নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারে জাপার ১৯ প্রস্তাব
রাজধানীর বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের
নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারে ১৯টি প্রস্তাব দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমা আখতার, আলমগীর সিকদার লোটন, লিয়াকত হোসেন খোকা, জহিরুল ইসলাম জহির, শেরীফা কাদের, মনিরুল ইসলাম মিলন, মাসরুর মওলা, মো. জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. আরিফুর রহমান খান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা নুরুল ইসলাম তালুকদার, মো. খলিলুর রহমান খলিল, জাহিদ হাসান, মেজর (অব.) মাহফুজুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ রাজু, সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, আহাদ ইউ চৌধুরী শাহীন, মো. হেলাল উদ্দিন, যুগ্ম মহাসচিব মো. সামছুল হক, সম্পাদকমণ্ডলী মো. হুমায়ুন কবির, ওলিউল্লাহ মাসুদ চৌধুরী, কাজী আবুল খায়ের, এবিএম লিয়াকত হোসেন চাকলাদার, মো. আব্দুল হান্নান, এমএ রাজ্জাক খান, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক মামুনুর রহিম সুমন, প্রিন্সিপাল গোলাম মোস্তফা, মাহমুদ আলম, সমরেশ মণ্ডল মানিক।
জিএম কাদের বলেন, সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী যদি দুজন ভিন্ন ব্যক্তি হতেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংসদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ভারসাম্য থাকতে পারত। ঐতিহ্যগতভাবে, এটি কখনও ঘটেনি। এখন পর্যন্ত, যখনই সুযোগ আসে, দলীয় প্রধানই প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা হল ওয়েস্টমিনিস্টার ধরনের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনায় সংসদ প্রধান ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের সমস্ত সিদ্ধান্ত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনার পরে, সংসদের মাধ্যমে নেওয়া হয়। সরকারের যেকোনো কার্যক্রমের জন্য সংসদের কাছে জবাবদিহিতা করার ব্যবস্থা থাকে।
জিএম কাদের বলেন, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালুর প্রথম থেকেই সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধির খসড়া সেভাবেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, সেক্ষেত্রেও প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের প্রধান নির্বাহীকে সংসদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে এটি করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ-৭০)। এই বিধানটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দলীয় সংসদ সদস্যদের (যারা সংসদ সদস্য বা এমপি নামে পরিচিত), সংসদে ভোটদানের সময় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বা যাকে সংসদের ভাষায় দলীয় হুইপিং বলা হয় তার বাইরে ভোট দানের অধিকার দেয় না। এটি প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় দলের সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিশ্চিত করে। সংসদে সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরকার গঠিত হয়।
এছাড়া সংসদের সব সিদ্ধান্ত সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়। শুধুমাত্র সংবিধানের সংশোধনী যার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়। সুতরাং, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে একতরফাভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং সংসদে তা পাস করানোর ক্ষমতা দেয়।
জাপার ১৯ প্রস্তাব:
১. সেই প্রেক্ষাপটে, সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রথম সুপারিশ হল, সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়া ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত করা ।
এখানে রাজনৈতিক দল বলতে সংবিধানে অনুচ্ছেদ-১৫২ (১) এ রাজনৈতিক দলকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেটাই বোঝানো হয়েছে।
কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ঝুলন্ত সংসদ বলা হয়। সেক্ষেত্রে দুই বা ততধিক দল একত্রে সরকার গঠন করলে, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির আরেকটি সুযোগ তৈরি হয়। তবে, সেটি একটি অনিশ্চিত ও কাকতালীয় ঘটনা। সে ধরনের পরিস্থিতির ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা সঠিক বিবেচনা করা যায় না।
সংবিধানে অনুচ্ছেদ-৭০ অন্তর্ভুক্ত করার পিছনে যুক্তি ছিল সরকারকে স্থিতিশীলতা প্রদান করা। যুক্তি দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি যুক্তরাজ্যের মতো নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাদের অধিকাংশ আর্থিক বা শিক্ষাগত অবস্থান খুব একটা ভালো হবে আশা করা যায় না। ফলে, তারা অর্থ বা ক্ষমতার লোভ লালসা থেকে বিরত থাকতে যে পর্যায়ের নৈতিকতার মান থাকা প্রয়োজন সে মান তারা সব সময় ধরে রাখতে সক্ষম হবেন সে ধারণা করা বাস্তব সম্মত নয়। ফলে, অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভন দিয়ে তাদের সংসদে কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটদানে সম্মত করানো সম্ভব ধরে নেওয়া যায়।
