বুদ্ধিজীবীর সেকাল-একাল
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঢাকা শহরে হামলা কেন্দ্রীভূত করার বড় কারণ ছিল বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উৎসভূমিতে আঘাত। শত্রুরা জানত, আমাদের কেন্দ্র কোথায় এবং কোথায় আঘাত করলে ফল ভালো পাওয়া যাবে। জাতির মনস্তাত্ত্বিক মেরুদণ্ড বাছাই করেই সেদিন আঘাত করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সঙ্গে পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আঘাত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের যৎসামান্য নিজস্ব সমর শক্তিতে। প্রাণ ক্ষয়, সম্পদ ক্ষয়ের সঙ্গে যদি ঊর্বর মস্তিষ্কগুলোর নাশ করা যায়, তাহলে পোয়াবারো— এ বোধ থেকে ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণের নিউক্লিয়াস হিসেবে টার্গেট করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আক্রমণ করে শিক্ষার্থীদের দেহনাশের মাধ্যমে বাঙালির আগামীকে ধ্বংস করার একটা বহুরৈখিক জালের বুনন ছিল। ২৫ মার্চ বেশকিছু শিক্ষক আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরিসংখ্যানের শিক্ষক অধ্যাপক মনীরুজ্জামান অন্যতম। এরপর স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর ব্যাপক হারে বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুঙ্গুত্বের পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বুদ্ধিজীবী হত্যার একটা নিয়মিত কার্যক্রম ছিল। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও এই কার্যক্রম চলেছে সমতালে। যদিও ঢাকার বাইরের হত্যাকাণ্ডগুলো আজও আলোচনার টেবিলে সর্বাংশে গুরুত্ব পায়নি।
এমনকি, শুধু ২৫ মার্চকে ভিত্তি ধরলেও বোধকরি শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকার শুরুর তারিখটা সঠিক নয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ, আসাদুজ্জামান, ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে অধ্যাপক শামসুজ্জোহার আত্মদানকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় গুণবিচারেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আসাদের মৃত্যুর পর জন-মানুষের বুলন্দ স্লোগানে জোয়ার এসেছিল- ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। এই স্লোগান ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার পথ তৈরি করে।
মাঠের গোলা-বারুদের জনযুদ্ধ দৃশ্যমান, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা হয় গহীন থেকে। সেই লড়াই হয় বুদ্ধিবৃত্তিক, যা পরিচালিত হয় অধিক ঊর্বর মস্তিষ্ক থেকে। জনপদের বুদ্ধিজীবীরা প্রধানত এই লড়াই করে থাকেন। মগজের এই লড়াইয়ের যোগসূত্রের পূর্বাপর বিষয় থাকে অনেক গভীরে।
১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপক গোবিন্দ দেবকে হানাদার বাহিনী ধরে, সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ঘাতকের দিকে আঙুল তুলে তিনি উচ্চস্বরে বলেছিলেন, ‘Good sense’ বা শুভবুদ্ধির কথা। সমাজে শুভবুদ্ধির এমন প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের যে শ্রেণিচরিত্র আমরা অবলোকন করি, সেক্ষেত্রে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ঠিকানা খোঁজার সংগ্রামে মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ছিলেন। কিছু বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। এরা পাকিস্তান সৃষ্টির পরও বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালির স্বসংস্কৃতিতে ঘরে ফেরার প্রবল জোয়ারকালেও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য পাকিস্তানের তাবেদারি করেছে। ইতিহাস যেহেতু অনিবার্যভাবে সত্যাশ্রয়ী, সেই সত্যের জমিনে দেখা যায় বুদ্ধিজীবীদের বিকার পাকিস্তান পর্বেও ছিল। এরা সব সময় জিন্নাহ, ভুট্টো, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন দিয়েছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে স্বাগত জানিয়ে আওয়াজ তুলেছেন- ‘ইয়া হাবিবে আইয়ুব খান, তুম বাচানে পাকিস্তান।’
তবে, প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলের সহনশীল ও সংশ্লেষাত্মক সাংস্কৃতিক ধারা দ্রুত পাল্টে দিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনা দমিয়ে রেখে বাঙালি জাগরণের বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের জনযুদ্ধের বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল প্রণিধানযোগ্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যমসমেত বুদ্ধিজীবীদের আওয়াজ যুদ্ধের দামামায় মুক্তিকামীদের সঙ্গে একাত্ম ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের জনযুদ্ধের স্বপক্ষে একীভূত হওয়ার বেদীমূল পূর্বের ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পথ প্রবাহের ফল।
