ঢাকা     বুধবার   ২০ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৫ ১৪৩১

নরসিংদীতে পানের ফলন ভালো, দামও বেশি 

এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ১৫ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৪:৩৮, ১৫ জুলাই ২০২১
নরসিংদীতে পানের ফলন ভালো, দামও বেশি 

নরসিংদীতে পান চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন অনেক কৃষক। তাই দিন দিন বাড়ছে পানের বরজের সংখ্যাও। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবারে পানের ফলন ভালো হয়েছে। এছাড়া, চাষিরা বাজারেও পানের দাম পাচ্ছেন ভালো।

জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে একমাত্র সবচে বেশি পান চাষ হয় মনোহরদী উপজেলায়। এ উপজেলার লেবুতলা, খিদিরপুর, কৃষ্ণপুরে তিনটি ইউনিয়নের সবকয়টি গ্রামেই প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের পানের বরজ আছে।

চালাকচর, অর্জুনচর, দৌলতপুর, বরচাপা ইউনিয়নে কমবেশি পানের চাষ হয়। ওই সব এলাকার মধ্যে আবার পান চাষের জন্যে খিদিরপুর ইউনিয়নের রামপুর গ্রাম অন্যতম। এ গ্রামে কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎসই হচ্ছে পান। এখানে প্রায় গ্রামজুড়েই রয়েছে পানের বরজ। যাদের জমি নেই, তারাও অন্যের জমি বন্ধক নিয়ে পান চাষ করছেন। আর এ থেকেই তারা মেটাচ্ছেন পরিবারের যাবতীয় ব্যয় ভার।

মনোহরদীর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত পান স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়েও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন। দেশের সব স্থানেই এখানের পানের চাহিদা রয়েছে। অনেকে আবার পান ঔষধি গাছ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাই কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় দিন দিন কৃষকরা ঝুঁকছেন পান চাষে।

পান ছোট-বড় সব বয়সের মানুষের কাছেই প্রিয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াতিদের খাবারের পর একটু পান-সুপারি না দিলে, মনে হয় যে, কি যেন একটা তাদের অপূর্ণতা রয়ে গেছে।  নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবছর নরসিংদী জেলার শিবপুর, মনোহরদী ও পলাশ- এ তিনটি উপজেলায় ৩০৩ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু মনোহরদী উপজেলায়ই ৩০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে, যা থেকে পান উৎপানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ৩০ মে. টন।

পান চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পান সাধারন্ত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দো-আঁশ মাটিতে চাষ করতে হয়। ভালো ভাবে আগাছা পরিষ্কার করে চাষ দিয়ে প্রতি এক শতক জমিতে ২ কেজি ফসফেট, ১ কেজি চুন ও ২০০ গ্রাম লিজেন্ট মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হয়। পরে দেড় ফুট দূরত্বে সারি বেঁধে মাটি উঁচু করে ১ ফুট দূরত্বে পানের গাছ লাগিয়ে দিতে হয়। প্রতিটি পানের লতা থেকে ১২ থেকে ১৫টি চারা লাগানো যায়।

এরপর বাঁশের শলা, পাটকাঠি, জিআই তার, কাশবন, সুপারি পাতা ও সুতা দিয়ে পানের বরজ বানাতে হয়। জমির চারদিকে বেড়া দিতে উপরে জিআই তার ও কাশবন দিয়ে বানানো হয় চালা। এতে প্রতি বিঘা জমির পানের বরজে খরচ হয় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা।

মাটি থেকে পানের লতা যখন ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা হয়, তখন পাশে একটি ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা বাঁশ বা পাটকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর পানের লতাটি ধীরে ধীরে বড় হয় এবং কাঠি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ৫ থেকে ৬ মাস পর থেকে পান বিক্রির উপযোগী হয় এবং এরপর প্রতি ৮ থেকে ১০ দিন পরপর পান বিক্রির জন্যে বাজারে নেওয়া যায়। একটি পানের বরজ থেকে সর্বনিম্ন ১৫ বছর একাধারে পান পাওয়া যায়।

