ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পাঁচ পয়সার ডাক্তার!

সিদ্দিক আলম দয়াল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩২, ২৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাঁচ পয়সার ডাক্তার!

৯১ বছর বয়স। এই বয়সেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। বয়সের কাছে হার মানেননি এই গুণি চিকিৎসক। ৫৬ বছর ধরে নিরলসভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। বিনিময়ে রোগীদের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ পয়সা করে নেন। সেজন‌্য আসল নাম আড়ালে পড়ে গেছে। হয়ে উঠেছেন পাঁচ পয়সার ডাক্তার!

গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটী গ্রামে বাড়ি এই পাঁচ পয়সার ডাক্তারের। নাম নুরুল ইসলাম সরকার। তিনি একজন হোমিও চিকিৎসক। তার ওষুধে চমৎকার কাজ হয়। সেজন‌্য দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসে। নামমাত্র ভিজিট নেন বলে গরিবের ডাক্তার বলেও খ‌্যাতি জুটেছে। প্রতিদিন কয়েকশ’ রোগীর চিকিৎসা দেন তিনি। সেজন‌্য সকাল ৯টা থেকে রাতের ৯টা পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়।

পিতা রজ্জব উদ্দীন সরকার ও মাতা নয়া বিবির সংসারে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন নুরুল ইসলাম। ভাই-বোনেদের মধ‌্যে সবার ছোট। এসএসসি পাশ করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি।

যুবক বয়সে তিনি গ্রামের অনেক মানুষকে বিনা চিকিৎসার মারা যেতে দেখেছেন। টাকার অভাবে গ্রামের অনেকেই চিকিৎসা করতে পারেননি। বিষয়টি তাকে খুব নাড়া দেয়। সেখান থেকেই কীভাবে অল্প খরচে মানুষের সেবা দেয়া যায় তাই ভাবতে থাকেন।

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার হবেন। তবে অল্প লেখা-পড়ায় কীভাবে তা সম্ভব? পরে মাথায় আসে হোমিও চিকিৎসক হওয়ার বুদ্ধি। গাইবান্ধা শহরের এক হোমিও চিকিৎসকের কাছে তালিম নিতে থাকেন। দীর্ঘ অধ‌্যাবসায় আর নিরলস সাধনায় এক সময় তিনি রোগের ধরন ও ওষুধের প্রয়োগ পদ্ধতি শিখে ফেলেন। এরপর শুরু করেন চিকিৎসা।

প্রথমে নিজ গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতেন। চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়ায় নাম ছড়িয়ে পড়ে গাইবান্ধা জেলাসহ আশে পাশের জেলাগুলোতে। পাঁচ পয়সা ভিজিট নেয়ার কথাও একই সঙ্গে ছড়িয়ে যায়।

বাড়িতেই অস্থায়ীভাবে একটি চেম্বার খোলেন। ভিড় বাড়তে থাকে। পরে ভিড় সামলাতে ও চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দিতে শহরের পুরাতন বাজারে একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসতে শুরু করেন।

ওষুধে রোগ সারে, ভিজিট নেই বললেই চলে, আচরণ খুবই আন্তরিক। স্রোতের মতো রোগী আসতে থাকে। চরমভাবে ব‌্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তার চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন কয়েকশ’ রোগী ভিড় জমান।

বর্তমানে বিদেশ থেকেও অনেকে চিকিৎসা নিতে আসেন তার কাছে। মোবাইল ফোনে রোগের বৃত্তান্ত শুনে কুরিয়ারেও ওষুধ পাঠান। তবে ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পাঁচ পয়সার বদলে ওষুদের দামটিই শুধু নেন। চিকিৎসকের ফিস নেন না। সেটিও খুবই কম, মাত্র দশ টাকা।

পাঁচ পয়সার এই ডাক্তার বলেন, ‘হোমিওতে সব রোগের চিকিৎসা আছে। কাজেই সব ধরনের রোগেরই চিকিৎসা দিই। আল্লাহর রহমতে রোগ সেরে যায়। সেজন‌্য রোগীরা আমার কাছে আসেন। ভালোবাসেন।’

ডা. নুরুল ইসলামের ছয় চার ছেলে দুই মেয়ের সবাই বিবাহিত। দুই ছেলে তাকে দোকানে হোমিও চিকিৎসা দিতে সহায়তা করেন। অপর একজনের ‘পাঁচপাই এন্ড সন্স’ নামে আলাদা একটি হোমিওর দোকান রয়েছে। অপরজন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী।

বাবার কাজে সহায়তা করেন ছেলে রাজা মিয়া। তিনিও চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘আব্বার বয়স হয়েছে, সে কারণে আমাকেও এই রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে। রংপুর হোমিও মেডিক‌্যাল কলেজ থেকে হোমিও চিকিৎসায় পাশ করে বাবাকে সাহায‌্য করি।’

চিকিৎসা নিতে আসা রোগী হালিমা খাতুন বলেন, ‘দীর্ঘদিন বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিয়েছি, কিন্তু রোগ সারেনি। তাই অন্যের কাছে শুনে পাঁচ পয়সার ডাক্তারের কাছে এসেছি। তার ওষুধ খেয়ে রোগ ভালো হয়েছে। কম টাকায় ভালো চিকিৎসা। তবে একটু সময় বেশি লাগলেও রোগ ভালো হয়।’

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার জনক ডা. হ্যানিম্যানের নির্দেশ- ‘বহু ফোঁটা নয়, এক ফোঁটা’। সেই নির্দেশকে মেনে এক ফোঁটা ওষুধ দিই। শুরুতে দাম নিতাম পাঁচ পয়সা। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করা সেই পাঁচ পয়সার ওষুধের দাম বেড়েছে। সে কারণে পাঁচ পয়সার বদলে এখন ওষুধের দাম রাখি ১০ টাকা। ’

স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক রাজেন্দ্র নাথ বলেন, ‘ডা. নুরুল ইসলাম মানুষকে সেবা দিতে পছন্দ করেন। যে কোনো রোগেরই চিকিৎসা দেন তিনি। উপযুক্ত ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলেন। ধৈর্য ধরে চিকিৎসা দেন তিনি। নুরুল ইসলামের বিকল্প মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ’

গাইবান্ধার পৌর মেয়র শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলন বলেন, ‘আমার পরিবার তার কাছে চিকিৎসা নেয়। তিনি না থাকলে গাইবান্ধার অনেক দরিদ্র মানুষ তার চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।’

গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, ‘অনেকের মুখে শুনেছি, পাচঁ পয়সার ডাক্তার নামে একজন হোমিও চিকিৎসক আছে। শুনেছি, গাইবান্ধাসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য রোগী তার কাছে আসেন চিকিৎসা নিতে। অনেকেই ভালো হয়েছেন তার চিকিৎসায়। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।’

ডা. নুরুল ইসলাম শুধু ওষুধের দাম নেন। নিজের কোনো ফিস নেন না। তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। তবে একটি বিষয়ে আক্ষেপ রয়েছে এই জনদরদী লোকটির। তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটি খুবই খারাপ। সেটি পাকা হয়ে গেলে তার আক্ষেপ ঘোঁচে। মৃত‌্যুর আগে রাস্তাটি পাকা দেখে যেতে চান তিনি।


গাইবান্ধা/দয়াল/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়