ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যুবলীগ সূত্রে সমাধান যুব মহিলা লীগে

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুবলীগ সূত্রে সমাধান যুব মহিলা লীগে

ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগকে শুদ্ধি অভিযানের আওতায় এনে শুদ্ধ করার পর এবার যুব মহিলা লীগেও একই সূত্র প্রয়োগ করে সমাধানে পথে এগোনোর চিন্তা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সংগঠনটির মফস্বল এলাকার একটি শাখার নেতা শামিমা নূর পাপিয়ার চোখ ধাধানো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্যে আসার পর অবাক আওয়ামী লীগের নেতারাও। সংগঠনটির নেতাদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে যুব মহিলা লীগের বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বের কার্যকারিতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এই পরিস্থিতিতে নতুন নেতৃত্ব আনতে ভেঙে দেয়া হচ্ছে বর্তমান নেতৃত্ব। দলীয় সূত্রগুলো এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নারীদের নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জাল নোট সরবরাহ, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে শনিবার যুব মহিলা লীগের নরসিংদী শাখার সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া গ্রেপ্তার হয়।

সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে পাপিয়াকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সম্মেলন করলেও নরসিংদীতে কমিটি দিতে পারেনি। পরে ঢাকায় এসে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নরসিংদী জেলা কমিটি ঘোষণা  করা হয়। পাপিয়াকে নেত্রী করার পেছনে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে নাম উঠে এসেছে ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের নেত্রী সাবিনা আক্তার তুহিন ও নরসিংদী জেলার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের।

এ বিষয়ে যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের কমিটিতে পাপিয়া আগে কোনো পদে ছিল না। নরসিংদীর একটা পক্ষ এই মেয়েকে না দেওয়ার জন্য আমাদের বলেছে। আমি পাপিয়াকে পদ দেওয়ার পক্ষে ছিলাম না। তারপরেও শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।’

পাপিয়াকে টাকার বিনিময়ে পদ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পদ বাণিজ্য করে যারা পাপিয়াকে পদ দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক, এমন মেয়েদের জন্য যুব মহিলা লীগের সম্মান যায়।’

কাদের আশ্রয়ে পাপিয়া এতদূর এগিয়েছে জানতে চাইলে নাজমা আক্তার বলেন, ‘সে কাদের সঙ্গে উঠাবসা করে তাদের খোঁজে বের করলেই সব পেয়ে যাবেন, র‌্যাব-পুলিশ তদন্ত করছে, সব বের হয়ে যাবে। আমাদের অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, তাদের বের করুন।’

জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সংগঠনের বিভিন্ন সূত্র বলছে, শামিমা নূর পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগের পদ দেয়ার সময়ে নেতা-কর্মীদের আপত্তি কানে তোলেননি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিল। পাপিয়া তার রাজনীতিই করতেন। পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের টক অব দ‌্য টপিকস এখন এটিই।

এ বিষয়ে অপু উকিল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২০১৪ সালে আমরা নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের কমিটি দিয়েছি। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় এমপি মন্ত্রীদের অনেক তদবির ছিল। অনেকে এই মেয়েকে পদ দেওয়ার বিরোধিতা করেছে আবার নরসিংদীর মেয়র কামরুল, সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু, জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আসাদুজ্জামানসহ অনেকেই এই মেয়েকে পদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। আমরা জেলায় সাংগঠনিক কার্যমক্রম চালাতে হলে জেলার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই দেই।’

পাপিয়ার বিলাসবহুল জীবনযাপন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না জানিয়ে অপু বলেন, ‘জেলার একজন নেতার বিষয়ে আমরা সাংগঠনিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে পারি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কে কি করল- সেটি কিভাবে জানব। পদ পাওয়ার পর তাকে যেমন দেখেছি পত্রিকায় আসার আগে তাকে তেমনই দেখেছি। কিন্তু এখন জানলাম সে এসব কাজ করেছে।’

রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে কয়েক মাস ধরে বুক করে অবৈধ নারী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিলেন শামিমা নূর পাপিয়া। র‌্যাব বলছে, গত তিন মাসে শুধু ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলেই পাপিয়া বিল দিয়েছেন এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে তিনি প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

দলীয় সূত্র বলছে, পাপিয়ার এমন খবরে চোখ কপালে উঠেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদেরও। তারা বলছেন, পাপিয়ার মতো নষ্টদের সংগঠন থেকে সরিয়ে দিতে হবে দ্রুত। এজন্য শুদ্ধি অভিযান আরো জোরদারের পক্ষে তারা। শামীমা নূর পাপিয়াদের আওয়ামী লীগে দরকার নেই উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেছেন, দল থেকে পাপিয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে।

এদিকে পাপিয়ার কেচ্ছাকাহিনি বেরিয়ে আসার পর তাকে সংগঠন থেকে আজীবন বহিস্কার করার পাশপাশি নরসিংদী কমিটিও ভেঙে দেয়া হয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠকে বসে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে অভিযোগ উঠেছে, নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন এই ভাবনায় কাছের নেতা ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, এই সিদ্ধান্তে নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।

এদিকে দলীয় সূত্র বলছে, যুব মহিলা লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ে আলোচনা চলছে। শামিমা নূর পাপিয়াকে কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর আওয়ামী লীগ এবং এবং যুব মহিলা লীগ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং মন্ত্রীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার পর এটি তাদের মধ্যে বিরাট অস্বস্তি তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনকে শিগগিরই ঢেলে সাজানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে যেকোনো সময়ে নাজমা আক্তার ও অপু উকিলেরও অন্য দুই সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতীম  সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মতো ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে।

এর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডে সমালোচিত হয়ে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় ওমর ফারুক চৌধুরীকে। একই ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়। এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পদ ছাড়তে হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে। একই অভিযোগে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউসার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ পদ হারান।

পাপিয়া ও যুব মহিলা লীগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কেউ অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে, এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অ্যালাউ করবে না। তার সরকার এখনও এলাও করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না। এ ব্যপারে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারে অব্যাহত রয়েছে।’

‘আমরা একটি বড় দল এই দলে ভালো, খারাপ সবই আছে। সব আমরা ভালো লোক, এই দাবি আমি করি না। তবে খারাপ লোকদের চিহ্নিত করে, খারাপকে তার অপকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়ার বিধান এই দলে আছে।’

যুব মহিলা লীগের কমিটি নিয়ে তিনি বলেন, সংগঠনটির সম্মেলনের সময় চলে এসেছে। মার্চে তাদের মেয়াদ শেষ হবে। তাদের সম্মেলন এমনিতেই করতে হবে।

২০১৭ সালের ১১ মার্চ যুব মহিলা লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে নাজমা আক্তারকে সভাপতি এবং অধ্যাপিকা অপু উকিলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এর তিনমাস পর ২৫ জুলাই যুব মহিলা লীগের ১২১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।


ঢাকা/পারভেজ/সাইফ/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়