এরকম ঘটতে থাকলে সরকারের কাজকর্ম চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, সরকারকে সব সময় ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে থাকতে হয়। কারণ যেকোনো মুহূর্তে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত সংসদে নামঞ্জুর হতে পারে এমনকি সরকারের পতন হওয়াও সম্ভব। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, উপরোক্ত পরিণতি বাংলাদেশে খুবই সম্ভব।
অনুরূপ পরিস্থিতিতে থাকা অনেক দেশই সম্পূর্ণ অনমনীয়তা এবং সম্পূর্ণ নমনীয়তার মধ্যে একটি সমঝোতা গড়ে এ ব্যবস্থা অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করে থাকে।
২. আমরা প্রস্তাব করতে চাই যে সংসদ সদস্যদের সংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোটদানের সুযোগ থাকবে। তবে, তারা সেটা করতে পারবে যখন দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যাবে এবং কমপক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে সেভাবে পরিবর্তন করার প্রস্তাব করছি।
এর ফলে দরকষাকষি কিছুটা কঠিন হয়ে পরবে এবং সংসদ অধিকতর কার্যকর ও সররকারের স্থায়িত্ব কিছুটা হলেও নিশ্চিত হবে।
দলত্যাগ বিরোধী বিধি-বিধানের উপরের পরামর্শের জন্য, “দশম তফসিল, অনুচ্ছেদ ৩”, ভারতের সংবিধান অনুসরণ করা হয়েছে।
৩. ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দেখায়, যদি একজন ব্যক্তি যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তবে সেই ব্যক্তি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা দেখান এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। এইভাবে, বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধানে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা সর্বোচ্চ দুবার শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জন্যও একই পরামর্শ দিতে চাই, “অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দু’বারের বেশি সে পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না”। এই বিধানটি আমাদের সংশোধিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৪. আরও সংস্কারের প্রস্তাবগুলোতে যাওয়ার আগে, আমরা পরামর্শ দিতে চাই যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানগুলো পুনরায় চালু করা হবে।
এই সংশোধনীতে কিছু বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল যা উপযুক্ত বলে মনে হয়নি, যেমন চলমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তাছাড়া এ সংশোধনী জনবিরোধী শর্ত আরোপ করে জনগণের মৌলিক অধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছে এবং অধিকারসমূহের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করে তুলেছে যা অযৌক্তিক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বিচার বিভাগ থেকে না হওয়াই ভালো। কারণ এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তাছাড়া এর মাধ্যমে রাজনীতি ও নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের একটি মিশ্রণের অনাকাঙ্খিত উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে।
৫. সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি, সর্বসম্মত প্রার্থী বিবেচিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। ১৫তম সংশোধনী বাতিল করার পরে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮। (খ)-তে, সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
৬. পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে ৭(ক) অনুচ্ছেদটি বাদ হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭(ক) যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হয় না। সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদটিও বাতিল হবে। এর ফলে বর্তমানে সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করা হয়েছ। অর্থাৎ এ বিধানের ফলে কোন সংসদ ভবিষ্যৎ-এ কোন সংসদের ক্ষমতা খর্ব করছে বলা যায়, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৮ অনুযায়ী সংগঠন করার মৌলিক অধিকারের ওপর সরকারের জনবিরোধী বিধি-নিষেধ থাকবে না।
বাতিলের যুক্তির সমর্থনে বলা যায়, কোনো চলমান সংসদ, ভবিষ্যতের কোনো সংসদের কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না যা ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয়েছে। অধিকন্তু, এই সংশোধনীটি কেবলমাত্র নিরঙ্ককুশ বা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গৃহীত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানে গ্রহণযোগ্যতার জন্য এরপর একটি গণভোটেরও বিধান ছিল। সেই পদক্ষেপটিকে পাশ কাটিয়ে এটা গৃহীত হয়েছিল। এটি পদ্ধতিগত ভুল। এগুলো উক্ত সংশোধনী বাতিলের জন্য শক্তিশালী যুক্তি হতে পারে।
