জয়নুলের চিত্রকর্ম নিলামে: আমাদের দায়বদ্ধতা
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম নিলামে সোয়া চারকোটি টাকা বিক্রি হয়েছে। একজন বাঙালি শিল্পীর জন্য এটা গর্বের বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু এই গর্বের মুদ্রার উল্টোপিঠে যা লেখা আছে তা আমাদের সম্মান খর্বের বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে।
বিদেশিরা অনেক টাকা দাম না হাঁকালে মনে হয় আমাদের এই শিল্পের এতোটা মূল্যই হতো না, তাই কি এতো আলোচনা? সবাই হয়ত এই জায়গা থেকে আলোচনা করেন না। কারণ সবার মধ্যে হয়ত একই রকম হীনতা-দীনতা নেই। বিশেষত, যারা বাংলার শিল্পসম্পদ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। তথাপি আনন্দিত হওয়ার সাথে আমাদের এটাও একবার ভেবে দেখা দরকার যে, একটা জাতির ইতিহাস রচনায় শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য ও নৃতত্ত্বের মতো বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেই উপাদানের কোনোটি যদি হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় অথবা অন্যের দখলে চলে যায়, তাহলে বোঝার বাকি থাকে না ভবিষ্যতে সেই জাতির ইতিহাস কাদের দখলে থাকবে।
‘সাঁওতাল দম্পতি’ শিরোনামের পেইন্টিং জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন ১৯৬৩ সালে। সোদেবি’সের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তেলরঙে আঁকা এই পেইন্টিংটি জামশেদ কে. মার্কার এবং ডিয়ানা জে. মার্কারের পারিবারিক সংগ্রহশালায় ছিল। ১৯৬৩ সালে সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে জামশেদ কে. মার্কার এবং ডিয়ানা জে. মার্কার এটি পেয়েছেন। তারা দুজনই জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দ্বিতীয় পেইন্টিংটি বসে থাকা একজন নারীর চিত্রকর্ম। তেলরঙ দিয়ে বোর্ডের ওপর আঁকা এই পেইন্টিং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সালের মাঝে । এটিও মার্কার দম্পতির পারিবারিক সংগ্রহে ছিল।
সম্প্রতি পেইন্টিং দুটি বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে এই পেইন্টিংগুলো কে কিনেছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জনায়নি নিলামকারী প্রতিষ্ঠান। এর আগেও ২০১৮ সালে নিউইয়র্কের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ক্রিসটিজে জয়নুল আবেদিনের আঁকা সাঁওতাল সিরিজের আরেকটি চিত্রকর্ম নিলামে বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়।
বাংলাদেশের কেউ এই চিত্রকর্মগুলো কিনেছেন কিনা সেরকম কোনো তথ্য এখনও আমরা পাইনি। তথাপি পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের ধরে নিতে হচ্ছে চিত্রকর্ম দুটি বাংলাদেশের হস্তগত হয়নি এখনও। চিত্রকর্মগুলো যখন নিলামে ওঠে বাংলাদেশ সরকারের কারোরই কি চোখে পড়েনি? সরকার চাইলেই চিত্রকর্মটি দেশে ফিরিয়ে আনতে পারত। কিন্তু সে উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অথচ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সংস্কৃতি যে কতটা জরুরি তা ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন। একশ বছর পর সাঁওতাল জাতির ইতিহাস লিখতে গেলে তখন এই চিত্রকর্মটিও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠবে তা কবে বুঝব আমরা? এতে যে আমাদের জাদুঘরেরই আধিকার সবচেয়ে বেশি- এ কথা কবে আমরা বুঝব?
২০০৭ সালে ফ্রান্সের গিমে জাদুঘরে ‘মাস্টার পিসেস অব গ্যানজেস ডেল্টা’ শীর্ষক প্রদর্শনীর জন্য বাংলাদেশের পাঁচটি জাদুঘর থেকে ১৪৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়। পুলিশি পাহারায় প্যারিসের গিমে জাদুঘরে পাঠানো হচ্ছিল আমাদের এই প্রত্নসম্পদগুলো। ২৫ ডিসেম্বর পুরাকীর্তির প্রথম চালানে ছিল ১৪৫টি প্রত্নসম্পদ। কিন্তু পাঠানোর সময় ষষ্ঠ ও সপ্তম দশকের দুটি বিষ্ণুমূর্তি খোয়া যায়। এ কারণে দ্বিতীয় চালানটি পাঠানো হয়নি। সেসময় বাংলাদেশের সচেতন সমাজ জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদও করেছে।
এ প্রসঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ভ্রমণ বিষয়ক বই ‘এবং প্যারিস’-এ উল্লেখ করেন, ‘গিমে জাদুঘরটি আমাদের জাতীয় জাদুঘরের মতো কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারী উদ্যোগে স্থাপিত এবং পরিচালিত একটি প্রায়-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; আর ঐ প্রদর্শনীতে আমাদের প্রত্নসামগ্ৰী পাঠানোর চুক্তিটিও দু'দেশের সরকারের মধ্যে হয়নি, হয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও ফ্রান্সের ওই বেসরকারি জাদুঘরের সঙ্গে। তখন আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। [...] প্যারিস-প্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন যখন অত্যন্ত জোরালো ভাষায় আমাদের প্রত্নসামগ্রী গিমেতে না পাঠানোর পরামর্শ দেন, তখন আমার মনে সন্দেহের মেঘটা অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করে।[...] পরে জানলাম, যে চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রয়াস চলছে, সেই ঐতিহাসিক চুক্তিটি জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরীর বিশেষ মধ্যস্থতায় সম্পাদিত হয়েছিল। ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে ঐ চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে। যে সরকার গত পনেরো বছরের নির্বাচিত সরকারের প্রতিটি চুক্তির পেছনেই দুর্গন্ধ খুঁজে বেড়ান, কী এক অজানা কারণে তারাই এই চুক্তিটির মধ্যে ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সুগন্ধির সন্ধান পান।’