পান চাষি শীতল পাল জানান, পানের বরজে এক প্রকার ফাপপচা রোগ দেখা দেয়। এ থেকে বাঁচাতে পারলে একটি বরজ ২০ থেকে ২৫ বছর থাকে। সাধারন্ত আষাঢ়-শ্রাবন মাসে এ রোগটি বেশি দেখা যায়। এটি পানে সবচেয়ে বড় রোগ। তবে এ রোগ দমেন ফোরি, এডমা ও কাফডার-এ নামে তিনটি ঔষধ ব্যবহার করা হয়।

এছাড়াও কিন্তু শীতের সময় এক প্রকার বিষাক্ত কুয়াশা পান গাছে লাগলে পান পাতা ঝরে যায়। এতে চাষিদের মারাত্মক তিগ্রস্ত হয়। এটা প্রতিরোধে কোনো ওষুধ না থাকায় মাঝেমধ্যে বিপাকে পড়তে হয় চাষিদের। অনেক চাষি কুয়াাশা ঠেকানোর জন্য বরজের চারপাশ পলিথিন দিয়ে ঢেকেও দেয়।

রামপুর গ্রামের পান চাষি জহর বণিক জানান, আমার দুই বিঘার উপর একটা পানের বরজ আছে, তার বয়স প্রায় ১০ বছর হবে। পান চাষ করেই আমার সংসার চলে। এই পর্যন্ত পানের ভালো ফলন পেয়েছি, দামও ভালো পেয়েছি। পান চাষ করে আমি স্বাবলম্বী।

একই এলাকার পান চাষি চান মিয়া বলেন, বর্তমানে প্রতি বিড়া পান আকার ভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করতে পারছি। বাজারে পানের চাহিদা থাকায় পুরাতন পানের যে দাম পেয়ে ছিলাম, এখন নতুন পানেরও দাম তেমনি পাচ্ছি। হাটে পান বিক্রি করে ভালো আয় করতে পারছি। এ দিয়ে আমরা সংসার চলছে।

পান চাষি আসাদুজ্জামান বলেন, এই উপজেলায় দুই প্রকার পান চাষ হয়, গয়ালসুর ও লালডিঙ্গি তবে কিছু মিষ্টি পান এবং ছাঁচি পানও পাওয়া যায়। এখানের মোট চাষের ৮০ ভাগই গয়ালসুর পান, যা এ পান সব ক্রেতাদের পছন্দ।

একই এলাকার আরেক কৃষক সুরুজ মিয়া। তিনি বলেন, পান চাষ করেই আমাদের সংসার চলে। আমি এবং আমার পরিবার দুজনেই বরজে কাজ করি। ১২ বছর ধরে পানের বরজ করে আসছি। বর্তমানে ২০ শতক জমিতে পানের বরজ রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে বুধবার হাটে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার পান বিক্রি করি। এখান থেকেই আয় করে সংসারের খরচসহ সন্তানদের লেখাপড়া করানো হয়। বর্তমানে গ্রাম ও শহরে অতিথি আপ্যায়নে এ পানের চাহিদা রয়েছে।

বিভিন্ন স্থান থেকে রামপুর গ্রামে পান কিনতে আসা ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানকার উৎপাদিত পান অনেক পুরু ও সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। তাই ক্রেতাদেরও পছন্দ, আমারও সহজে বিক্রি করতে পারছি।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, জেলার মধ্যে তিনটি উপজেলায় এবছর ৩০৩ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু মনোহরদী উপজেলায়ই ৩০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। এতে হেক্টর প্রতি উৎপানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ মেট্রিক টন। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন এখানে পান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উৎপাদিত পান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও সরবরাহ করা হচ্ছে।

নরসিংদী/মাহি 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়