৮০ ব্যক্তির শরীরে মামুনের রক্ত
এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম
‘মানুষ মানুষের জন্য’ চরণটি শুধু গানের কথা নয়, মাঝে মাঝে সমাজে এর বাস্তবতাও দেখা যায়। এমনই একজন মানবিক মানুষ হাসান আল মামুন। তিনি ৮০ বার শরীরের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন, মানুষ কেবল মানুষের জন্যই।
হাসান আল মামুন। ৩৮ বছর বয়সী একজন টগবগে যুবক। তিনি নরসিংদী ব্লাড ডোনার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক। তার ভালোবাসা শুধু মানবতাকে ঘিরেই। জেলার সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের টাওয়াদী এলাকায় তার বাড়ি।
মামুন (রক্তের গ্রুপ ও পজেভি) একজন প্রচার বিমুখ মানবসেবায় নিবেদিত প্রাণ। যেখানেই তিনি শুনেন ও দেখেন একজন মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয়স্বজনরা রক্তের জন্য অসহায় অবস্থায় দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন, সেখানেই তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহযোগিতার হাত। স্বপ্ন দেখেন প্রতিদিন যেন কোনো একটি ভালো কাজে অংশ নেওয়া যায়।
আর্তমানবতার সেবায় গঠন করেছেন নরসিংদী ব্লাড ডোনার সোসাইটির নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আর এ সংগঠনের সদস্যদের কাজই অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো। তারই এক দৃষ্টান্ত তিনি।
মামুন জানান, ২০০০ সালের ২১ অক্টোবরে তার বয়স যখন ১৭, তখন তার ফুফাতো বোন শিরিনের সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানোর সময় রক্ত দেন। এটাই তার প্রথম রক্তদান। এরপর থেকে মানুষের প্রয়োজনে তিনি তিন মাস অন্তর, এমনকি কোনো কোনো সময় খুব প্রয়োজন হলে দুই মাসের মাথায়ও স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন। এভাবে মানবিক কারণে এ পর্যন্ত তিনি ৮০ জন ব্যক্তিকে রক্তদান করেন।
মামুন বর্তমানে ‘এথ্রি কালার কেম’ নামে একটি রঙ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে (নরসিংদী) কর্মরত আছেন। পাশাপাশি ‘ফ্যামেলি সুপার সোপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এর আগে তিনি বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি নরসিংদী ইউনিটের যুব প্রধান ছিলেন। তাছাড়া ‘আমরা নরসিংদীবাসী’ নামে একটি সংগঠনের সিনিয়র সদস্যও তিনি।
মামুন বলেন, ‘মানব সেবায় নিজকে উৎসর্গ করে দিতে পারলে আমি নিজকে ধন্য মনে করি। বয়স অনুসারে মানুষের প্রয়োজনে যতবার রক্তদান করা যায়, ততবার রক্ত দেবো।’
মামুন শুধু একাই রক্ত দিয়ে আর্তমানবতায় এগিয়ে আসেননি, অন্যদেরও উৎসাহিত করেছেন। তাছাড়াও কোনো মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয়স্বজনেরা যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, ছুটে যান তাদের কাছে। তার সংগ্রহে আছে বিভিন্ন রক্তের গ্রুপের প্রায় শতাধিক স্বেচ্ছায় রক্তদাতার ফোন নম্বর। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রক্তদানের ব্যবস্থা করেন।
স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মানবিক কাজের জন্যে ২০১৪ সালে বিশ্ব রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট দিবস উপলক্ষে মামুনকে জেলার সেরা রক্তদাতা হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। এছাড়াও ২০২০ সালে রোটারি ক্লাব অব নরসিংদী মিট টাউনের পক্ষ থেকেও জেলার একজন শ্রেষ্ঠ রক্তাদাতার সম্মাননা ক্রেস্ট পান।
মামুন আরও বলেন, ‘আমি যখন শুনতে পাই, আমার দেওয়া রক্তে একজন মুমূর্ষু রোগী বেঁচে ফিরেছেন, তখন মনে অনেক আনন্দন জাগে। এ আনন্দন থেকে মূলত আমি একে একে ৮০ জনকে রক্তদানের পাশাপাশি আরও শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীকে উৎসাহিত করি।’
নরসিংদী ব্লাড ডোনার সোসাইটির সভাপতি ও দৈনিক মুক্তচিন্তা পত্রিকার সম্পাদক জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘হাসান আল মামুন স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে যে ভূমিকা রেখে আসছেন, সত্যিই তিনি একজন প্রশংসার পাওয়ার দাবিদার। তার অনুপ্রেরণায় আমরা ২০০৮ সালে নরসিংদীতে ব্লাড ডোনার সোসাইটি নামে একটি সংগঠনট করতে সক্ষম হয়েছি।’
নরসিংদী ব্লাড ডোনার ফাউন্ডেশনের সভাপতি জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান করা ব্যক্তিকে একজন মানবিক মনের অধিকারী হতে হয়। আর এ মানবিক মনমানসিকতাই তাকে রক্তদানে অনুপ্রেরণা যোগায়। মামুন মানবসেবীদের মধ্যে একজন। আমি তার মধ্যে এ মানবতার দিক খুঁজে পেয়েছি।’
নরসিংদী রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সেক্রেটারি হাজী আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বেচ্ছায় একজন রক্তদাতা আনন্দ অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদাও পান। রক্ত গ্রহীতা আর তার পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন তার জীবন বাঁচানোর জন্য। রক্তদাতার জন্য এটা যে কী আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। হাসান আল মামুন রেডক্রিসেন্ট নরসিংদী ইউনিটের একজন যুব প্রধান ছিলেন। যে কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে সবার আগে তাকে দেখতাম। তখন থেকে একজন মানবসেবী ছিলেন। আজ স্বেচ্ছায় ৮০ বার রক্তদান করে তিনি যে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।’
নরসিংদী/মাহি