প্রত্নসম্পদ নষ্ট, খোয়ানো, চুরি ও পাচারের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশের সব চেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ সংগ্রহশালা রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, সেখানে জায়গার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অমূল্য প্রত্নসম্পদ। রাজশাহী সীমান্ত থেকে পাচারের সময় ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ১০২ কেজি ওজনের কালোপাথরের একটি মূল্যবান বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মূর্তিটির আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকার বেশি। এর দুই দিন আগে নীলফামারী সীমান্ত থেকে আরেকটি মূর্তি উদ্ধার হয়, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৯৬ লাখ টাকা। শুধু ২০২২ সালেই পাচারের সময় ৩১টি কালোপাথরের মূর্তি উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ সব পাচারের সূত্র থেকে একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরে কয়েকশ কোটি টাকার প্রত্নসম্পদ পাচার হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। ভাবা যায়, আমরা অর্থের জন্য কিভাবে স্বজাতির ইতিহাসকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছি! এই ব্যবসার সঙ্গে যে শিক্ষিত এবং সচেতন ব্যক্তিরাই জড়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, তারাই এই সম্পদগুলোর গুরুত্ব বুঝেন।
আমরা কেমন জাতিতে পরিণত হচ্ছি তা একটু তুলনা করা যাক। জন ফ্র্যাঙ্কেন হাইমার নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ট্রেন’-এ দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হাত থেকে নিজেদের শিল্পকে তারা কীভাবে রক্ষা করেছে। চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, আধুনিক শিল্পের মাস্টারপিসগুলি জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন জার্মান কর্নেল একটি ট্রেনে ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলো লোড করেন। তিনি যেকোনো মূল্যে পেইন্টিংগুলো জার্মানিতে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু ফরাসিরা তাদের জীবন দিয়ে জাতীয় ধন চুরি প্রতিরোধ করেছে। এই চলচ্চিত্রে দর্শকরা মৃতদেহ এবং শিল্পের ভাণ্ডার একসাথে পড়ে থাকতে দেখেছে। আফ্রিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা উসমান সেমবেনের ‘ব্ল্যাক গার্ল’ চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছি, নিজের সংস্কৃতির প্রতি অপমান করায় কিভাবে ব্ল্যাক গার্ল তার ফরাসি মনিব থেকে আফ্রিকার মাস্ক ছিনিয়ে নেয়। ব্ল্যাক গার্লের মৃত্যুর পর কিভাবে ফরাসি মনিব শিশুর হাতে ওই মাস্ক দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়। সংস্কৃতি এমনই প্রয়োজনীয় এবং শক্তিশালী একটি উপাদান। যা রক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট জাতিরই লাভ।
বাঙালির প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস এখনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং প্রাকব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে সীমাবদ্ধ। ফলে এখানে হিন্দু বা মুসলমানের ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনো ইতিহাস রচিতই হয়নি। ফলে এখানে বাবরি মসজিদ আর রাম মন্দির নিয়ে দাঙ্গা হয়, সাতচল্লিশ আসে, দেশভাগ হয়, কান্তজির মন্দিরের জমি দখল হয়, বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে যায়, ভারতের মুসলমানরা বাংলাদেশে আসতে চায়। এই হিন্দু-মুসলমান ছাড়া আমাদের আর কি কোনো জাতিগত পরিচয় নেই? আছে, আমরা বাঙালি। কিন্তু কেমন বাঙালি আমরা তার স্বরূপ নির্নয় করতে গিয়ে আমরা কেবল গ্যান্জামই পাকাচ্ছি। এর কারণ, প্রাকবৈদিক যুগের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস, সমাজ আমাদের সামনে স্পষ্ট নয়। চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, বৈশিষ্য, সাংখ্যদের ইতিহাস কই? আর্যরা নালন্দার বিহারগুলো নষ্ট না করলে হয়ত অনেক ইতিহাসই পাওয়া যেত। ভবিষ্যতে যাতে ইতিহাস পাওয়া যায় তার রাস্তা কি আমরা রাখছি? আমাদের শিল্পসাহিত্য দখলদারদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি না?
আপনি যদি সৌন্দর্যের গুরুত্ব না বুঝেন তাহলে তা অন্যের দখলে যাবে, চুরি হবে, হারিয়ে যাবে, নিলামে উঠবে। সেই বিখ্যাত ‘ট্রেন’ ছবির একটি সংলাপ- ‘বিউটি বিলঙস টু দেম হু ক্যান অ্যাপ্রিশিয়েট ইট’।
লেখক: চলিচ্চিত্র নির্মাতা
তারা//