বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ: কয়েকটি প্রসঙ্গ
মোঃ শাহ্ আজম || রাইজিংবিডি.কম
১৭ মার্চ ১৯২০। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মের প্রথম চিৎকারে যে শিশুটি নিজের আগমন ঘোষণা করেছিল, শৈশব পেরোতে না পেরোতেই সেই শিশুটির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে গণমানুষের কণ্ঠস্বর। একটি নিভৃত পল্লী ও দেশের সীমা পেরিয়ে মানুষটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বিশ্বের সব প্রান্তের আত্ম-অধিকার ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক। এই মানুষটিই আমাদের একান্ত আপনার জন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উৎসব কেবল বাঙালির উৎসব নয়, দিনটি পরম মমতায় ও স্মরণে উদযাপিত হয় বিশ্বের সব প্রান্তে। বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে চিনছে তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে, আত্ম-অধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের বিশ্ব-ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণরা আগ্রহী হয়ে উঠছে মানুষটিকে গভীরভাবে জানতে।
যাঁর হাত ধরে সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; ঔপনিবেশিক নিপীড়ন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে বাংলার মানুষকে যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে মুক্ত করেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁকেই সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশি-বিদেশি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার কেবল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গই হয়েছেন তা নয়, অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। লজ্জায় মাথা নত হয় প্রতিটি বাঙালির। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজনে জাতীয়ভাবে তো নয়ই, সাধারণভাবেও উদযাপন করা যায়নি বাঙালির এই মুক্তিদূতের জন্মদিবস। অত্যন্ত লজ্জা ও বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, ১৯৭৫ সালের পরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস উদযাপন শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৯৭ সালে। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত করাই ছিল ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের মূল উদ্দেশ্য।
১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, ১৯৭৫ সালেই সেই স্বাধীনতাকে অবরুদ্ধ করা হয়। কারা করেছিল তা এখন আর কারোরই অজানা নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে যারা স্বাধীন হতে বাধা দিয়েছিল, যারা পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে নিরীহ বাঙালির উপর অত্যাচার করেছিল, হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা ও তাদের বন্ধু-সহযোগীরাই পঁচাত্তরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী। জাতির পিতার হত্যাকারী কিংবা তাদের সহযোগীরা কোনোভাবেই বাঙালির বন্ধু হতে পারে না, দেশের জন্য কল্যাণকামী হতে পারে না। এই পাঠটি দিয়েই শুরু করতে হবে আমাদের জীবনের সকল শিক্ষা।
আমরা কেন পরম শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলি? সরল উত্তরে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ ও নিরর্থক। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব একসূত্রে গাঁথা। ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গর্বের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ, যা বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে, বিজয় এনে দিয়েছে, নতুন ধারার দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর অধিকারটিও দিয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং এর সর্বাধিনায়ক হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১-এর অগ্নিগর্ভ মার্চ। ‘আমাদের রক্ত টগবগ দুলছে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্যে’। মুক্তির আবেগে বাঙালি চঞ্চল, পরস্পর পরস্পরে আলাপ করছে- সামনে কী হতে চলেছে। এমন সময়, মার্চ মাসের সাত তারিখ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু দাঁড়ালেন, ‘ভায়েরা আমার’ বলে স্বাধীনতার মন্ত্র শোনালেন। এই ভাষণকে আমরা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বলে অভিহিত করি। যার মাধ্যমেই বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল এবং ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে এবং একটি সশস্ত্র প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে বাঙালি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে শুধু অনুপ্রেরণা নিয়ে। তাঁদের যে দেশপ্রেম পুঁজি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তা অনুরণিত হয় ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে। সংগত কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ২০১৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব-সংস্কৃতির প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই ভাষণটি বিশ্বের মানুষের জন্যে অনুসরণীয়, বিশ্বের মানুষের জন্য একটি উপদেশনা, একটি প্রেরণা। নিপীড়িত, নির্যাতিত, সুবিধাবঞ্চিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষের বাঁচার প্রেরণা। এই অনুপ্রেরণা নিয়েই আজকের পৃথিবীর শোষিত মানুষ তাঁর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করছে, সেই সাথে বাঙালিকে চিনছে, বাংলাদেশকে চিনছে। ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির জাগরণের অমোঘ বাণী, যা বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুকে অমরত্ব দান করেছে।
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ঘাতকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপস্থিতিও বাঙালিকে উজ্জীবিত করছে; বাংলাদেশকে বিশ্বময় পরিচিত করছে। বঙ্গবন্ধু আজও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্তহীন প্রেরণার উৎস, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দ্রোহের প্রতীক। তিনি শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির অনুপ্রেরণা নন, বিশ্বের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সহযোদ্ধা। বলা হচ্ছে তাহলে কেন তিনি ‘বিশ্ববন্ধু’ হবেন না? আমার মনে হয় অচিরেই তিনি ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে খ্যাত হবেন। সেই বিশ্ববন্ধু জাতির পিতার জন্ম হয়েছিল এই অগ্নিঝরা মার্চে।
খুব সাধারণভাবে মার্চকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের অনুপ্রেরণা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম একসূত্রে গাঁথা। এ জন্য ব্যাপক পরিসংখ্যানের প্রয়োজন পড়ে না, কিংবা দালিলিক প্রমাণ লাগে না। শুধু একটি মাসের ঘটনাক্রম, উত্তাল মার্চ, বিশ্লেষণ করলেই একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একটি প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বের করা প্রাসঙ্গিক, তা হলো- বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ দেওয়া কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবার যে অধিকার, সেই অধিকারটি তাঁকে কে দিয়েছিল? বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস পর্যালোচনা কিংবা তাঁর জীবন অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, তাঁর জীবন হচ্ছে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং মানবপ্রেমের এক অনন্য চিত্র। মুজিবজীবন মানে মানব প্রেম, মুজিবজীবন মানেই সংগ্রাম, অধিকার আদায়ের জন্যে জীবনবাজি রেখে সামনে চলা। মুজিবজীবন মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি জীবনে বহুবার কারাবরণ করেছেন। কার জন্যে করেছেন? একটি দেশের জন্যে, একটি স্বপ্নকে সার্থক করার জন্যে। এই স্বপ্নটি আর কী ছিল? একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর নেতৃত্বের এক অনন্য লক্ষ্য এই স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তার জন্যে তিনি অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন, কৌশলী হয়েছিলেন। তিনি জীবনে বহু সুযোগ পেয়েছেন, যখন তিনি নিজে দাবি করতে পারতেন যে, আমি শেখ মুজিব, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এ ব্যাপারে তিনি তার সহযোগী অনেক নেতা-কর্মী ও সংগঠকের দ্বারা কখনো কখনো ভীষণ চাপের মধ্যেও ছিলেন। তবুও তিনি তা করেননি। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং তার জীবনকে যদি আমরা পাঠ্য হিসেবে নেই তাহলে আমরা দেখব, যখন ঠিক যে কাজটি করা উচিত, তিনি সেই কাজটি করেছেন।
১৯৭০ সালে তিনি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। যে বিজয়টি ছিল অভূতপূর্ব, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনলাভে সমর্থ হওয়ায় সমগ্র পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের উপর বর্তায় এবং শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার অধিকারী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তারা (পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা) টালবাহানা করে, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দায়িত্বভার কোনোভাবেই শেখ মুজিবের উপর অর্পণ করতে চায়নি, ক্ষমতা পূর্ব বাংলায় দিতে চায়নি। তাদের আত্মসম্মানে লেগেছে। তা তারা কোনোভাবেই মানবে না। শুরু হয় বাঙালিকে বঞ্চিত করার হীন ষড়যন্ত্র।