ঢাকা     রোববার   ৩০ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৬ ১৪৩১

চিঠি নিয়ে বিভ্রান্তি, নির্বাচনে যাচ্ছেন রওশন-কাদের

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ১৮ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২২:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০২৩
চিঠি নিয়ে বিভ্রান্তি, নির্বাচনে যাচ্ছেন রওশন-কাদের

বেগম রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের/ ফাইল ছবি

বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ যেমন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, তেমনি প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বাধীন দলের অংশও। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঘোরতর বিরোধী জিএম কাদের ও তার অনুসারীরা নির্বাচনের জন্য প্রায় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। বিরোধী নেতাকে প্রাধান্য না দিয়ে একক মনোনয়ন ক্ষমতা ও চাহিদামত আসন নিশ্চিত করা হলে যে কোনো সময় নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন জিএম কাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচন না করলে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিতে হবে কেন? কই বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো যারা নির্বাচন বর্জন করছে, তারা তো ইসিতে কোনও চিঠি দেয়নি। ইসির ডাকে সাড়া দিয়ে চিঠি দেওয়ার অর্থই হলো পার্টি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়া। আসন নিশ্চিত না হওয়ায় তথা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হবে- এমনটাই দাবি করেন দলটির ওই নেতা।

জাপার আরেক নেতা জানান, পার্টি চেয়ারম্যান চান, দলে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তার হাতে থাকতে হবে। রওশন এরশাদ কোনোভাবেই দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। সরকারি দলের পক্ষ থেকে এখন যেভাবে বিরোধী নেতাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। দলে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা থাকবে, নির্বাচনে সব মনোনয়ন উনিই দেবেন- এসব বিষয়ে সরকার কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। নির্বাচনে কত আসন পাবেন, আগেই সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চান পার্টি চেয়ারম্যান। এ কারণে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে দেরি হচ্ছে বলেও জানান এই নেতা।

ইসির ডাকে সাড়া দিয়ে শনিবার (১৮ নভেম্বর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে চিঠি দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। চিঠিটি পৌঁছে দেন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

চিঠিতে বলা হয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে আরপিও’র আর্টিকেল ১২ (৩ এ) (বি) এবং ১৬-এর (২)(৩) অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে দলের প্রার্থী মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দ করবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তার নমুনা স্বাক্ষরও দেওয়া হয় চিঠিতে।

খবর নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পার্টি অধিকাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জিএম কাদের নির্বাচন বর্জন করলে তারা রওশন এরশাদের কাছে চলে যাবেন।

তাছাড়া, এতদিন যারা সংসদ সদস্য হতে পারেননি, দলের জন্য নিবেদিত এমন নেতারাও এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে চান। একইভাবে দলের আরেকটি অংশ চায়, বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে না যেতে। সবমিলিয়ে কঠিন চাপে রয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। চাপ সামলাতেও জিএম কাদেরকে নির্বাচনে যেতে হবে বলে মনে করেন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতারা।

দলটির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, সরকারি দলের পক্ষ থেকে সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস না পাওয়ায় কয়েকদিন ধরে পার্টি চেয়ারম্যান নির্বাচন করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। মাথায় চাপ নিয়ে করণীয় নির্ধারণে দফায় দফায় বৈঠক করছেন সিনিয়র নেতাদের সাথে। শনিবার সন্ধ্যায়ও বনানী অফিসে দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও সংসদ সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, ফখরুল ইমাম এমপি, পীর ফজলুর রহমান এমপিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির আসনসহ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হোক আর না হোক, প্রেসিডিয়ামের বৈঠক করে তিনি নির্বাচনের বিষয়ে ঘোষণা দেবেন বলে জানা গেছে।

এদিকে, শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। কমিশনে চিঠি দেওয়ার সাথে নির্বাচনে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ইলেকশনে যাওয়ার আগে কিছু নিয়ম আছে, সেটার প্রস্তুতি মাত্র। প্রেসিডিয়াম বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলেও জানান দলের মহাসচিব।

অন্যদিকে, বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকার কাজও চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।  

জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বেগম রওশন এরশাদ রোববার বঙ্গভবনে যাচ্ছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন। তাছাড়া, নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে যে কোনো দিন যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করবেন বিরোধী নেতা। তারপরই জানা যাবে রওশন এরশাদ এককভাবে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দেবেন, নাকি জিএম কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করবেন। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রওশনপন্থী নেতা ও জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ইকবাল হোসেন রাজু বলেন, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। তার নির্দেশে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই নির্বাচনী এলাকায় নেমে পড়েছেন। নির্বাচনে দলের প্রার্থী তালিকা তিনিই চূড়ান্ত করবেন বলে জানান রাজু।

এদিকে, নির্বাচনে অংশ নিতে শনিবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। তার দল জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ হয়ে নির্বাচন করবে- এমন কথাও জানান তিনি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বরাবর লেখা চিঠিতে রওশন এরশাদ বলেন, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বিগত ৩টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারও চতুর্থ বারের মতো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দল হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এটা হবে শুধু নির্বাচনী জোট। নির্বাচনকালীন জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবেন। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক লাঙল কিংবা প্রার্থীর ইচ্ছানুসারে মহাজোটে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।

এদিকে, জোটবদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণের অনুরোধে পাঠানো চিঠিটি রওশন এরশাদের স্বাক্ষরিত হলেও ওই চিঠি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তার অনুসারী নেতাদের মাঝেও। বিরোধী নেতার অনুসারী অধিকাংশ নেতা চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানেন না বলে জানা গেছে। বরং রওশন এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে তাকে হাসির পাত্র বানানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ নেতাকর্মীদের। কারণ, এর আগেও একটি উপ-নির্বাচনে বিরোধী নেতার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইসিতে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তার চিঠি আমলে নেয়নি ইসি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জাতীয় পার্টির এখনও বৈধ চেয়ার‌ম্যান জিএম কাদের। কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে সরানো না হলে কিংবা তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত রওশন এরশাদের চিঠি আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি জানান, চিঠিতে বিরোধী নেতা বলেছেন, মহাজোটের হয়ে এককভাবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করবে। এ অবস্থায় ইসি কার পক্ষে রায় দেবে। যদি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরকে গণ্য করেন, তাহলে বিরোধী নেতার চিঠি আমলে নেওয়া হবে না- এটাই তো স্বাভাবিক।

২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোটে এলে জাতীয় পার্টি আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের শরিক হয়ে ভোটে যায়। নির্বাচনের পর মহাজোট আবার ভেঙে দেওয়া হয়। সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। টানা দ্বিতীয়বার বিরোধী দলীয় নেতা হন রওশন।

তাছাড়া, জাতীয় পার্টি মহাজোটে নেই- এমন দাবি সরকারি দলের অনেক নেতার। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও একাধিকবার বলেছেন। যেখানে জাতীয় পার্টি মহাজোটে নেই, সেখানে মহাজোটের হয়ে নির্বাচন করা সংক্রান্ত ইসির কাছে পাঠানো রওশন এরশাদের চিঠিটি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

ঢাকা/এনএইচ

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়