ভাদ্রের বন্যা: পুনর্বাসন উদ্যোগ ও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি
সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম
‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার মতোই যেনো এখন কষকের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ। ভেঙে যাওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করছিলেন ফয়েজ আহমেদ। বয়স ৪৫ বছর। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামে তার বাড়ি। গত ২৩ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় শত শত বাড়িঘর। এসব বাড়িঘরের মধ্যে রয়েছে ফয়েজের বসতঘর। ফয়েজ জানান, তিনি কৃষিকাজ করে সংসার চালান। তার আয়ের কোনো পথ নেই। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সাব্বির আহমেদ একাদশ শ্রেণিতে, আর ছোট ছেলে মো. সানি ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। স্ত্রী সালেহা বেগম গৃহিণী।
সেই ভয়াল রাতের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে ফয়েজ বলেন, ‘হেদিন রাউতকা আমি বুড়বুড়িয়া নদীর আইলো আছিলাম। মসিদের মাইকে কইলো ভাঙ্গা পড়ছে। একটা দৌড় দিলাম। দুই পোলা আর বউ লইয়া এক ভাইয়ের বিল্ডিংয়ে পথম উঠছি। পরে পানির হোত (স্রোত) দেইখ্খা একটা স্কুলে গিয়া উডছি। চাইর দিন পর বাইত আইয়া দেহি আমার বাড়িডা শেষ। ভিডার মইধ্যে শুধু ঘরের চালডা আছে, আর সব ভাইসসা গেছে। এহন বাড়ি কেমনে করমু। চারদিকে পানি। রাইতে হাপের (সাপ) ভয়।’ [সূত্র: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো ]।
আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি সাধারণত বন্যা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে।কিন্তু এবার বন্যা হলো ভাদ্র মাসে।ভাদ্রের এই বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো।উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা ভারী বর্ষণে দেশের ২৩টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়।গত ১৬ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বন্যার কবলে পড়া জেলাগুলো হলো-নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নাটোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, যশোর।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য (৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪) বলছে, এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন।এছাড়া মোট ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর।আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা গেছে ৫৯ জন।
কয়েক দিন আগেও ছিল ফসলের সবুজ খেত। ভালো ফলন হবে, এমন আশায় দিন গুনছিলেন কৃষক। কিন্তু বন্যার পানিতে সব ফসল নষ্ট হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। অনেক জায়গায় মাঠের পর মাঠ ঢেকে গেছে বালুর স্তূপে। নিচু জমি উঁচু হয়ে গেছে। বালুর স্তূপ না সরালে জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তায় কৃষকদের এখন মাথায় হাত। শুধু তাই নয়, বন্যায় ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়েছেন দুর্গত অঞ্চলের অনেক মানুষ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যার পানি কৃষকদের কৃষি জমিগুলোকে তলিয়ে দিয়েছে।এতে কৃষকরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
এখনো অনেক গ্রামের পানি নামেনি।গত ৯ সেপ্টেম্বর রাইজিংবিডি ডটকমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, নোয়াখালীতে বন্যার পানি ধীর গতিতে নামছে। জেলায় এখনও প্রায় ১৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি।৬০০ আশ্রয়কেন্দ্রে ৮০ হাজার মানুষ অবস্থান করছেন।জলাবদ্ধতার কারণে নিম্নাঞ্চল ও শহরতলীর মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। এ দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এছাড়া দুই জেলার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে, শুধু ফেনী জেলায় অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফেনীর ছয় উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার বেশি। এসব এলাকার কৃষিজমিতে তিন-চার ফুট বালি জমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ফসল উৎপাদনে।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও উপজেলাগুলোয় কৃষিতে মোট ৩৯৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।এছাড়া চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্যমতে, বন্যাকবলিত জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে ৬০৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সম্প্রতি আমি বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকায় গিয়েছি। সেখানকার কৃষকরা জানিয়েছেন, বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও মাছচাষীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তার। কৃষকরা বলছেন, আবার নতুন করে কৃষি উৎপাদন করতে হবে। তবে দুশ্চিন্তা বীজ ও সার নিয়ে। তবে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘সারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। কৃষকদের সারের কোনো সংকট হবে না।’ আমরাও চাই বীজ ও সার সরবরাহ যেনো বাধাগ্রস্ত না হয়।
ইতিমধ্যেই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।এখন প্রয়োজন বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন এবং কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো। যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।ক্ষয়ক্ষতি সারিয়ে উঠতে তাদের আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের।গত ২২ আগস্ট ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে ১২ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত হলো- অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক, উপজেলা কৃষি অফিসার এবং কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারদের নিয়ে টিম গঠন করে দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।চলমান কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।বন্যায় ক্ষতি মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত জাতের আমন ধানের বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। নাবী জাতের রোপা আমন ধান চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে। নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।বন্যাকবলিত ঝুঁকিপূর্ণ গুদামে রক্ষিত সার নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।আগাম জাতের শীতকালীন সবজি উৎপাদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে হবে।এটা আশার দিক যে, এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার কাজ করছে।
বন্যার পর কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নতুন করে অমন চাষে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পুনর্বাসন।মনে রাখতে হবে, কৃষকরাই আমাদের প্রাণ।কৃষক বাঁচলে বাঁচবে কৃষি, বাঁচবে দেশ।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
তারা//