আমাদের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার নিয়োগ এবং অপসারণ প্রধানমন্ত্রীর দয়ায় হয়। তাকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সংবিধান অনুযায়ী তাকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তা অকার্যকর বলা যায়, কারণ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে দাঁড়ানোর মত শক্তিশালী অবস্থান রাষ্ট্রপতির থাকে না। এখন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং কার্যকর ভারসাম্য অর্জনের জন্য একটি উপায় বের করা ও সে অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব করার প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা নির্বাচিত হতে পারেন এবং মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা অভিশংসনের সম্মুখীন হতে পারেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় হয়, পাশাপাশি সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে অভিশংসন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় যেকোনো সময় হতে পারে। আমরা প্রস্তাব করছি, রাষ্ট্রপতি তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা নির্বাচিত হবেন; এবং সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা অভিশংসনের সম্মুখীন হতে পারবেন। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংসদের বৃহত্তর ভূমিকা থাকবে এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে, কারণ অভিশংসন কঠিন হবে।
৭. রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং সংসদ সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে হওয়া উচিত। এর ফলে রাষ্ট্রপতি মোটামুটি সর্বসম্মত প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাষ্ট্রপতি নিয়োগের জন্য তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুচ্ছেদ ৪৮(ক) সংশোধন করতে হবে।
৮. রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের জন্য সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান প্রবর্তন করে স্থায়ীত্বের ঝুঁকি হ্রাস করার প্রস্তাব করছি। সেই অনুযায়ী সংবিধানের ৫২ নম্বর ধারা সংশোধন করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব বণ্টনে মূল বাধা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) যেখানে প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্যান্য সব কার্য সম্পাদনে রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে, বলা আছে।
৯. আমরা উক্ত অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) সংশোধনের নিম্নরূপ প্রস্তাব করতে চাই, “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৬ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতিত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে, নির্ধারিত পদ্ধতি, যদি থাকে; অথবা নিজের বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবেন, যদি কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি না থাকে।
১০. দুজন ডেপুটি স্পিকারের বিধান থাকা উচিত, একজনকে অবশ্যই বিরোধীদল থেকে মনোনীত/নির্বাচিত হতে হবে। অনুচ্ছেদ-৭৪। (১) অনুযায়ী দুই ডেপুটি স্পিকারকে সরকারি দল এবং বিরোধীদল থেকে একজন করে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করছি।
১১. সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ১৯৭২ সালের মূল বিধান পুনরুদ্ধারকারী ষোড়শ সংশোধনী ইতিমধ্যে আপিল বিভাগ দ্বারা বাতিল করা হয়েছে। এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের জন্য "সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে।
প্রস্তাব করছি, একই ‘‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল” এর মাধ্যমে অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সদস্যদের অপসারণ বিষয়ক কার্যাবলী পরিচালনা করা যেতে পারে।
১২. সংবিধানের অনুচ্ছেদ. ১০৯ এর অধীন অর্পিত কার্যাবলী পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করার জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ "সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ থাকবে। একই সচিবালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের দাপ্তরিক কাজও পরিচালনা করা যেতে পারে। সংবিধানে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১৩. অনুচ্ছেদ-১১৬ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১০৯ এর সাথে সাংঘর্ষিক এবং এটি অপ্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং বাদ দেওয়া যেতে পারে।
১৪. সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৫। (২) (গ) এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে।
আমরা প্রস্তাব করছি, প্রধান বিচারপতির দ্বারা নির্বাচিত সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ বিচারপতিদের একটি প্যানেল অনুসন্ধান কমিটি হিসাবে কাজ করবেন, তারা বিচারক নিয়োগের সুপারিশ প্রধান বিচারপতির নিকট পেশ করবেন। সুপারিশসহ নিয়োগ চূড়ান্ত করার জন্য প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রপতির কাছে তা প্রেরণ করবেন; এভাবে আইনটি তৈরি করা যেতে পারে।