ব্রিটিশ শাসনের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক হলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা জগতে বিস্ফোরণের অভূতপূর্ব প্রসার। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ থাকলেও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়বাদিতার একটি চর্চা ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিল। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ পর্বের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে সহজেই অনুমেয় যে, প্রত্যেকেই মনন ও চর্চার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন। ব্যক্তি মানুষের আদলে অনেকের প্রতিষ্ঠানের মতো ভিত্তি ছিল চিন্তা, দর্শন, স্বকীয়তা ও কর্মে। তাদের কর্মদ্যুতিতে কেবল সমকালের জাতির চলার দিশাই ছিল না, ভাবীকালের পথনির্দেশ ছিল। ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তীকালে বাঙালির মনোভুবনে দেশত্মবোধের প্রাণপ্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। এ কাজে বুদ্ধিজীবীদের কর্মপ্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ, যা মুক্তিযুদ্ধে সোনালি ফসল ফলিয়েছে। এই শস্যক্ষেত্র নষ্ট করার জন্যই পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীনিধন চালায় সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।
পাকিস্তানপর্বে মনোভুবনে প্রদীপের শিখায় সঞ্জিবনীর প্রবাহ রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরা। তখন বুদ্ধিজীবীদের কর্ম ও দর্শনের জায়গায় একাগ্রতা ও নির্মোহতা ছিল। ব্যক্তি সুবিধা, পরশ্রীকাতরতায় নিজের কর্ম ও কথার গতি তারা পরিবর্তন করতেন না। এজন্য জনসমাজে তাদের প্রতি আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছিল, যা স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ম্রিয়মাণ হয়েছে। দলকানা, লুপেন শ্রেণির বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতাপূর্ব সমাজযন্ত্রে জেঁকে বসতে পারেনি। দলদাস বুদ্ধিজীবীর শ্রেণি চরিত্র তখন দৃশ্যমান ছিল না।
সংস্কৃতি যেহেতু মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যবহারিক শিল্প দ্রব্যসামগ্রী, কারিগরি প্রণালী, ধারাসমূহ, অভ্যাস ও মূল্যবোধ দ্বারা তাড়িত; তাই মুক্তিযুদ্ধ- পরবর্তী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বার্থবাদী চরিত্রে বুদ্ধিজীবীরাও সামিল হয়েছেন, ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়। বুদ্ধিজীবী যেমন রাজনীতি, সমাজচিন্তা, দর্শন ও ধর্মে বিভক্ত হয়ে একপেশে হয়েছেন, পাঁচ-ছয় দশক আগে অবস্থা এতটা নাজুক ছিল না। সমাজপ্রবাহ ক্রিয়ায় সে সামাজিক উন্নয়ন প্রাচীনকাল থেকে বুদ্ধিজীবীদের একটা ইতিবাচক ভূমিক ছিল। প্রাচীনকালে বাংলায় আর্য, অনার্য, বৌদ্ধ, জৈন, বাহ্মণ্য, বৈষ্ণব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিকাশ ধারায় বুদ্ধিজীবী তথা সুশীলদের ঐক্যতার প্রয়াস ছিল। সামাজিক উদারতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা রাষ্ট্রযন্ত্রের সমতালে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হলে সুফি-দরবেশরা ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করলে হিন্দু বিদ্বান, পণ্ডিত ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বখতিয়ার খলজি। এ সময় সকল ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মানুষদের মাঝে একটা অদৃশ্য বোঝাপড়া ছিল, যা সমাজকে মান্য ও মানবিক করার জ্বালানি সরবরাহ করত।
‘দ্বি-জাতিতত্ত্বের’ ভিত্তিতে পাকিস্তান হলেও পূর্ববঙ্গে সেক্যুলার সমাজ বির্নিমাণে বুদ্ধিজীবীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পর্বে জাতীয় জাগরণ ও ঐক্যে বড় রশদ সরবরাহ করেছেন এই বুদ্ধিজীবীরাই। কিন্তু, আজ বুদ্ধিজীবী, সুশীল— এসব সমার্থক অর্থে সমাজে আদৃত নয়। বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন ইস্যুতে শিরদাঁড়া সোজা করে ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ বলেন না। যেটুকু বলেন, কায়দা করে, কূল রক্ষা করে। এজন্য বুদ্ধিজীবীদের সম্মানের জায়গাটা সমাজে ক্রমক্ষয়িষ্ণু।
মোটাদাগে, মুক্তিযুদ্ধপর্বে বুদ্ধিজীবী হত্যা বলতে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, আমরা সেটুকুর ভেতরেই থাকি। মূলত, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ বলতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসমেত বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে যুক্ত ব্যক্তি, যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অবদান রেখেছেন, কেবল তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দখলকারী পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃত। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিসর বৃহৎ আঙ্গিকে বিবেচনার প্রয়াস রয়েছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ (১৯৯৪)’ থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে, তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও একই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, সেই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী পূর্ববঙ্গে ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার নীলনকশা একেঁছিলেন। যদিও সেই মোতাবেক হত্যাযজ্ঞ করতে পারেননি। অর্থাৎ, এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বা প্রজন্মকে মেধাশূন্য করার বিশদ পরিকল্পনা ছিল তাদের। এজন্যই বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে টার্গেট করা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে।