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শাসন করার আইনগত অধিকার অর্জন করেন। এ সময়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালির বিরুদ্ধে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের জঘন্য ষড়যন্ত্র, যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও জাতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হবার নির্দেশদানের ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছাড়া এ দায়িত্বটি পালন করার নেতৃত্বগুণ, প্রজ্ঞা কিংবা রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক অধিকার আর কারো ছিলো না। বড়ই পরিতাপের বিষয় এই ইতিহাসটিও আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, বিভিন্ন সরকারি আচার-অনুষ্ঠান ও প্রকাশনায় বিকৃতভাবে মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়েছে দীর্ঘকাল।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামল বিশ্লেষণ করে বের করা কঠিন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার কোন কাজটি তিনি শুরু করেননি। সকল কাজ শুরু করা হয়েছে তাঁর সময়ে। সকল কিছুর সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন-প্রকল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলছেন- আমি আমার পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি কিংবা বলছেন এটার সূত্রপাত করেছিলেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই শব্দমালা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য যা প্রয়োজন, প্রায় সকল কাজের শুরু বঙ্গবন্ধুর হাতে। একটা রাষ্ট্রের জন্য যা যা করা দরকার তার পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আমরা সমুদ্রের সুবিশাল অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন করেছি। ‘সমুদ্র বিজয়’ নামে আমাদের এই অর্জন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সুদীর্ঘকালের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে একটি মামলা চলমান ছিল। এই বিরোধ মীমাংসার জন্যে আন্তর্জাতিক আদালতে দীর্ঘদিন শুনানি হয়েছে এবং শেষ পরিণতি- বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে সেখানে। এই সমুদ্র বিজয় হয়েছে সম্প্রতি, বিস্ময়ের ব্যাপার বঙ্গোপসাগরের জলসীমা ও সমুদ্র কীভাবে ব্যবহৃত হবে তার জন্য দেশে যে আইন বলবৎ আছে, সেই আইনটিও বঙ্গবন্ধু করে গেছেন। কাজেই একটি দেশকে পরিচালনা করবার জন্যে, সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার জন্যে যে আইন দরকার, যে কানুন দরকার, যে কোড অব কন্ডাক্ট দরকার, যে বিধি করা দরকার, প্রবিধি করা দরকার, সেগুলো তিনি করেছেন এবং কার আচরণ কী হবে তা তিনি সুনিপুণভাবে নির্ধারণ করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে সংস্কার ও পুনর্গঠনের সময় জাতির পিতা সকল কিছুর বাইরে শিশুদের বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যে সংবিধান প্রবর্তন করেছিলেন, সেই সংবিধানে ২৮ এর ৪ অনুচ্ছেদে শিশু এবং পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বিধান করার সুযোগটি রেখেছেন। এর অর্থ হলো তিনি শিশু অধিকারের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, রাষ্ট্রীয় নীতির একটি অংশ হিসেবে প্রয়োগ করেছেন। ১৯৭৪ সালের ২২ জুন তিনি শিশু আইন প্রণয়ন করেছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য বিশাল অর্জন। কারণ, অধিকার আদায়, অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলোর ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, এগুলো সাধারণত প্রথম পর্যায়ে ইউএন চার্টার হয়, ইউএন চার্টারে পরবর্তী কয়েক বছর পরে আমরা স্বাক্ষর করে আসি, নানান অংশীজনের কাছ থেকে কিছুটা চাপ পাই তারপরে আমরা আইন করি। যেমন মানবাধিকার, নারী অধিকার, ভোক্তা অধিকার- এই আইনগুলো আমরা করেছি ইউএন চার্টারের পরে। বিস্ময়ের ব্যাপার, বঙ্গবন্ধু শিশু আইনটি যখন বলবৎ করেন তখনও শিশু অধিকার বিষয়ক ইউএন চার্টার হয়নি। ইউএন শিশু চার্টার দেওয়া হয়েছে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক শিশু আইন কার্যকরের ১৫ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে। অর্থাৎ কি-না আমরা বাঙালি, আমরা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, এবং আমরা সারাজীবন নির্যাতিত হলেও গর্বের সাথে বলতে পারি যে, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা আজকে যা ভাবেন, জাতিসংঘ ১৫ বছর পরে সেই ভাবনাটি শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে করেছিলেন একটি শিশুকে যদি বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া যায় তার মতো করে, যদি তাকে শিল্পে, সাহিত্যে, সংগীতে এবং যদি কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সে তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে আনন্দের সাথে দেশপ্রেম শিখবে, মাটি এবং মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে। সুতরাং শিশুর মধ্যে যে সক্ষমতা তৈরি হবে, সেই সক্ষমতা দিয়ে তিনি যে বাংলাকে চিন্তা