কলা চাষে সবুজের আয় ৩৭ লাখ টাকা
জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম
দর্জির পেশা ছেড়ে কলা চাষ করছেন সবুজ
এক সময় দর্জির কাজ করতেন দেলোয়ার হোসেন সবুজ (৪০)। সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে শুরু করেন তিনি। ইউটিউব দেখে কলা চাষে আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে। এরপর ১০ একর জমি লিজ নিয়ে দেশি জাতের কলাচাষ শুরু করেন তিনি। সাফল্য পেয়ে যান অল্প সময়ের মধ্যেই। কলা বিক্রি করে প্রথম বছর অথাৎ ২০২২ সালে তিনি আয় করেছেন ৩৭ লাখ টাকা। তিনি আশা করছেন, চলতি বছর ২০২৪ সালে তিনি ৪০ লাখ টাকার বেশি কলা বিক্রি করতে পারবেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নলডগি গ্রামের বাসিন্দা সবুজ শুধু কলা চাষই করছেন না। তিনি এই মৌসুমে ৩ একর জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের পেপে চাষ করেছেন। সাথী ফসল হিসেবে লাগিয়েছেন মিষ্টি কুমড়া। মিষ্টি কুমড়ার ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে তার। ইতোমধ্যে সবুজ তার জমিতে চাষ করা মিষ্টি কুমড়া বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। কুমড়া বিক্রি থেকে ১ লাখ টাকা আয় হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। অপরদিকে, আগামী দুই মাসের মধ্যে গাছে পেপের ফলন আসবে। ভলো ফলন হলে বারো মাসি পেপে থেকে তিনি প্রতিমাসে লাখ টাকার বেশি আয় করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, সবুজের কলা ও পেপে চাষ লক্ষ্মীপুর জেলার বেকার যুবকদের কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। অনেকেই তার কাছ থেকে কৃষি কাজের পরামর্শ নিয়েছেন।
সবুজের কলা বাগান
সবুজ জানান, তারা চার ভাই ও এক বোন। বাবা ছিলেন কৃষক। ছোট ভাই এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রামের এক আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যায়। সেখানে বহুতল ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে সে। বাবা দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর মারা যান। রেখে যান ব্যাংক ঋণসহ নানা দায়। ব্যাংক থেকে ঋণ করে ছোট দুই ভাইকে বিদেশ পাঠালেও তারা বাবার দেনা পরিশোধ করেনি। এছাড়া, দর্জির দোকান থেকে যে পরিমাণ আয় হতো তা দিয়ে দেনা পরিশোধ ও সংসারের খরচ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয় পড়ে সবুজের জন্য। তাই নতুন কোনো কাজের সন্ধান শুরু করেন তিনি। ইউটিউব দেখে কলাচাষের আইডিয়া পান তিনি। পরবর্তীতে সবুজ কলাচাষ করার উপায় খুঁজতে থাকেন।
পাশের গ্রাম নুরখাঁ এলাকার জনৈক জমির মালিক থেকে সবুজ ২০২১ সালে জমি লিজ নিয়ে এবং নড়াইল জেলার কলাচাষিদের থেকে চারা এনে শুরু করেন কলাচাষ।
সবুজ জানায়, কলাচাষ করতে গিয়ে তিনি চরম অর্থ সংকটের সম্মুখীন হন। হতাশও হয়ে পড়েন। ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলেও তারা দিতে রাজি হয়নি। বরং, বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি এনজিওর নিকট কাছে যান। অনেকেই তাকে ফিরিয়ে দিলেও একটি এনজিও কর্মকর্তা নিজ জিম্মায় তাকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করেন। কলা গাছের পরিচর্চা বিষয়ে আগে কোনো প্রশিক্ষণ না থাকায় তার পক্ষে সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাণিজ্যিকভাবে এলাকায় কলা চাষ না থাকায় স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও তাকে প্রযুক্তি বিষয়ক সহযোগিতা করতে পারেননি। ইউটিউব থেকে ও নিজ জ্ঞান দিয়ে বাগানের পরিচর্যা চালিয়ে যান সবুজ। এক সময় সবুজের কলা বাগান স্থানীয় বাসিন্দাদের অবাক করে। প্রতিটি গাছে আসে কলার ফলন।
নিজের মিষ্টি কুমড়া খেতে সবুজ
তার সফলতার খবর পৌঁছে যায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে জেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে। কলার বাগান দেখতে আসেন জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. জাকির হোসেন। তিনি সবুজের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। পরামর্শ ও সার দিয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করেন সবুজকে।
সবুজ বলেন, প্রথম বছর কলা বিক্রি করে আয় হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ চলতি মৌসুমে কলা বিক্রি থেকে ৪০ লাখ টাকার বেশি আয় হবে বলে আমি। আশাবাদী।
সবুজ বলেন, ইতোমধ্যে কলা বিক্রির আয় দিয়ে জমির মালিকের লিজ মানি, বাবার রেখে যাওয়া ব্যাংক ঋণ শোধ করেছি। বর্তমানে সামান্য কিছু দায় দেনা থাকলেও তা এই বছর উৎপাদিত কলা ও অন্য ফসল বিক্রি করে পরিশোধ করতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, কলা ও পেপে বারো মাসি ফসল। একবার চাষ করলে বারো মাসই ফলন পাওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করা যায়। বিষ বা কেমিক্যাল মুক্তভাবেই কলা চাষ করেছি। বর্তমানে বাগানে নিয়মিত ৫/৬জন শ্রমিক কাজ করছেন। প্রথম দিকে সবাই অদক্ষ ছিলেন কিন্তু, এখন তারা কাজ করতে করতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। এখন আমরা নতুন চাষিদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি। স্থানীয় অনেক যুবকই এখন কলা চাষে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী রজিয়া সুলতানা এবং এক মাত্র মেয়েকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. জাকির হোসেন বলেন, আমরা সবুজের কলাচাষের তথ্য পেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছি। তাকে সারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। সবুজের হাত ধরে বাণিজ্যিকভাবে নতুন ফসলের চাষ শুরু হয়েছে। সবুজের কলা বাগান লক্ষ্মীপুরের বেকার যুবকদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। সবুজের মতো যুবকরা স্থানীয়ভাবে কলাচাষে এগিয়ে এলে স্থানীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলায় নরসিংদী ও নড়াইল জেলা থেকে কলা নিয়ে আসেন ব্যবসায়িরা। এতে কলার দাম বেশি পড়ে। এছাড়াও, বিষমুক্ত কলা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থাকে।
মাসুদ