ঢাকার বাইরে বুদ্ধিজীবীনিধনের সার্বিক চিত্র না থাকলেও জেলাওয়ারী তথ্য অনুযায়ী, মোট নিহত বুদ্ধিজীবী ৯৮৯ জন। যদিও এই তথ্যের মান্যতায় দ্বিমত আছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক ক্ষয়-ক্ষতির চাইতে গুণতাত্ত্বিক ক্ষতি বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে কতটা হয়েছিল, তার মাশুল আমরা আজো গুনছি। মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আলতাফ মাহমুদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা প্রমুখের দেহনাশ হলেও দ্যুতি আজো বিরাজমান। সাম্প্রতিক সময়ে যারা বুদ্ধিজীবীর নানামাত্রিক তকমা ধারণ করে আছেন, সমাজ প্রবাহে তারা কতটুকু প্রভাবক? এ প্রশ্নের উত্তর আর যাই আসুক, বুদ্ধিজীবীদের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না। আজ সমাজ প্রগতির কথা বলা হয়, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা কেন সমাজে চেতনার জাগরণে ভেদহীন কর্মপ্রয়াসে যুক্ত হতে পারছেন না, সে প্রশ্ন তাদের কাছে থেকেই যাবে।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পূর্বকালে কেবল মুক্ত মননের চর্চাই ছিল না, সুবিধাবাদী সাংস্কৃতিক দালালরা পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাবিত তহজিব ও তমদ্দিনের প্রচারে আপ্রাণ প্রযত্ন করেছেন। তবে, সাম্প্রদায়িক সংস্কার ও তার মোহ ত্যাগ না করলে যে ভূমিজ সংস্কৃতিসাধক হওয়া যায় না, এমন প্রচার ছিল বাঙালি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই বার্তার সোনালি ফসল ফলেছে।
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ধর্মীয় শিক্ষার আদলে একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মাঠের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ আন্দোলনের চাইতে বুদ্ধিজীবীদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির দাবি ফলপ্রসূ হয়েছিল। কারণ, তখন বুদ্ধিজীবীদের আওয়াজের জোর ও ঐক্যতান ছিল। এজন্যই মুক্তিযুদ্ধপর্বে পাকিস্তানিরা বুঝেছিলেন, এ জাতির কণ্ঠ রোধ করতে চাইলে বুদ্ধিজীবী নিধন সবচেয়ে মোক্ষম দাওয়াই। এজন্য বুদ্ধিজীবীনিধনে তারা বদ্ধপরিকর ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজনীতির মাঠের আন্দোলনেও বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ততা ছিল। বিশেষ করে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের দার্শনিক বেদি প্রস্তুত করা, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মেনিফেস্টো রচনা, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের দাবিনামা থেকে ১৯৬৬-এর ছয় দফার মুশাবিদা করেছিলেন বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠি। আজ প্রশ্ন উঁকি দেয়, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের কতটুকু অংশীজন করা যায়? অথচ সাধারণ মানুষ আশা করে, বুদ্ধিজীবীরা গণমানুষের কথা বলবেন এবং তাদের চিন্তার প্রকাশ ঘটবে বুদ্ধিজীবীদের কর্মে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজজীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে এবং ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতাকেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সৃজন হয়েছিল, তাতে পূর্ববঙ্গের গণমানুষের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিভাত হয়নি। পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মানুষ কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের তালিকাভুক্ত হতে পারেননি সামগ্রিকভাবে। বরং, পাকিস্তান আমলে পশ্চিমাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ক্রীড়নক।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, ধর্মীয় বোধ, চিন্তাধারায় আগ্রাসন, সংমিশ্রণ, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সমন্বয় সাধন হয়। এ কাজের মূল কারিগর বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। ইতিহাসের বাঁকবদলের অনেক ঘটনাপ্রবাহে নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্মারক স্তম্ভ হয়ে থাকে, যেমনটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। আজ বুদ্ধিজীবীরা কর্মেগুণে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। যদি তারা সমাজের বাতিঘরে সমাসীন হতে চান, তবে সেই পথের দিশা তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। কেননা, তারাই তো অন্ধকারে আলোর প্রদীপ। সেই প্রদীপের প্রদীপ্ত শিখার বিচ্ছুরণ দেখতে পথ চেয়ে রই!
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক, খণ্ডকালীন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তারা//