করেছিলেন, সেই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। সে জন্যই তিনি শিশু সংগঠনগুলোকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ‘কচি-কাঁচার মেলা’ এবং ‘খেলাঘর’র প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ প্রজন্মের সঙ্গে এই সংগঠনগুলোর কোনো পরিচয় আছে কি না আমি জানি না। তবে আমার সৌভাগ্য এই দুটি সংগঠনকেই আমার শৈশবের সংগঠন হিসেবে বলবার অধিকার জন্মেছে। কারণ, শৈশবে আমি এই দুটি সংগঠনেরই সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন বাকশাল। আমাদের অনেকেরই এ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই। বাকশাল নিয়ে নানান রকম রটনা প্রচারণা আছে। মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনের যে পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার ও একটি সামগ্রিক সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তাঁর ছিল সেটাই বাকশাল। সব দলের মিলিত একটি রাস্তা। যখন সব দল মিলিত হলো তখন শিশুদের জন্যে নিবিড়ভাবে কাজ করতো ‘খেলাঘর’ এবং ‘কচি-কাঁচার মেলা’। এই সংগঠন দুটোকে এক করে তিনি শিশুদের গড়ে তুলবার জন্যে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শিশুদের যে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং শিশুদেরকে যে ভীষণ ভালোবাসতেন তা তাঁর রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে টের পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমান ১৯৭২ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গেলেন ব্রেজনেভ তখন প্রেসিডেন্ট। তাঁর জন্যে তিনি উপহার হিসেবে আমাদের শিশুদের আঁকা অনেকগুলো ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কী পরম মমতায় সেটি নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বলেছেন কী সুন্দর আঁকে আমাদের ছেলেমেয়েরা! তাঁদের কী শিল্পগুণ আরে বাবা, আমাদের শিশুরা এঁকেছে! এ রকম করে তিনি শিশুদের উৎসাহ দিতে পারতেন। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা এরই ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করি তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার চিন্তা ও কাজে, যিনি বলেন, তিনি পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যিনি বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন এবং স্বপ্ন দেখেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। যার অভিষ্ট লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনৈতিক দেশগুলোর সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা।
শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘শিশুদিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন, যাতে করে শিশুদের প্রতি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দেই। তিনি পিতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্যে ২০১৩ সালে নতুন করে শিশু আইন প্রবর্তন করেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশু কিংবা যে সমস্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে, যে সমস্ত শিশুরা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ছে তাদের তিনি প্রণোদনা দিয়ে স্কুলগামী করেছেন। প্রতিবছর শিশুরা বছরের প্রথমদিন পাঠ্যপুস্তক পায় বিনামূল্যে। এ কত বড় অর্জন! শিশুদেরকে প্রনোদনা দেবার জন্যে স্কুলে মিড ডে মিল চালু করা হয়েছে। তারা স্কুলে আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা করছে।
পিতা যা শুরু করেছিলেন কিংবা যা প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁর কন্যা সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন। এ যেন পরম্পরা। এখানেই শেষ নয়, পরম্পরাক্রমে অনাগত ভবিষ্যতেও এই কাজটি হতে থাকবেই বলে অনুমান করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার দায়িত্বটি গ্রহণ করেছেন। তার মানে বঙ্গবন্ধু, তাঁর কন্যা, কন্যার কন্যা সকলেই শিশুর প্রতি গুরুত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার অপর সন্তান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, সজীব ওয়াজেদ জয়ও গ্রামে-গঞ্জে শেখ রাসেল পাঠাগার, শেখ রাসেল আই.টি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুদের বিকাশের জন্য। তিনিও শিশু অধিকারের বিষয়টি মাথায় নিয়েছেন।
সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির কাঠামো সুদৃঢ় করা, দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ দেশের সকল বয়স ও শ্রেণির নাগরিকের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছেন। আশাকরি জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিক ও প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ভুলে যাবেন না।
লেখক : উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদপুর
তারা//