বিএনপির আন্দোলনে শরিকদের অবস্থান
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জমে উঠছে বিরোধী দলের মাঠের রাজনীতি। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ করে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে সরকার এবং বিএনপির মধ্যে চলছে টানাপোড়েন। সরকার চাচ্ছে না, বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করুক। সে কারণে তাদেরকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন করতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের সম্মেলন করার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা।
বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ থেকে তারা সরকারের পতনের পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি দেবেন। তাদের সঙ্গে জোটের শরিকদেরও রাখা হবে। মুখে যাই বলুক না কেন, বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবস্থা ছন্নছাড়া। বিএনপির তরফ থেকে বারবার কঠোর আন্দোলনের কথা বললেও তাদের শরিকদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বার্তা এখনও দেয়নি বিএনপি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে অনেক দল বেরিয়ে গেছে। তাদেরকে ফের জোটে টেনে আনা হয়েছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে। সরকার পতনের এই আন্দোলনে জোটের দু-একটি দলের ছোটখাটো কর্মসূচি থাকলেও বেশিরভাগ দল একেবারেই নিষ্ক্রিয়। বিশেষ করে, ২০ দলীয় জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী দল জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় জামায়াতসহ শরিক দলের প্রায় সবাই চলমান আন্দোলনে নিজেরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক মাঠের তথ্য বলছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফা জামাল হায়দারের জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার বাংলাদেশ জাতীয় দল কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে। মাঝে মধ্যে বিএনপি নেতাদের নিয়ে প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক কিছু আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠান করেছে খোন্দকার লুৎফর রহমানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও ফরিদুজ্জামান ফরহাদের ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)।
জোটে নামসর্বস্ব দলগুলোর মধ্যে ন্যাপ (ভাসানী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, পিপলস লীগ, মুসলিম লীগ বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির অস্তিত্ব এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব দলের কারো কারো রাজনৈতিক কার্যালয়ের সন্ধানও পাওয়া যায়নি। বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এসব দলকে কোনো ভূমিকাও রাখতে দেখা যায়নি।
২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নিলু জোট ত্যাগের পর তার দলের প্রধান করা হয় ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) নিবন্ধিত অংশের নেতৃত্বাধীন জেবেল রহমান গনি জোট ত্যাগ করলে দলটির মহানগর পর্যায়ের নেতা শাওন সাদেকীকে ন্যাপ সভাপতি করে জোটে রাখা হয়। আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট জোট ত্যাগ করলে সিলেটের আবদুর রকিবের নেতৃত্বে একটা ইসলামী ঐক্যজোট এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা জোট ত্যাগের পর ক্বারি আবু তাহের নামের একজনকে এনডিপির চেয়ারম্যান করা হয়।
তবে ২০ দলীয় জোটের প্রকৃত অবস্থা যাই হোক, জোটের সব দল সক্রিয় আছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। তিনি বলেছেন, সব দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা এক নয়। তারপরও আমরা সবাই চলমান বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ব ও সক্রিয় আছি। জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপি বিষয়টা বুঝে মূল্যায়ন করবে।
নিষ্ক্রিয় থাকা দলগুলোর আরেকটি ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক মাসে আমরা সাত-আটটি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছি। করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক সংকটসহ নানাবিধ কারণে বেশি কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থা কেবল আমাদের নয়, বিএনপি ছাড়া জোটের প্রায় সবারই একই অবস্থা।
বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির চেয়ারম্যান সুকৃতি কুমার মন্ডল বলেন, অন্য দলগুলোর মতো আমরা প্রচলিত রাজনীতি করি না। আমরা লোক দেখানো কর্মসূচি পালন করি না। আমাদের রাজনীতির ধরন ভিন্ন। দেশের যেসব জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হামলার ঘটনা ঘটেছে, নির্যাতিত হয়েছে, সেখানে আমরা গিয়েছি, ভূমিকা রেখেছি।
জোটের অন্যতম শীর্ষ দল এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ বলেছেন, জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপি যখন যে আন্দোলনের পরিকল্পনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী জোটের অন্য দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে কাজ করেছে। এলডিপি গত এক মাসে ঢাকায় দুটি বড় কর্মসূচি পালন করেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গত ৮ অক্টোবর বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল এবং ২ নভেম্বর একটা বড় সমাবেশ করেছি।
২০ দলীয় জোটের সার্বিক অবস্থা এবং নিজেদের অবস্থান সম্পর্কেং জোটের বড় শরিক জামায়াতের প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র মতিউর রহমান বলেন, আমাদের (জামায়াত) কর্মসূচি আগের মতোই আছে। আমরা দফাভিত্তিক কর্মসূচি পালন করছি। তাছাড়া দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে নতুন আমির নির্বাচিত হয়েছেন।
সরকার পতনের এই আন্দোলন, শরিক দলের ভূমিকা, এসব নিয়ে বিএনপির ভাবনা বিষয়ে জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ২০ দলীয় জোট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়নি, এখনো আছে। আমাদের সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংলাপে জোটের সব শরিক দল একমত হয়েছে। তারা সরকার পতনের আন্দোলনে যার যার মতো আন্দোলন চালিয়ে যাবে- বলেছে। কারা আন্তরিকতার সঙ্গে সেই আন্দোলনে কাজ করছে, কারা করছে না, সেসব আমরা দেখছি। সবাই আবার ঐক্যবদ্ধ হবে কি না, সেটা এখনই বলা যাবে না। আন্দোলনে যার যার গতি-প্রকৃতির ওপর সেটা নির্ভর করবে।
বিএনপির চলমান আন্দোলন, সরকারি দল ও ২০ দলীয় জোটের অন্য দলগুলোর ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের গলাবাজি চলে আসছে, চলবে। বিএনপি আর আওয়ামী লীগকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। আমি সব সময় বলি, বিএনপি হচ্ছে আপদ, আর আওয়ামী লীগ বিপদ। তারা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এসব আন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, হবে না।
তিনি আরও বলেন, আর ২০ দলীয় জোটে যেসব দল আছে, তাদের মধ্যে দুই-তিনটিকে হিসেবে ধরা যায়। বাকিগুলো নামসর্বস্ব। কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। এদের অনেকের ১০০ জন করে নেতাকর্মীও নেই। সে কারণে আমরা নিজেরাই আন্দোলন করছি। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে মানুষের অধিকার গিলে খাচ্ছে। এর থেকে বের হওয়ার জন্য আমরা লড়াই করছি। আমাদের এই লড়াইয়ে ভোট, নির্বাচন গুরুত্ব পাচ্ছে। মানুষ জেনে গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই, এই সরকারের পদত্যগ এবং নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করতে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীর বিক্রম বলেন, আন্দোলনের ফলাফল অঙ্কের মতো নয় যে দুইয়ে দুইয়ে চার হবে। আমরা সরকার পতনের জন্য আন্দোলন করছি। সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি এখন অনেকটা এককভাবে মাঠে অবস্থান করেছে। এই আন্দোলনে আমরা অন্য দল এবং সাধারণ মানুষকে পাশে চাইছি।
বিএনপির চলমান আন্দোলনে জামায়াতের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বলেন, বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে পাশে থাকার জন্য জামায়াতকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্য সংগঠনের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান। জোটভুক্ত সব দলকে চলমান আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলা হয়েছে। আমরা আন্দোলনের সময় সবাইকে পাশে পাবো বলে আশা করছি।
মেয়া/রফিক