ঢাকা     বুধবার   ২০ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৫ ১৪৩১

গাছে গাছে লটকন, দাম বেশি, খুশি কৃষক

এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ২৯ জুন ২০২১   আপডেট: ১৫:৫৬, ২৯ জুন ২০২১
গাছে গাছে লটকন, দাম বেশি, খুশি কৃষক

নরসিংদীতে লটকন চাষ করে হাজারো কৃষকের ভাগ্যবদল হয়েছে। ফলে একসময়ে জংলি ফল হিসেবে পরিচিত এ লটকন এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন বাগানের সংখ্যা। তবে এবার ফলন অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম। তাই বাজারে দাম পাচ্ছেন একটু বেশি।

এছাড়া, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে লকটন বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছেন লটকনের পাইকাররা।

লটকনের পুষ্টিমান প্রচুর। এতে অনেক পরিমাণ ভিটামিন ‘বি-টু’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। ফলে মানবদেহে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজন হয়, মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।

ফুল হয় না পাপড়িও ঝড়ে না। সরাসরি গাছের কাণ্ড থেকে বের হয় এ লটকন, যার স্থানীয় নাম বুগি। টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এখানকার কৃষকরা শুরু করেছে এর আবাদ।

লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে মানে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফালগুনে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে পাকতে থাকে। বেলে ও দো-আঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। লটকন ফলনে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হয়। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়।

নরসিংদী জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার শিবপুর, বেলাবো ও রায়পুরা উপজেলার লাল রঙের মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান, তাই এখানে লটকনের ভালো ফলন হয়। আবার চাষিরাও লটকন আবাদে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এ কারণে লটকের আবাদ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে লটকন বাগান করা হয়েছে। যা প্রতি হেক্টরে ১৫ টন হারে ২৪ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। আর উৎপাদিত এ লটকন ৭০ টাকা কেজি পাইকারি দরে যার বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

স্থানীয় লকটন চাষিরা জানায়, একসময় ঝোপ-জঙ্গল ও বাড়ির আঙ্গিনায় লটকন গাছ রোপণ করতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে অপ্রচলিত ফল লটকনের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লালমাটির এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়তে থাকে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই লটকনের চাষে ঝুঁকছেন কৃষক।

বিশেষ করে বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় গত ৩০ বছরে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের প্রসার ঘটেছে। দুই উপজেলার প্রায় পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখন লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি, বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

লটকন চাষি ও কৃষি অফিস জানায়, শিবপুর ও বেলাবো উপজেলার লাল রংয়ের উঁচু মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়া লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী।

এছাড়া রায়পুরা ও মনোহরদী উপজেলার কিছু কিছু এলাকার মাটিও লটকন চাষের উপযোগী। গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রধান কাণ্ডগুলোতে হয় এই লটকন।

লটকন চাষে জটিলতা নেই, খরচ কম। রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০ দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়।

পাশাপাশি লটকনের বাজারজাত নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান কিনে নেন। বাগান কেনার পদ্ধতিও চমৎকার। প্রথমে বাগানের মালিকের কাছ থেকে একদল পাইকাররা দামদর করে বাগান ক্রয় করেন, পরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে পাইকারি মণ প্রতি দাম উঠে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ১০০টাকা থেকে শুরু করে ১২০টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

নরসিংদীর লটকন খেতে সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় এর কদর রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে এখানকার সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু এ বছর মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে লটকন হয়তো দেশের বাইরে রপ্তানি করার সম্ভব হবে কি তা নিয়ে সংশয়ে আছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

এদিকে মৌসুমি এ ফলের বেচাকেনাকে ঘিরে এ জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল ও শিবপুর উপজেলা সদরে বসছে লটকনের বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা এসে এসব বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন লটকন। পর্যায়ক্রমে হাত বদল হয়ে লটকন যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বাজারে। অনেকে সরাসরি বাগান থেকে লটকন কিনে সরবরাহ করছেন।

শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের অষ্টআনি গ্রামের বেনজির আহমদ গিলাব গ্রামের ১৫ লাখ টাকায় দুই একর জমি বন্ধক নিয়ে লটকন চাষ করেছেন। তিনি বলেন, তার বাগানে ১৫০টি গাছে লটকনের ফলন হয়েছে। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় লটকনে ফলন কিছু কম হয়েছে। তারপরও তিনি ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

একই উপজেলার কামরাব গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, কম খরচে লাভজনক ফসলের মধ্যে একমাত্র হলো লটকন। লটকন বাগান শুরু করতে প্রথমে খরচ বেশি পড়লেও পরবর্তী সময়ে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় না। সে তুলনায় লাভ বেশি হয়। এছাড়া লটকন ফলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাছের কাণ্ডে ফলে। কখনো কখনো এত বেশি ফল আসে যে গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা যায় না। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামের লটকন চাষি মানিক মোল্লা জানান, লটকন ফল বিক্রি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না তাদের। স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফলন ধরার পর জমিতেই পাইকারি বিক্রি করে দেওয়া যায়। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যায়। তিনি ৩ একর জমিতে দুটি লটকন বাগান করেছেন। এ বছর একটি লটকন বাগান ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং আরেকটি বাগান ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাছাড়া শিবপুর ও মরজাল বাজারেও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ক্রেতারা আসছেন লটকন নিতে।

একই উপজেলার লাখপুর গ্রামের লটকন চাষি নুরুল হাসান ভূইয়া জানান, তার ৩০ কানি জমিতে লটকন বাগান রয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজারের উপর লটকন গাছ রয়েছে। এ বছর লটকনের ফল কিছুটা কম হয়েছে। তাই তিনি পাইকারদের কাছে ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে রায়পুরার মরজাল বাজার থেকে লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা। এসময় কথা হয় লটকনের পাইকার জসিম উদ্দিনের সাথে। তিনি জানান, আমরা এ বাজার থেকে পাইকারি দরে লটকন কিনে প্যাক করছি। পরে ট্রাকযোগে রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজারে নিয়ে যাবো। পর্যায়ক্রমে হাত বদল হয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহসহ এসব লটকন রপ্তানি হবে বিদেশের বাজারেও।

নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া লটকনে রোগ বালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম, ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকনচাষিও লাভবান হচ্ছেন।

নরসিংদী/মাহি 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়