ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

দুর্গাপূজার উদ্ভব ও বিকাশ || তপন চক্রবর্তী

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ১২ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্গাপূজার উদ্ভব ও বিকাশ || তপন চক্রবর্তী

তিনি আসছেন। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘে চেপে তিনি আসছেন। মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুল দুলে দুলে তাঁকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। বরণ ডালা নিয়ে শিউলি তাঁর অপেক্ষোয়। শিশির ভেজা দুর্বা তাঁর রাতুল চরণের পরশে ধন্য হওয়ার  জন্য আকুল। জলে-স্থলে- ব্যোমে সর্বত্র ‘আসছে আসছে’ রব। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, আসাম ও ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাজ সাজ রব। ভারতের অন্য রাজ্যের হিন্দুরা দুসেরা, নবরাত্রিতে রামের আহ্বান ও রাবণের বিনাশের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। দশভূজা এখন কেবল নৌকায়, অশ্বশকটে বা দোলায় আসেন না। তিনি বিমান বিহারিণীও। বিমানে করে যাচ্ছেন আমেরিকা, লন্ডন, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইটালিসহ আরো অনেক দেশে। তবে, এদেশে কেবল শরতেই দুর্গা প্রায় সর্বত্র পূজিত হচ্ছেন। কিন্তু দুর্গাপূজা নাকি বসন্তেই চালু হয়েছিল।

মায়ের আগমনের দিকে চেয়ে আছে কুমোর, ডুলি, কামার, সোলার কারিগর, বিপণি বিতান, পাড়ার মাস্তান, ক্ষুধে থেকে দুঁদে নেতা পর্যন্ত। এটাই বড়সড় কামাইয়ের সময়। বাজার সরগরম। তবু খদ্দেরের কমতি নেই। যার যেমন সামর্থ্য ছেলে-পুলে, বউ-ঝি, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কিছু কেনা তো চাই। পশ্চিমবঙ্গে মহালয়া থেকে কালীপূজা পর্যন্ত  সব ধরনের ফল-সবজি, মাছ-মাংস, রিকশা, টোটো (ইজি বাইক), খেয়াঘাট থেকে প্রায় সকল যানবাহনে গা- জোরি মূল্যবৃদ্ধি। মাস্তানদের পকেট গরমের মৌসুম। চাঁদার রশিদে নিজেরা টাকার অঙ্ক বসিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়। না দিলে নানান হেনস্থা। যানবাহন থামিয়ে চাঁদার হুঙ্কার। না দিলে বাহন চলবে না। বাংলাদেশে সামান্য জোরজবরদস্তি চললেও তুলনামূলকভাবে অত্যাচার অনেক কম। ভোট ভিখারিদের জন্য ২০১৯ সালটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারত, বাংলাদেশের নির্বাচনী বছর। ভোট বড় বালাই। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ২৮ কোটি টাকা পূজার অনুদান ঘোষণা করেছেন। কংগ্রেস সভাপিত রাহুল গান্ধিসহ তাবড় নেতা-নেত্রী, সেলিব্রেটিদের পূজো উদ্বোধনের ঘোষণা আসছে। বাংলাদেশ সরকারও হিন্দু সম্প্রদয়ের দুর্গাপূজায় অনুদান দিয়ে আসছেন। এই বছর খাতির আরও বেড়ে যেতে পারে। রাজনীতিকেরাও পুজোর সঙ্গে সম্পৃক্তির জন্য মুখিয়ে আছেন।

সবারই অপেক্ষা তিনি আসছেন। ঢোলে কাঠি পড়লেই সর্বভূতের চেতনা বলে কথিত মহামায়া (যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে) এসে যাবেন। সঙ্গে থাকবেন সিদ্ধিদাতা গণপতি, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, জ্ঞানদায়িনী বীণাবাদিনী সরস্বতী, ধনুর্দ্ধর রূপবান কার্তিক, নন্দী-ভৃঙ্গী প্রমুখ। তিনি আসছেন কলুষ বিনাশ ও আসুরিক বৃত্তি দমনের জন্য। আসছেন ধরণীকে ধন, ধান্যে, পুষ্পে, সম্পদে ও শান্তিতে ভরপুর করা  এবং মানুষের মধ্যে চৈতন্য সৃষ্টির জন্য। তাঁর আগমনে ভক্তদের ক্রন্দসী হিয়া কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা জানাবে:

      রূপং দেহী, জয়ং দেহী, যশো দেহি দ্বিষোজহি

      নমস্তেস্যৈ নমস্তেস্যৈ নমস্তেস্যৈ নমঃ নমঃ

(তুমি যে রূপে রূপময়ী সেই রূপ, তুমি যে জয়ে সর্ব বিজয়িনী সেই জয়, যে যশে তুমি যশস্বিনী সে যশ এবং হিংসা দ্বেষ জয় করার সামর্থ্য আমায় দান করো। আমি তোমাকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।)

দুর্গাপূজাকে কেউ বলেন অকালবোধন, কেউ বলেন শারদীয়া পূজা, শারদোৎসব, আর কেউ বলেন মহাপূজা, মায়ের পূজা, ভগবতী পূজা অথবা শুধু পূজা। সঙ্গতকারণে, মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কবে থেকে দশভূজার আসা-যাওয়া! কার নিরুপম কল্পনায় তাঁর এবং তাঁর পর্ষদদের অবয়ব নির্মাণ এবং কেনোই বা এই পূজার প্রবর্তন!