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে, অনুচ্ছেদ-৬৫ (৩), সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে শুধুমাত্র মহিলা প্রার্থীদের দ্বারা পঞ্চাশটি আসন পূরণ করা হবে, বলা হয়েছে।
১৫. “সংসদ সদস্যদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে শুধুমাত্র মহিলা প্রার্থীদের দ্বারা পঞ্চাশটি আসন পূরণ করা হবে”; সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(৩) এ বর্ণিত বিষয়টি অক্ষত রেখে আমরা প্রস্তাব করতে চাই, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই তাদের মোট প্রার্থীর কমপক্ষে দশ শতাংশ মহিলা প্রার্থী সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে। এই মহিলা প্রার্থীরা অন্যান্য দলের পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে প্রার্থী নির্বাচন করার সময়, দলের যে মহিলা প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচনে লড়েছিলেন কিন্তু জিততে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।
যাতে করে মনোনয়নসহ সরাসরি নির্বাচনে আরও বেশি মহিলা প্রার্থীকে অনুমতি দেওয়া হয়, এ বিষয়ে উপরোক্ত ব্যবস্থাটি রাজনৈতিক দলগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে; একই সঙ্গে এটি মহিলা প্রার্থীদের সাধারণ আসনের বিপরীতে সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ এবং উৎসাহ প্রদান করবে। আশা করা যায়, এই ব্যবস্থাটি ধীরে ধীরে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করবে।
১৬. প্রস্তাব করছি, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান কমিশনারদের নিয়োগ দিবেন। তবে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সদস্যদের মনোনয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একটি "অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করবেন। অনুসন্ধান কমিটিতে এক তৃতীয়াংশ সদস্যকে অবশ্যই বিরোধীদল থেকে মনোনীত করতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা নিয়োগ দিবেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) অবশ্যই নির্বাচন চলাকালীন বেসামরিক এবং পুলিশ প্রশাসনের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে দিতে হবে, সেখানে কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার পরিণতিও থাকতে হবে। অর্থাৎ যদি কোনো সরকারি কর্মচারী নির্বাচন কমিশন (ইসি) কমান্ড মেনে না চলে তবে ইসির নিজস্ব কর্তৃত্ব থাকবে সাসপেন্ড, স্থানান্তর, বরখাস্ত, দোষী সাব্যস্ত করার। সরকারি দাপ্তরিক কার্যাবলীতে এটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১৭. সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২৬ এ, নির্বাচনের সময় কোনো কর্মকর্তা ইসির নির্দেশনা না মানলে নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে। এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।
১৮. কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকবে না। রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগসমূহ চূড়ান্ত করবেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন।
(১৮) বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, (অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত) দুজন, (২) সংসদ, দুজন সংসদ সদস্য (একজন সরকারি দল থেকে এবং অন্যজন বিরোধীদল থেকে) (৩) আমলাতন্ত্র (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) থেকে একজন, (৪) সুশীল সমাজ থেকে দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) মোট সদস্য সংখ্যা -৭।
উপরোক্ত কমিটিকে প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার এবং তাদের সুপারিশসহ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
১৯. দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন ইত্যাদির মতো অন্যান্য সমস্ত সাংবিধানিক সংস্থার জন্য এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন।
বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, (অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত) দুজন, (২) সংসদ, দুজন সংসদ সদস্য (একজন সরকারি দল থেকে এবং অন্যজন বিরোধী দল থেকে) (৩) আমলাতন্ত্র (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) থেকে একজন, (৪) সুশীল সমাজ থেকে দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) মোট সদস্য সংখ্যা -৭।
উপরোক্ত কমিটিকে প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার এবং তাদের সুপারিশসহ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও আমাদের কাছে সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোকে আরও কার্যকর করার জন্য সংস্কারের আরও কয়েকটি প্রস্তাব এবং বাজেট অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত প্রস্তাব রয়েছে।কিন্তু তার জন্য ‘সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিমালা' সংশোধন করতে হবে। এ কারণে, আমরা মনে করি না যে এই বিষয়গুলে উত্থাপন করার জন্য এটি সঠিক ফোরাম।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