নেতৃত্ব সংকটে বিএনপির আন্দোলন, ফলাফল শূন্য
মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৯ জন। যদিও এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। বর্তমানে তাদের মধ্যে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেশের বাইরে। চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, প্রহসনমূলক নির্বাচন, মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে বিএনপি যুগপৎভাবে বিভিন্ন দল ও জোটকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে গত ১২ জুলাই থেকে। সেই থেকে টানা তিন মাস বিএনপি রাজধানীসহ সারা দেশে রোডমার্চ, পদযাত্রা, গণমিছিল, কালো পতাকা মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, সমাবেশ, যুব সমাবেশ, বিক্ষোভ, মহাসমাবেশসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বর্তমানে অবরোধ, হরতাল কর্মসূচির পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দলটি।
এরপর চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সেদিন মহাসমাবেশ চলাকালে কাকরাইলে পুলিশ, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, পিস্তল ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, নাশকতা, ভাঙচুর, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, গাড়ি পোড়ানো, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগ ওঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
মহাসমাবেশের দিন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক কারাগারে আটক আছেন।
এছাড়াও আগে থেকে কারাগারে আছেন ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। অপরদিকে, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করেছেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের পর সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে এখনও রয়েছেন বিশ্রামে। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থতার কারণে নিয়মিত নন। বাকিদের মধ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রয়েছেন আত্মগোপনে। ড. আবদুল মঈন খান ও বেগম সেলিমা রহমান, নজরুল ইসলাম খান, বর্তমানে বাইরে থাকলেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
উল্লেখিত নেতাদের বাইরে বর্তমানে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার এড়াতে দলের অনেক নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। ২৮ অক্টোবর রাত থেকে নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেয়া তালা আজও খোলেনি। নেতাকর্মীহীন দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেক নেতাকর্মী নয়াপল্টন বা গুলশান কার্যালয়ের আশেপাশেও যান না। তবে, দলের প্রথম সারির নেতারা জেলে থাকলে দ্বিতীয় সারির নেতারা দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেবেন- এমন দলীয় সিদ্ধান্ত থাকলেও বর্তমানে বিএনপিতে চরমভাবে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে।
দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আন্দোলন সমন্বয় করছেন। তার নির্দেশ ও পরামর্শে বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে দলের পক্ষ থেকে ভার্চুয়ালি অবরোধ, হরতাল, অসহযোগসহ সব আন্দোলন ঘোষণা করছেন সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
বর্তমানে দলের মধ্যে নেতৃত্ব সংকট চলছে কি না- জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেনে, ‘নেতৃত্ব সংকটের প্রশ্ন আসছে কেন? নির্বাচনের প্রাক্কালে আমাদের দলের বিভিন্ন কর্মসূচি যেভাবে চলার কথা, সেভাবেই চলছে। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে কারাগারে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, এসব মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার করে বিএনপির আন্দোলনকে থামানো যাবে না। অনেক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন, তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘এখন দলের বেশ অনেকজন নেতা কারাগারে আছেন। তারপরও সরকারবিরোধী আমাদের কর্মসূচি চলছে, চলবে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারির সাত তারিখে নির্বাচন। একতরফা নির্বাচন করার জন্য সরকার মরিয়া। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা, আমাদের লাখো নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি, সরকারের পদত্যাগের জন্য আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। সরকার জনগণের দাবি মেনে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দলের কেন্দ্রীয় প্রথম ও মধ্যম সারির অনেক নেতা বর্তমানে কারাগারে আছেন- এটা সত্যি। তবে আন্দোলনে এর তেমন ব্যাপক প্রভাব পড়ছে না। আন্দোলন তার গতিতে চলছে, চলবে। নেকাকর্মীদের যারা বাইরে আছেন, তারা সমন্বয় করে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ঠিক করছে। দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করছে। সারাদেশের লাখো নেতাকর্মীরা সেসব কর্মসূচি সফলভাবে পালন করছে।’
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও জানান এই বর্ষিয়ান রাজনীতিক।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ যাই বলুন না কেনো, আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থাৎ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকে বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে সরকার লাভবান হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনকে বিরাট ধাক্কা দিতে পেরেছে সরকার। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার সময়ই সরকার এই সুযোগটা নিয়েছে। ২৮ অক্টোবের মহাসমাবেশ বিএনপির জন্য কাল হয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের আগে পর্যন্ত বিএনপির সরকারবিরোধী এক দফার অহিংস আন্দোলন বেশ জমজমাট ছিল। সারা দেশের নেতাকর্মীরা সে আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার ছিল। মহাসমাবশের দিন বিএনপি-পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমূখী সংঘর্ষে আন্দোলনের পুরো ছক পাল্টে যায়। সেদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, নাশকতা, ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোসহ নানা অভিযোগ ওঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তারা সে দায় এড়াতেও পারেন না। এরপর পুলিশের মামলা-গ্রেপ্তারে নেতাকর্মীদের জায়গা হয় কারাগারে।’
বিএনপি মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় বেশিরভাগ নেতা কারাগারে থাকার কারণে আন্দোলন চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। সঙ্গত কারণে আন্দোলনে ভাটা পড়েছে। যার অন্যতম কারণ নেতৃত্বের অভাব বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে সরকার চাপে পড়লেও ২৮ অক্টোবরের পর উল্টো চাপে পড়ে বিএনপি। রাজপথ থেকে, আন্দোলন থেকে ছিটকে যায় দলটি। নেতৃত্বের অভাবে আগামী ৭ জানুয়ারির আগে আর বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না দলটি এবং এই সুযোগে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে যাবে বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ।
তারা//