ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ১ ১৪৩১

বিএনপির কাছে প্রত্যাশা

মীর রবি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫  
বিএনপির কাছে প্রত্যাশা

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের আড়ালে চলে গিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নিষিদ্ধ করা হয়েছে দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে’। সব মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের মতো আবারও ঘোর সংকটের মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। একইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও দেখা দিয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সংশয়। 

এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বহুমুখী সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে তুলতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দিকে তাকিয়ে আছে দেশের একদল মানুষ। সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিক মাত্রই বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যে কটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ঘুরেফিরে এই দুই দলের কাছেই ন্যস্ত। এর বাইরে জনগণ ভিন্ন চিন্তা করতে আগ্রহী নয়। অন্তত অতীতে ভোটের পরিসংখ্যান এ কথার সাক্ষ্য দেয়।  

শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পরপরই আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির অফিসগুলোর সামনে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের যে গণজমায়েত দেখেছি, তা বিএনপির প্রতি মানুষের প্রত্যাশাকেই ইঙ্গিত করে। সেই সঙ্গে বিএনপির সমাবেশে মানুষের ঢল দেখেও অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ বিএনপির কাছেই ভরসার জায়গা খোঁজার চেষ্টা করছে। দলের অসুস্থ চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরে জনমানুষের উদ্দীপনা বিএনপির জন্য শুভ বার্তা বহন করছে। দেশের বাইরে থাকা তারেক জিয়ার সুচিন্তিত রাজনৈতিক ভাষ্যেও মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার পথ খুঁজে পেতে চায়। তার বক্তব্যে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সুস্থধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান ব্যক্ত হচ্ছে বারবার। অতীতের ভুল ত্রুটি শুধরে তিনি বারবার গণমানুষের দল হিসেবে বিএনপিকে জনগণের মাঝে উপস্থাপন করার কথা বলছেন। কিন্তু তার কথায় বিএনপির জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঠিক কতটুকু সাড়া দিচ্ছেন বা মান্য করছেন তা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। 

গণমাধ্যম সূত্রে গতানুগতিক দখল ও মামলা বাণিজ্যের নোংরা রাজনীতিতে আচ্ছন্ন বিএনপির কিছু দলীয় কর্মীর কর্মকাণ্ড মানুষকে আশাহত করছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত জরুরি। যেসব নেতাকর্মী জনবিরোধী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং দলকে সুসংহত ও মানুষের আস্থার জায়গায় নিতে তৎপর না হয়ে বরং আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে সাংগঠনিক কাঠামো সুসংহত করা এখন বিএনপির প্রধান কাজ হওয়া উচিত। সেই কাজ এগিয়ে নিতে নৈরাজ্যবাদীদের দলের বাইরে রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়াটাও গণদাবি। 

সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বিনির্মাণের পুরো দায়িত্ব এখন বিএনপির উপর ন্যস্ত হতে যাচ্ছে। কেননা আমরা খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করছি, আওয়ামী সরকারের পতনের পরপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে চলে এসেছে। জামায়াত ও তাদের সমমনা ধর্মভিত্তিক দলগুলো দেশের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ বিএনপিকেও মূল ধারার রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখার একটি তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই চেষ্টাকে সুনজরে দেখছে না দেশের সাধারণ মানুষ। 

রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানকে ‘মুজিবাবাদী’ কিংবা ‘আওয়ামী সংবিধান’ বলে ছুঁড়ে ফেলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিএনপির তৎপরতা দেশের গণতন্ত্র ও প্রগতির জন্য নতুন আশা সঞ্চার করেছে । ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর প্রায় ৫০ বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দল উভয় ক্ষেত্রে বিএনপি তার উদ্দিষ্ট সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা অতীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি জামায়াতকে সঙ্গে নিলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যা মুক্তিযুদ্ধপন্থী মানুষদের জন্য স্বস্তিকর। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি ‘জামায়াত’মুক্ত হয়ে সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও উত্তরাধিকারের রাজনীতি করুক। জাতির এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের সময় ও সুযোগ দুইই এখন বিএনপির সামনে রয়েছে। 

রাজনীতি সচেতন ছাত্র-জনতা চাচ্ছে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ করুক। এই যাত্রায় সিপিবি, বাসদ, জাসদ, গণসংহতিসহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসা অন্যান্য দলগুলোকে আরও কাছে টেনে নিতে পারে বিএনপি। যা প্রগতিমুখী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশপন্থার রাজনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

জাতীয় জীবনে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার গন্তব্য ঠিক কোথায়, তা এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এমন অনিশ্চিত সময়ে বিএনপির ভূমিকার উপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। নানা সময়ে খানিকটা বিতর্ক থাকলেও, আশার কথা, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, আওয়ামী অপশাসন, ভোটাধিকার হরণের প্রতিবাদসহ সব আন্দোলনে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করেছে দলটি। এরই ধারাবাহিকতায় দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বিএনপিকে দেশের স্বার্থ ও স্বার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে অধিকতর দায়িত্ব পালন করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দোষারোপের রাজনীতি থেকে জাতি মুক্তি চায়। জাতিকে সেই মুক্তিবার্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিএনপিকে মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্খাকে আমলে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি ঘোষণা করা সময়ের দাবি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় প্রকৃত গণভিত্তিক দলে পরিণত করতে বিএনপিকে ঢেলে সাজানোও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষত বিএনপির ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রদল’কে সত্যিকার অর্থে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীলতার জায়গায় পৌঁছতে তরুণ ও মেধাবী ছাত্র নেতৃত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় ছাত্রলীগের মতো পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। রাজনৈতিক মাঠে বিএনপিকে এখন সুচিন্তার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক লড়াই এগিয়ে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের লড়াইকে সফল করতে সুশিক্ষিত, ত্যাগী ও প্রগতিশীল নেতৃত্বের বিকল্প নেই। বর্তমানে বিএনপির যে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে তার লালন-পালন, সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে বলে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে জনগ। তারা প্রত্যাশা করছে ‘শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য’ বলে বিবেচিত হোক।


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়