্যান্টনমেন্টে শুধু পাকিস্তানিই ছিল না, অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা-সেনা সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন।
‘পিপল‘ পত্রিকাটি তখন নতুন এসেছে। শেরাটন হোটেলের (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ১৯৭১ সালেও হোটেলটির নাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল) উলটো দিকে ছিল এই পত্রিকার অফিস। পিপলের সম্পাদক ছিলেন আবিদুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। তাঁর গাড়ির ব্যবসা ছিল। তিনি জাপান থেকে গাড়ি আমদানি করে বিক্রি করতেন। নিপ্পন মটরসের মালিক। ‘পিপল’ পত্রিকাটি তখন জনগণের মুখপত্র হয়ে গেল। ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য পাকিস্তান অবজারভার’হামিদুল হকের পত্রিকা। স্বভাবতই এটি পাকিস্তানপন্থী সংবাদপত্র। ‘মর্নিং নিউজ’ ছিল পাকিস্তান সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা। সেখানে ‘পিপল’ এসেই প্রো-পিপল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ শুরু করে। এ রকম একটি পত্রিকা বের করার জন্যই বঙ্গবন্ধু আবিদুর রহমানকে বলেছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাতেই আবিদুর রহমান ‘দ্য পিপল’ বের করেন। যেহেতু বিদেশিদের কাছে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকৃত খবর পৌঁছানো দরকার, সেজন্য পিপল পত্রিকা ওই সময় বাংলার যৌক্তিক স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে প্রচুর আর্টিকেল ছেপেছিল। নিবন্ধগুলোয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবের ছয় দফা ইত্যাদি বিষয় ছিল। আমরা দেখেছি রেহমান সোবহানের লেখাও ‘পিপল’ ছাপত।
এ সময় আবিদুর রহমানের ‘সাপ্তাহিক গণবাংলা’ নামে আরেকটি পত্রিকা ছিল। যেটি পিপল ভবন থেকে বের হতো। ওই কাগজটিতে কবি নির্মলেন্দু গুণ কাজ করতেন। ওই কাগজটি বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে অনেক লেখা ছেপেছিল। পত্রিকাটি বিশেষ ক্রোড়পত্রও বের করেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যেদিন মুক্তি পান, আবিদুর রহমান দুটি গান লিখেছিলেন। তার একটি গান পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে, তোমার স্বাধীন সোনার বাংলায়’। গানটি সুরকার ছিলেন সুজেন দাশগুপ্ত। অপরদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর করা একটি গানও আছে। গানটি আবিদুর রহমান নিজের অর্থেই রেকর্ড করিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে রাতেই ‘পিপল’ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাতে সংবাদপত্রটির কয়েকজন স্টাফ মারা যান। এরপর সংবাদপত্রটির সাংবাদিক ও সম্পাদক কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। এদিকে ক্র্যাকডাউনের কয়েকদিন পর ‘সংবাদ’ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হলে আগুনে সাংবাদিক সাবের শহীদ হন।
৭ই মার্চের ভাষণ সংবাদপত্রের স্টাফ রিপোর্টাররা নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করেছে। পুরো ভাষণটি কেউ ছাপেনি। কারণ তখন এত সুবিধা ছিল না। পরদিন পত্রিকায় আলাদা আলাদাভাবে অনেক আইটেম হয়েছিল ভাষণ নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা ভাষণটি পত্রিকায় যেভাবে পুরোটা ছাপতে পারি, তখন সেটি সম্ভব হয়নি। সেদিনের পত্রিকায় ‘তিনি বলেন, আরও বলেন’ এভাবে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। পুরো ভাষণটি ছিল আঠারো মিনিটের বেশি। রেডিয়ো পুরো ভাষণটি রেকর্ড করেছিল, যেটি এডিট হয়নি। কিন্তু গ্রামোফোন রেকর্ড সম্পাদনা করে। যার টাইমিং ছিল ১৪ মিনিটের কাছাকাছি। বাকি অংশ তারা ফেলে দিয়েছিল। যেমন ওখানে আছে, আমাদের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এই কথাটি মূল ভাষণে দুইবার আছে। বক্তৃতার মাঝখানেও একবার আর শেষের দিকে একবার।
ওই সময় আরেকটি কথার সমালোচনা হতো, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো’ অথবা ‘আমার আওয়ামী লীগের তহবিলে আপনারা দান করে আসবেন’। কেন তিনি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বললেন, অন্য দলগুলোকে আনলেন না- এ রকম প্রশ্ন স্বাধীনতার পর অনেক শুনতে হয়েছে। এটি স্পষ্ট ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু অন্য দলকে নিয়ে জোট করেননি তার পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত এই দলগুলোর সঙ্গে এক ধরনের বিরোধিতা ছিল। মার্চে এসে এই দলগুলোর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার সুযোগই ছিল না, যেহেতু দলগুলো ছয় দফার বিরোধী ছিল। আর যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল। আবার কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতৃত্বে ছিল ডাকসু এবং ছাত্রলীগ। অথচ ১৯৬৯ সালে আমরা দেখি, দেশের সব ছাত্র সংগঠন একটা জায়গায় ছিল। এমনটি মোনেম খানের এনএসএফ পর্যন্ত ভাগ হয়েছিল। একটা অংশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
৭ই মার্চের পর পত্রিকার চেহেরা তো এমনিতেই অনেক পরিবর্তিত হলো। সংবাদপত্র তখন নিজেরাই আন্দোলনকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেল। ন্যাশনাল ট্রাস্টের পত্রিকা ‘দৈনিক পাকিস্তান’র ভূমিকাটা খুব প্রগতিশীল ছিল বলে আমি মনে করি। তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের নিউজ ছাপার পাশাপাশি বাঙালিদের নিউজও ছেপেছে। তুলনায় ‘মর্নিং নিউজ’, ‘দ্য পাকিস্তান অবজারভার’এদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আর ‘পূর্বদেশ’-এ যেহেতু বেশ কিছু প্রগতিশীল সংবাদকর্মী ছিল, তাই তাদের কলামে, সম্পাদকীয়তে অন্তত বাংলাদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা নিয়ে লেখা হতো।
তেপান্ন বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতাকামী মানুষের জাগরণকে এগিয়ে নিতে গণমাধ্যম বিশাল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
তারা//