সাধারণ মানুষ জানে, রাম রাবণ বধের জন্য দেবীকে অকালে জাগিয়েছিলেন। সেই অকালটা হলো শরৎকাল। অকাল কেনো? তাঁর পূজো বসন্তকালে প্রবর্তিত হয়েছিল। হেমন্ত, শীত, বসন্তের আগে শরতে জাগাতে হলো বলে ‘অকালবোধন’। বেশ। শরতে অকালবোধন-এর কাহিনি ফাঁদলেন কে? বাল্মিকী রামায়ণে লিখেছেন যে, রাম রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে সূর্যদেবকে স্মরণ করেছিলেন। বাল্মিকী রচিত সংস্কৃত রামায়ণে এতো বড় একটা কাণ্ডের তো কোনো উল্লেখ নেই! কলকাতা সংস্কৃত কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ৭ খণ্ডে রচিত, বহুল চর্চিত ‘তপোভূমি নর্মদা’, ‘আলোক-তীর্থ’সহ বহু গ্রন্থের প্রণেতা পণ্ডিত শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী মহোদয় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, ‘রাম দুর্গাপূজা করেননি’। তিনি সঙ্গে যোগ করেছেন:

‘মূল বাল্মিকী রামায়ণে তা নেই। এটি হলো বাঙালির উদ্ভাবন। কবি কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে অপূর্ব কাব্যসম্পদে পুষ্ট করে এই দুর্গাপূজাকে বিখ্যাত করে গেছেন। এ সম্বন্ধে আমি বিস্তৃত আলোচনা করেছি ক্রমে ক্রমে, তার পূর্বে আমি ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি, যদি রাম দুর্গাপূজা করতেন, তাহলে রাম লঙ্কাযুদ্ধকালে  (আখ্যায়িকানুযায়ী) দেবী যখন রাবণকে কোলে করে রথের উপর আবির্ভূত হলেন, তখন নিরাশ হয়ে বিভীষণের পরামর্শে দেবীকে তুষ্ট করার জন্য লঙ্কাতেই এই পূজার অনুষ্ঠান করেছিলেন কি? পরে লঙ্কাতে তাঁরই অনুগত ভক্ত বিভীষণ রাজা হয়েছিলেন। তাহলে তো বর্তমান সিংহলে এ পূজার প্রচলন থাকতো? তা নেই কেন? অযোধ্যার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র। তাঁর দেহান্তের পর, তাঁর বংশধরেরা যাঁরা সিংহাসনে বসেছিলেন, তাঁরা কেন তাদের পূর্বপুরুষ, ঐরকম কুলগৌরব রামচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেউ দূর্গাপূজা করলেন না? অযোধ্যাতেই বা দুর্গাপূজার প্রচলন নেই কেন?’ (আলোক-তীর্থ, পৃষ্ঠা ৯৯)

ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে দিয়ে পূজা করানো প্রসঙ্গে শাস্ত্রী লিখেছেন : 
‘এই সব কাহিনি পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ড, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, কালিকা পুরাণ, দেবী ভাগবৎ ইত্যাদি অর্বাচীন গ্রন্থ- যা তান্ত্রিক সাধুসন্ন্যাসী ভক্তরা দুর্গার মহিমা বাড়ানোর জন্য রচনা করেছিলেন। তার উপর ভিত্তি করে কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে উল্লেখ করে গেছেন। রামচন্দ্র ভারতবাসীর প্রাণপুরুষ, আদর্শ পুরুষ। রামকে দিয়ে দেবী পূজা করার কাহিনি রটাতে পারলে বিনা বিচারে সবাই দেবী পূজা করবে, এ জন্যই তাঁরা এসব করেছিলেন।’ (আলোক-তীর্থ, পৃষ্ঠা ১০০)

এরপর বিশদ আলোচনায় শাস্ত্রী মহাশয় উল্লেখিত গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়েছিল কার্তিক-অগ্রহায়ণে। তাঁর কাছ থেকে একজন জানতে চেয়েছিলেন তাহলে দুর্গাপূজা শুরু কবে থেকে? জবাবে তিনি লিখেছেন:

‘‘... খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজশাহীতে তাহেরপুরের ভূঁইয়া রাজা ছিলেন কংসনারায়ণ খাঁ (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য- ড. দীনেশ সেন)। তিনি যজ্ঞ করতে মনস্থ করায় তাঁর পুরোহিত এবং শ্রেষ্ঠ সভাপতি (নাটোরস্থ বাসুদেবপুর গ্রামের) পণ্ডিত রমেশচন্দ্র শাস্ত্রী তাঁকে জানান, ‘চার রকম যজ্ঞ আছে (ক) রাজসূয় (খ) রাজপেয় (গ) বিশ্বজিৎ এবং (ঘ) অশ্বমেধ। প্রথম তিন প্রকার যজ্ঞ, স্বাধীন সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী দিগ্বিজয়ী বীরের অনুষ্ঠেয়; আর অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ কলিতে অচল। তবে আপনার ইচ্ছা পূরণের জন্য ঐসব যজ্ঞেরই অনুরূপ এক মহা আড়ম্বরময় মহাপূজার ব্যবস্থা আমি করে দেব।’’ (আলোক-তীর্থ- পৃষ্ঠা১০৩)

নারায়ণ শাস্ত্রী মহোদয় আরও জানান, রমেশচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় রচিত পূজা পদ্ধতি ও মন্ত্র অনুসরণ করে রাজা কংসনারায়ণ খাঁ তখনকার দিনে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে পূজা করেছিলেন যা পরে দুর্গাপূজা নামে প্রচলিত হয় (রাজা কংসনারায়ণ খাঁর বংশধর, কাশী ধর্মমহামণ্ডলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক রাজা শশি শেখরশ্বর রায়ও প্রাচীন দলিল ও কাগজপত্র দৃষ্টে এই কথা সমর্থন করে গেছেন)। শৈলেন্দ্রনাথ শাস্ত্রী শারদোৎসবের ব্যাপক প্রচার প্রসার প্রসঙ্গে লিখেছেন:

‘সারা বাংলায় এই মহাপূজার সংবাদ কুসুমিত পল্লবিত আকারে ছড়িয়ে পড়ল।অন্যান্য রাজারাও আপন ঐশ্বর্য, আড়ম্বর এবং পৌরুষ দেখাবার জন্য এই ব্যয়বহুল পূজার অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। মহাকবি কৃত্তিবাস ছিলেন এই ভূঁইয়া রাজা কংসনারায়ণেরই সভাকবি। তিনি তাঁর রচিত রামায়ণে তাঁর অদ্ভুত কল্পনা এবং কবিত্বের বর্ণাঢ্য আলোক সম্পাতে রামচন্দ্রকে দিয়ে অকাল বোধনাদির কাহিনি ভক্তিস্নিগ্ধ ভাষায় প্রকাশ করলেন। আর তোমরাও Spiritual point of viwe থেকে এর কোনো ফল আছে কিনা, সত্য সত্যই তাতে কোনো পরমার্থ হতে পারে কিনা- না ভেবে, না দেখে বাংলা রামায়ণের কথা কাহিনি অনুসরণ করে চলেছ।’ (আলোক-তীর্থ-পৃষ্ঠা ১০৩)

বাসন্তী দুর্গাপূজার সঙ্গে বাংলাদেশ জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার করেলডাঙা পাহাড়ে ৬৯ একর জায়গাজুড়ে বিশাল শ্যমলী নিসর্গের মধ্যে মেধস মুনির আশ্রম পরিবেষ্টিত রয়েছে। মেধস মুনির  আশ্রম কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ রায়চৌধুরী জানান যে,  শ্রীমৎ বেদান্ত স্বামী বোয়ালখালির করেলডাঙা পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত মেধস মুনির আশ্রমে বহু বছর সাধনায় রত ছিলেন। ১৯০০ সালে স্বামিজী দৈববাণীতে অবগত হন যে, রাজা সুরথই প্রথম বাসন্তী দুর্গাপূজা করেছিলেন। তখন থেকে মেধসমুনির আশ্রমে বাসন্তী দুর্গাপূজা প্রবর্তিত হয়। প্রতিবছর এই আশ্রমে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত পূজায় অঞ্জলিদান করেন। অন্য সময়ও দেশী-বিদেশী বহু পর্যটক এই আশ্রম পরিদর্শনে আসেন।

মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, শাক্ত পুরাণ ও ভাগবতী পুরাণ সূত্রে জানা যায়- বঙ্গদেশের বর্ধমান জেলায় প্রাচীনকালে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি খুব প্রজাপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল বলিপুর (বর্তমান বোলপুর)। তিনি নিজে গণতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি কোল ও ভিল সম্প্রদায়ের লোকজন কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে রাজ্য হারান। তিনি পালিয়ে বর্ধমানের পূর্বদিকে দুর্গাপুরের গড় অরণ্যে আশ্রয় নেন। অরণ্যজীবনে তাঁর সঙ্গে বৈশ্য সমদ্ধির সাক্ষাৎ ঘটে। বৈশ্য ব্যবসায়ী। তিনিও নিকট আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে মনের দুঃখে অরণ্যে আসেন। উভয়ে অকস্মাৎ এক মহাঋষির সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন। এই ঋষির নাম মেধসমুনি। তাঁর আশ্রম গড় অরণ্যের অজয় নদীর (আগের নাম কৃষ্ণা নদী) তীরে। মুনির কাছে তাঁদের পতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন-মহামায়া। অর্থাৎ সবই মহামায়ার খেলা। মেধসমুনি রাজা সুরথ ও বৈশ্যের দুঃখমোচনের জন্য দুর্গাপূজা করার পরামর্শ দেন এবং শ্রীশ্রী চণ্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। সুরথ রাজা নিজ রাজ্যে ফিরে বসন্তকালে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। যা ‘বাসন্তী দুর্গাপূজা’ নামে পরিচিত। কথিত আছে, এরপর তিনি হারানো রাজ্য, ধনসম্পদ ফিরে পান।

Goddess of Tantra, Mother Goddess: Durga, Ancient India Life and Society গ্রন্থসমূহের রচয়িতা, গবেষক প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, প্যাট্রিসিয়া মোনাঘানের মতে, ইসলামী যোদ্ধাদের সংখ্যাধিক্য ঘটলে এবং ভারত উপমহাদেশ জয় করতে শুরু করলে এবং তারা পুরুষ ও স্ত্রী প্রতিমাগুলোকে দেবদেবী হিসেবে অস্বীকার করতে থাকলে হিন্দু সংস্কৃতিতে প্রচণ্ড যোদ্ধা দুর্গা এবং তাঁরই আরেক রূপ অধিক কালো ও আরও ভয়ঙ্কর যোদ্ধা কালী বঙ্গদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্যাট্রিসিয়া মোনাঘান কবি, ধর্ম প্রচারক ও ধর্ম বিষয়ক গবেষক। তিনি  বিশটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। Singing to Goddess সহ বহু গ্রন্থের লেখক, গবেষক রাচেল ম্যকডরমট এবং ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত ব্রিজেন গুপ্তের মতে, মুসলিম শাসনের মধ্যযুগের শেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধর্মীয় নিপীড়ন শুরু হলে হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে দুর্গোৎসব সামাজিক উৎসব হিসেবে পালিত হতে থাকে এবং জনসমক্ষে যোদ্ধা দেবীদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। দুর্গাপূজা বা চণ্ডীপূজার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যাই হোক না কেনো বর্তমানে এই পূজা সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এককথায় সার্বজনীন পূজায় পর্যবসিত হয়েছে। কেবল হিন্দু নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও শাস্ত্রীয় তন্ত্রমন্ত্র বাদে এর নান্দনিক দিক ও উৎসব আগ্রহভরে উপভোগ করছেন।

সব ধর্মের সারকথা অসুরবৎ ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎস্যর্য) সংযত কর, আত্মশক্তির উদ্বোধন কর এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হও। বাংলাদেশের হাতিয়ার গীতা ভারতী মিশনের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট কবি ও লেখক মহর্ষী প্রেমানন্দ ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী ও সত্যপ্রতিষ্ঠা’র ভূমিকায় লিখেছেন:  

‘জীবনের রুদ্রত্ব, অহংত্ব বা চণ্ডত্ব নাশ করে বলেই পরাশক্তির অপর নাম চণ্ডী। অতি দুঃখের উত্তরলোকে তাঁকে জানা যায় বলে তাঁর নাম দুর্গা বা ব্রহ্মজ্ঞান। সেই জ্ঞান লাভ করতে হলে দুঃখ পেতে হয়। জীবনের রুদ্রত্ব বা চণ্ডত্ব প্রকাশ নেয় আত্মিক অজ্ঞানতায় স্বরূপের বিস্মৃতির ফলে। আত্মিক ধর্মকে প্রচ্ছন্ন রেখে প্রকাশ নেয় প্রবৃত্তির ধর্ম। অন্তরের মানুষটিকে আড়াল দিয়ে জীবনে জেগে থাকে একটা পশু ধারা। সুর থাকে স্তিমিত, অসুর খেলে যায় তার পূর্ণ প্রভাব নিয়ে। জৈবী অসুরকে নিঃসঙ্গ করে জীবনে দৈবী সুরকে চিরপ্রোজ্জ্বল করে রাখবার প্রচেষ্টাই আত্মিক সাধনা। সেটিই চণ্ডীপূজা।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়