এ এফ হাসান আরিফের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা
নেসার আমিন || রাইজিংবিডি.কম
বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার। তার আগে করার মতো অনেক কিছু আছে আমার।’
একইভাবে আরও অনেক কিছু করার ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিমান ও পর্যটন এবং ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের। কিন্তু পৃথিবীতে কঠিন বাস্তবের মধ্যে একটি হলো মৃত্যু। সৃষ্টিকর্তার ডাকে আমাদের সবাইকেই একটা সময় পরপারে চলে যেতে হয়। যেমনিভাবে ৮৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন এ এফ হাসান আরিফ।
এ এফ হাসান আরিফ ছিলেন উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত, সৎজন, ভদ্র, বিদ্বান ও প্রাজ্ঞ আইনজীবী। কর্মজীবনে অসংখ্য দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বয়স কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁর জীবনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পেশাগত জীবনে হাসান আরিফ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ দুপুর তিনটার দিকে এ এফ হাসান আরিফ নিজ বাড়িতে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সাড়ে তিনটার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে ধারণা করেন চিকিৎসকরা। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
এ এফ হাসান আরিফ ১৯৪১ সালের ১০ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকোর্টে শুরু হয় এ এফ হাসান আরিফের কর্মজীবন। ১৯৬৭ সালে ঐ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে নথিভুক্ত হন তিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে অনুশীলন শুরু করেন এবং ‘এ এফ হাসান আরিফ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামে একটি ল’ফার্ম গড়ে তোলেন।
এ এফ হাসান আরিফ ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রতারণামূলক প্রশংসাপত্র ব্যবহারকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক হাইকোর্টের একজন বিচারকের লাইসেন্স প্রত্যাখ্যান করেন। এতে বিএনপি আইনজীবীদের সমর্থন হারান তিনি। এরপর চার বছর দায়িত্ব পালন করে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সেন্টার এবং সার্ক আরবিট্রেশন কাউন্সিল-এর পাশাপাশি আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনের কোর্ট মেম্বার। হাসান আরিফ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার আইনজীবী ছিলেন।
এ এফ হাসান আরিফ কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং গ্রামীণফোন বাংলাদেশ। এ ছাড়া তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ, নির্মাণ সালিস, বাণিজ্যিক সালিস, অর্থ, ব্যাংকিং এবং সিকিউরিটিজ বিষয়, কর্পোরেট, বাণিজ্যিক ও ট্যাক্সেশন বিষয়, সাংবিধানিক আইন বিষয়, পাবলিক আস্বাদন, আরবিট্রেশন এবং বিকল্প বিরোধ সমাধানের অন্যান্য পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমপ্লেক্সের উপদেষ্টা ছিলেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন এ এফ হাসান আরিফ। পরদিন ৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান এবং ২৭ আগস্ট তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদ থেকে স্থানান্তর করে ভূমি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ এফ হাসান আরিফের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। উপদেষ্টা হাসান আরিফ একজন শীর্ষ আইনজীবী, তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘হাসান আরিফ একজন উজ্জ্বল আইনজীবী হিসেবে এবং ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর ও আমাদের সমাজের প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় তার সক্রিয় ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
এ এফ হাসান আরিফের মৃত্যুতে আরও শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াত আমীর ডা. ডা. শফিকুর রহমান, এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম প্রমুখ।
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ এফ হাসান আরিফের মতো একজন প্রাজ্ঞ ও ভিজ্ঞ আইনজীবী ও দায়িত্ববান মানুষের প্রস্থান নিঃসন্দেহের দেশের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে তার সততা ও নিষ্ঠা এবং আইন পেশায় তার অবদান নিঃসন্দেহে মানুষের মনে দীর্ঘ সময় ধরে জাগরুক থাকবে।
লেখক: সাহিত্যিক ও অনুবাদক
তারা//