ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

মাসে যে গ্রামে বিক্রি হয় ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৬:৪৭, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মাসে যে গ্রামে বিক্রি হয় ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার

ছালাভরা গ্রামে ফার্নিচার তৈরির কাজ করছেন একজন কারিগর

নিজেদের প্রচেষ্টায় দুই শতাধিক ছোট-বড় কারখানা গড়ে তুলেছেন গ্রামবাসী। এসব কারখানায় কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র। এ কারণেই যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ছালাভরা গ্রাম মানুষদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘ফার্নিচার গ্রাম’ হিসেবে। এই গ্রামের ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কাঠের আসবাবপত্র কেনাবেচা বাবদ মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা লেনদেন হয় ছালাভরা গ্রামে।

প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি কর্মমুখর থাকে পুরো ফার্নিচার গ্রামটি। গ্রামের পাশ দিয়ে গেলেই শোনা যায় কাঠের খট খট শব্দ। কেউ কাঠ কাটছেন, কেউ জোড়া দিচ্ছেন, কেউবা কাঠের গায়ে ফুটিয়ে তুলছেন দৃষ্টিনন্দন নকশা। কোথাও আবার চলছে বার্নিশের কাজ। ঘরের গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী পর্যন্ত এসব কাজে পারদর্শী। এই পেশায় স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকের ভাগ্যবদল হয়েছে।

ছালাভরা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ধীর্ঘদিন ধরে ফার্নিচার গ্রামের অধিংকাশ মানুষ এই কাজে জড়িত। এই গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় দুই শতাধিক কারখানা। এই কারখানাগুলোতে জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার মানুষের। এই গ্রামের ফার্নিচারগুলো যাচ্ছে দেশের ১৫টি জেলায়। এখানে তৈরি হয় আলমারি, শোকেস, ড্রেসিং টেবিল, খাট, পড়ার টেবিল, সোফাসেটসহ নানা রকমের আসবাবপত্র। সাশ্রয়ী মূল্যে এসব আসবাবপত্র কিনতে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নেত্রকোনা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা আসেন। প্রতিমাসে প্রায় ৫ কোটি টাকার আসবাবপত্র বিক্রি হয় ফার্নিচার গ্রামে।

হাতের সাহায্যে ফার্নিচারে নিখুত কারুকাজ ফুটিয়ে তুলছেন এক কারিগর

ফার্নিচারের কারিগর জহুরুল মিয়া বলেন, ‌‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে আমরাও এই কাজ করি। আগে টাঙ্গাইলে কাজ করতাম। এখন বাড়ির কাছেই কারখানা হয়েছে। এখানে তিন বছর ধরে কাজ করছি। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এখানে এসে ফার্নিচার তৈরীর অর্ডার দেন। এখান থেকে সাশ্রয়ী দামে ফার্নিচার কিনে নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন।’

অপর কারিগর আলী হোসেন বলেন, ‘কম দামে ভালো মানের ফার্নিচার তৈরি হয় এখানে। এগুলোর চাহিদাও বেশি। খাট-সোফা, চেয়ার-টেবিল ও আলনা থেকে শুরু করে সব ধরনের ফার্নিচার তৈরী করেন এই গ্রামের কারিগররা। চাহিদা মতো অর্ডার দিয়ে এগুলো বানিয়ে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা  ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি পরিবার মাসে কম করে হলেও ৩ লাখ টাকার ফার্নিচার বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে মাসে ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার কেনাবেচা হয় আমাদের এই গ্রামে।’

রং মিস্ত্রি আশিক বলেন, ‘আমি সরকারি মনসুর আলী কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ালেখা করি। এর পাশাপাশি রং মিস্ত্রির কাজ করি। ওস্তাদের সঙ্গে কাজ করে দিনে ৪০০ টাকা মজুরি পাই। এই টাকায় সংসারে বাড়তি জোড়ার হচ্ছে।’

মেশিনের সাহায্যে করা হয় ফার্নিচারে নানা ধরনের কারুকাজ

ফার্নিচারের মালিক হারুন শেখ বলেন, ‘সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা মূল্যের ফার্নিচার তৈরি হয় কারখানায়। আসবাবপত্র তৈরিতে কাঠের জোগান আসে টাঙ্গাইল, নওগাঁ ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। এই গ্রামের কারখানাগুলোর তেমন কোনো নাম নেই। এই কারখানাগুলোয় প্রায় ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কারিগররা কিছু নকশা হাতে তৈরি করেন, কিছু নকশা কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হয়। যন্ত্রে তৈরি নকশায় একজন গ্রাফিক ডিজাইনার প্রয়োজন। এ ধরনের নকশার চাহিদাও একটু বেশি। নকশা তৈরির পরের কাজ করেন রং মিস্ত্রি। তিনি ঘষে পলিশের পর রং করে বিক্রির উপযোগী করেন ফার্নিচার। আশপাশের গ্রামেও কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সরকার ঋণের ব্যবস্থা করলে অনেকে ব্যবসা বড় করতে পারবে।’

কবির হোসেন নামের এক ফার্নিচার ব্যবসায়ী বলেন, ‘আসবাবপত্র অনেকেই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু কাঠের ওপর কারুকাজ করা সহজ কাজ নয়। যারা আসবাবপত্রে কারুকাজ করেন তাদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাদের বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে দোকানে রাখা ও কাজ করাতে হয়।’

কাঠের তৈরি একটি খাট

ছালাভরা গ্রামের প্রথম ফার্নিচার ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকা থেকে এসে আমি গ্রামে একটি কারখানা শুরু করি। সেই থেকে এই গ্রামের ফার্নিচার তৈরি কারখানার কাজ শুরু হয়। এখন আমার কারখানায় ৫০-৬০ জন শ্রমিক রয়েছেন। এখন সবাই আমাদের এই গ্রামকে ‘ফার্নিচার গ্রাম’ বলেই চেনেন।’

শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার দেখানো পথে অনেক কারখানা তৈরী হয়েছে। তাই সহজ শর্তে ও কম সুদে সরকারিভাবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে আরও বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তা এ শিল্পে যুক্ত হবেন। পাশাপাশি বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।’

নকশার কাজ করছেন কারিগররা

কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, ‘স্বপ্ল সুদসহ যে ধরনের সহযোগিতা চান ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা আমরা তাদের সব সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছি।’

কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার বলেন, ‘কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানার প্রসারে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মসংস্থান ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে ওই গ্রামের ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারবেন। প্রয়োজনে তাঁদের উন্নত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়